মীম মিজান
মহাকবি হাফিজ শিরাজি রুটি বানাতেন। জীবিকা নির্বাহের জন্য তার প্রাথমিক পেশাই ছিল এটি। আটা-ময়দার অনু কণাকে পানিতে মিশিয়ে একসঙ্গে গেঁথে দিয়ে সুন্দর করে রুটির খামির দিয়ে তা থেকে ডলে ডলে রুটির রূপ দিয়ে জ্বলন্ত চুলোর ওপর তাওয়ায় সেঁক দিয়ে ফুলিয়ে দারুণ ও সুস্বাদু রুটি উপহার দিতেন ক্ষুধার্ত মানুষকে। সেই হাফিজই আবার কল্পরাজ্যের শব্দ ভাণ্ডার খুঁজে, চয়ন করতেন সাধারণ শব্দ। সে সাধারণ শব্দগুলো পঙক্তিতে গেঁথে মুক্তো মালার মতো রূপ দিতেন। অর্থে বা ভাবে যেগুলোর মূল্য এত বেশি যে কিয়ামত পর্যন্ত যত ভাবুক ও পাঠক শ্রেণির আগমন ঘটবে তাদের মনো তৃষ্ণায় শীতল জল বা সঞ্জীবনী হিসেবে কাজ করবে। কী প্রেম, দ্রোহ বা আধ্যাত্মিকতা! সব কিছুই সৌম্যরূপে ধরা দিয়েছে তার গজলে। এ হাফিজই কবিগুরুর পিতার আরাধ্য পুরুষ। নিশীথের জপমালার রচয়িতা। আধ্যাত্মিক পিপাসার আবে হায়াত। খাজা শামসুদ্দিন হাফিজের নামের বাঙলায়নই রবীন্দ্রনাথ। সেই হাফিজের বিদেহী আত্মার সাক্ষাতে গিয়ে শিরাজের সেই মোসাল্লায় বসে ধ্যানমগ্ন হয়েছিলেন বিশ্বকবি। সেই বিশ্বকবির স্বপ্নের স্থান শান্তিনিকেতনে শান্তির তিন দিন কাটিয়ে ফিরছিলাম। কিন্তু পথিমধ্যে বর্ধমান জেলার বিশাল রেলস্টেশনে নজরুলের প্রেম আমাকে আবিষ্ট করল। অধ্যাপক পতিতপাবন পাল দাদার সম্মতিতে সঙ্গে সঙ্গেই নেমে পড়লাম আমরা। এবার আসানসোলগামী ট্রেনের অপেক্ষা। গিজগিজ করা স্টেশনে দুই বান্ধবীর বহুমুখী আলাপচারিতা আমার দৃষ্টি কাড়ল। একজন হিন্দু ভদ্রমহিলা। অন্যজন মুসলিম। বেশভূষায় হাজির তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস। একটি কাজে যোগদান করবেন মুসলিম মহিলা। মধ্যবয়সী। এ বয়সে তো স্বামী-সংসার নিয়েই তার ব্যস্ত থাকার কথা। কিন্তু কাজে যোগদান করবার হেতু জিগ্যেস করতেই থলের বেড়াল বেরিয়ে আসল। ওনার পুরুষটি আরেকজনকে বিয়ে করে নতুন সংসার পেতেছেন। তাই তার নিজের সন্তানকে মানুষ ও স্বীয় জীবনকে পরিচালনার জন্যই উপার্জন দরকার। লোকটি খুবই পছন্দ করতেন এ নারীকে। ভালোও বাসতেন ঢের। কিন্তু কাজের ফাঁকে নতুন ওই প্রমীলার সঙ্গে টুকরা টাকরা কথা হতো। কথাকে মাড়িয়ে নাকি আস্তেধীরে পরকীয়ার ভ্রƒণ জন্ম নেয় উভয়ের মনে। অতঃপর অবহেলা, উপেক্ষা আর অনাদর শখের নারীকে। শেষে পূর্ব ভোগকৃত খাদ্যের পুনঃ স্বাদ গ্রহণের বিকৃত খায়েশই বিচ্ছেদের সুরে মরীচিকায় বেঁধে ফেলে তাকে। চারদিকে এমনই বিশ্বাসহীনতার মহামারি। সুন্দর ফুটফুটে অনেক কলিকে ছুড়ে ফেলে এমনকি কসাইয়ের মতো দিয়েছে ছুড়ি চালিয়ে। মরীচিকা তাদের দিয়েছে শুধুই আলেয়ার হাতছানি। ইথারে আজ জমে আছে তাদের হাপিত্যেশ বাণী। সফেদ, ফুলশোভিত শয়ন নেই, নীল কষ্টের মহাকাব্যে মোড়ানো বিছানার চাদর তাদের, যা ভিজিয়েছে অনুতপ্ত চোখের পানি।
