- যমুনা, সচিবালয় কেন্দ্রিক আন্দোলন থামছেই না
- ১০ মাসে ৫ বার নিষেধাজ্ঞা দিলেও কার্যকারিতা নেই
- ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম সচিবালয়ে আন্দোলনকারীদের
‘যমুনা ও সচিবালয় এলাকা অত্যন্ত সংবেদনশীল। সাধারণত নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ ৩০ দিন হলেও প্রয়োজনে আবারও বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়’ Ñমুহাম্মদ তালেবুর রহমান, ডিএমপির মুখপাত্র
‘শুধু নিষেধাজ্ঞা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায় না। পুলিশকে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে কৌশলগতভাবে সমাধানের পথে যেতে হবে’ Ñঅধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক
রাজধানীর কাকরাইল, মিন্টো রোড, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়, অফিসার্স ক্লাব ও সচিবালয় ঘিরে বারবার গণজমায়েত ঠেকাতে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে আসছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। ‘নিরাপত্তাজনিত’ কারণ দেখিয়ে গত ১০ মাসে মোট পাঁচবার এমন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা থাকা অবস্থায়ও সচিবালয় ও যমুনা বাসভবন কেন্দ্রিক এলাকায় রাজনৈতিক, পেশাজীবী ও নাগরিক সংগঠনগুলোর আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে সরকারি কর্মচারীরা সচিবালয়ের ভেতরে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করছেন সরকারি কর্মচারী অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে। সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ বাতিলের দাবিতে চলমান আন্দোলন থেকে সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছেন আন্দোলনরত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নেতারা। এই সময়ের মধ্যে দাবি আদায় না হলে রোববার থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে ব্লকেড কর্মসূচি পালন করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
সর্বশেষ ২০২৫ সালের ৪ জুন ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাদ আলীর স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ৯ জুন থেকে কাকরাইল, সচিবালয় ও আশপাশের এলাকায় সব ধরনের সভা-সমাবেশ, মিছিল ও গণজমায়েত নিষিদ্ধ থাকবে। আগের মতো এবারও বলা হয়েছে, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। এর আগে ২০২৪ সালের ২৬ আগস্ট, ৩০ আগস্ট এবং ২০২৫ সালের ১৩ মার্চ ও ১০ মে একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। প্রতিবারই বলা হয়, নিষেধাজ্ঞা ‘স্থায়ীভাবে কার্যকর’ থাকবে। অথচ আবার নতুন বিজ্ঞপ্তি দিতে হচ্ছে, ফলে প্রশ্ন উঠছে, আগের নিষেধাজ্ঞাগুলো কার্যকর ছিল কি না।
২০২৪ সালের ১৭ আগস্ট যমুনার সামনে প্রথম কর্মসূচি নেয় আউটসোর্সিং কর্মীরা। এরপর থেকে পোশাক শ্রমিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, বিরোধী দলের নেতাকর্মী, নাগরিক সংগঠনসহ বিভিন্ন পক্ষ ওই এলাকাকে আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বেছে নিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ২০ মে বকেয়া বেতনের দাবিতে কাকরাইল মোড় অবরোধ করেন পোশাক শ্রমিকরা। ২১-২২ মে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের সমর্থনে যমুনার সামনে অবস্থান করেন তার সমর্থকরা। একই সময়ে ছাত্রদল ও ঢাবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ করে ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়ে। এর আগে ১৪-১৫ মে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আবাসনের দাবিতে, ৮-৯ মে বিভিন্ন সংগঠন আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে, ১ জুন ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পের কর্মীদের দাবি বাস্তবায়নে যমুনার উদ্দেশে কর্মসূচি পালন করেন।
প্রসঙ্গত, সচিবালয় কেন্দ্রিক আন্দোলনের সূচনা হয় ২০২৪ সালের ১১ আগস্ট ‘বাংলাদেশ সচিবালয় বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী সংগঠন’-এর ব্যানারে। এরপর আনসার-ভিডিপি সদস্য, চাকরিচ্যুত পুলিশ ও বিডিআর সদস্য এবং শিক্ষার্থীরাও নিয়মিত কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। আন্দোলনকারীদের মতে, যমুনা বাসভবনের সামনেই সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রস্থল। ফলে এই এলাকায় আন্দোলন করলেই দ্রুত সাড়া মেলে। ডিএমপির নিষেধাজ্ঞা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশকে নিষ্ক্রিয় দেখা গেছে। কোথাও হালকা বাধা দেওয়া হলেও অধিকাংশ কর্মসূচি নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়েছে। এতে প্রশ্ন উঠেছে নিষেধাজ্ঞাগুলো কেবল ‘প্রাতিষ্ঠানিক রীতি’ হিসেবে জারি হচ্ছে, নাকি এর পেছনে রাজনৈতিক হিসাবও আছে? ডিএমপির মুখপাত্র, উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, যমুনা ও সচিবালয় এলাকা অত্যন্ত সংবেদনশীল। সাধারণত নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ ৩০ দিন হলেও প্রয়োজনে আবারও বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। আমরা চাই যত কম বলপ্রয়োগে আইন প্রয়োগ সম্ভব হয়। কখনও কৌশলগত কারণে নমনীয় অবস্থান নেওয়া হয়। তবে আইন ভাঙলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন।
বিশ্লেষকদের মতে, নিষেধাজ্ঞা কৌশলগত হোক বা নিরাপত্তার স্বার্থে তা তখনই কার্যকর হবে, যখন তার প্রয়োগে স্বচ্ছতা ও সমতা থাকবে।
নয়তো এটি পরিণত হবে তথাকথিত ‘বিজ্ঞপ্তি রাজনীতি’-তে। একবার নিষেধাজ্ঞা জারি হলে তা কার্যকর রাখলেই যথেষ্ট, বারবার পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেইÑ যদি বাস্তবেই তা কার্যকর হয়। অন্যথায়, এটি আইন প্রয়োগ নয়, বরং প্রশাসনিক অনিশ্চয়তা ও রাজনৈতিক সংকেতের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই গণ্য হবে। অপরাধ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, শুধু নিষেধাজ্ঞা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায় না। পুলিশকে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে কৌশলগতভাবে সমাধানের পথে যেতে হবে। তবেই সংঘাত কমবে, আইন কার্যকর হবে।