তেভাগা নামক ট্রেন আসতেই হুড়োহুড়ি করে তারা ঢুকে গেলেন তিলধারণের ঠাঁইহীন লৌহ উদরে। অধ্যাপক মহোদয় টিকিট নিয়ে আসলেন। সাইরেন বাজিয়ে গঙ্গা এক্সপ্রেস প্ল্যাটফরমে আসতেই আমরা যুদ্ধাংদেহী হয়ে উঠে পড়ি। শত শত মানুষকে কনুইয়ের জোরে মাড়িয়ে উঠে বসলাম। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নজরুল সম্পর্কে জানতে চাইলাম অধ্যাপক মহোদয়ের কাছে। তিনি বেশ ভালোই জানেন। তবে কখনো নজরুলের জন্মভিটায় তার যাওয়া হয়নি। আমরা ওখানে গিয়ে কোথায় যাব, কার কাছে উঠব ইত্যাদি আলাপ করছিলাম। আর দিগন্ত জোড়া সবুজের মাঝে দৃষ্টিকে প্রসারিত করছিলাম। এ জেলাকে পশ্চিমবঙ্গের শস্যভাণ্ডার হিসেবে যদি আখ্যায়িত করি, তবে তা বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না। সফেদ বলাকা ঝাঁক ধরে উড়ে যাচ্ছে। মহিষের পাল আপন মনে ঘাস খেয়ে পেট ভরাচ্ছে। কচুক্ষেত আর ধানের নাড়ার সবুজ অনুচ্চ অংশগুলো সমান্তরালে ছন্দে ছন্দে দুলছে। এখানেই তো আমার প্রিয় হাসান আজিজুল হকের জন্মভিটা। তার নেওয়া সর্বশেষ অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি আমারই। তাতে তাকে যে প্রশ্নগুলো করেছিলাম সেগুলোর মধ্যে শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতি বেশি ছিল। শিম আর আলুই ছিল সে সময়কার অন্যতম সবজি। আর শকুন নামক গল্পে যে বিস্তীর্ণ ক্ষেতের কথা তিনি লিখেছেন তা এ সুবিশাল সবুজ প্রান্তরকে বাস্তবে রূপ দেয়। তিনিও নজরুলের জন্মভিটায় গিয়েছিলেন। এ রকম ট্রেনে করে স্টেশনে উঠে কয়েকটি স্টেশন পেরিয়েই নামতেন। তারপর অন্য বাহনে উঠে গিয়েছিলেন। মাটির বাড়ি দেখেছিলেন তিনি।
ট্রেন যখন আসানসোল রেলস্টেশনে থামল তখন বিকেলটা মরে যাচ্ছে। কী দারুণ রূপে বাংলার আবহমান চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দেয়ালগুলোতে। স্টেশনের বাইরে ট্রেনের কয়েকটি কামড়া। এ বাবা এগুলো এখানে কেন। যায় না তো। নড়েও না। কয়েকজন ওয়েটারকে দেখলাম খাবারের ডালা নিয়ে সেখানে উঠল। এবার ভ্রম কেটে গেল। এটা যে রেস্তোরাঁ। ট্রেন রেস্টুরেন্ট। কী নব নব ভাবনা। পরিপাটি প্রাঙ্গণ। লাল রঙের ব্যবহার ব্রিটিশদের কথা স্মরণ করিয়ে দিল। আদালতের মতো দেখতে হলেও ওপরের গম্বুজগুলো মসজিদ-মন্দির উভয়টিকে প্রতিনিধিত্ব করে। ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত স্থাপনাটি জন্মকালীন জৌলুস এখনো ধরে রেখেছে। অধ্যাপক মহোদয়কে দাঁড় করিয়ে আমি ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ সারলাম। যে পাঞ্জাবি তিনি পরেছেন তা পুরোটাই ফোকলোরের মিউজিয়াম। ক্যানভাসে নকশা। আচরণে সৌম্য অধ্যাপক বন্ধু এবার ক্যামেরা বাজি করলেন। আমার পাঞ্জাবিতে বৈশাখ, ঈদ আবহের সম্মিলন। হাতে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের থলে। তলের অভ্যন্তরে পিএইচডির জন্য বই।
বেশ গরম। ৬.৪৫টা। আমরা হেঁটে এগোচ্ছি। মূল রাস্তায় উঠে বাসে করে চুরুলিয়া যাব। ডানে-বাঁয়ে অনেক দোকান। রাস্তাটি বেশ উঁচু। কোনো একটি দোকানে হয়তো বিংশ শতকের গোড়ার দিকে আমাদের বাংলার বুলবুল ও হাফিজ রুটির দোকানে কাজ করতেন। রুটির আটা পানিতে মিশিয়ে মিশিয়ে দারুণ খামির করে রুটির প্রাথমিক রূপ দিতেন। মনের ভেতরেও অনুরূপ শব্দমালা সাজাতেন। যা এখন আমাদের মনে দ্রোহী সত্তাকে জাগিয়ে তোলে। প্রেমিকার খোঁপায় তারার ফুল দেওয়ার মতো খেয়ালি করে তোলে।


























