০৩:১৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ৯ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মানবতার এক উজ্জ্বল ক্যানভাস ইউনিভার্সাল হেল্প হাব

এই পৃথিবীটা যেন এক বিশাল ক্যানভাস। কোথাও ফুটেছে হাসির উজ্জ্বল রঙ, কোথাওবা আঁকা হয়েছে বেদনার ধূসর ছবি। কিছু মানুষ এই ক্যানভাসে কেবল নিজেদের রঙ ছড়িয়ে যায়, আর কিছু মানুষ আছে, যারা অন্যের মলিন ছবিতে নতুন রঙের ছোঁয়া দিয়ে যায়। ‘ইউনিভার্সাল হেল্প হাব’ (ইউএইচএইচ) হলো সেই বিরল চিত্রশিল্পীদের দল, যারা নিঃস্বার্থভাবে মানবসেবার তুলি হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তাদের পথচলার গল্পটা শুধুই সেবার নয়, এ এক গভীর ভালোবাসার কাব্য, যা ছুঁয়ে যায় হাজারো মানুষের হৃদয়।

এই সংগঠনের মূল রূপকার মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলামের হাতে গড়া এক স্বপ্ন। সময়টা ছিল ২০১৬ সালের ২১ নভেম্বর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য স্নাতক শেষ করা এক তরুণ, যিনি উচ্চবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠলেও তার হৃদয় সবসময় কাঁদত সুবিধাবঞ্চিত মানুষের দুঃখে। ছোটবেলায় নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় দেখা সেই স্বপ্নকে তিনি বাস্তবে রূপ দেন ‘ইউনিভার্সাল হেল্প হাব’ নামের এক মানবিক সংগঠন গড়ে তুলে। তার উদ্দেশ্য ছিল খুব সহজ, অথচ গভীর মানবিক—অসহায় মানুষের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা, ত্রাণ বিতরণ এবং জরুরি মুহূর্তে
তাদের পাশে থাকা। আজ তিনি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, কিন্তু তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন মানবতার প্রেমিক।

ইউনিভার্সাল হেল্প হাবের হাত প্রসারিত হয়েছে দেশের আনাচে-কানাচে। রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী থেকে শুরু করে সিলেট, পাবনা, ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ—নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে তারা ছুটে গেছেন মানুষের পাশে। তাদের স্পর্শে কখনও বন্যাদুর্গত মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে ত্রাণসামগ্রী পেয়ে, কখনও শীতের রাতে উষ্ণতা পেয়েছে অসহায় মানুষ। রমজান মাসে ইফতার বিতরণ কিংবা কোরবানির ঈদে গরিবের ঘরে মাংস পৌঁছে দেওয়াও তাদের মানবিকতারই অংশ। করোনাকালীন দুর্যোগেও তাদের সেবার ধারা থেমে থাকেনি, যা প্রমাণ করে তাদের অঙ্গীকার কতটা দৃঢ়। গত ডিসেম্বর মাসে খুলনার পাইকগাছা উপজেলায় পনেরতম ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে ১০০০ অসুস্থ মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিয়ে তারা আবারও প্রমাণ করেছেন, তারা কেবল নামেই হাব নয়, তারা মানুষের সত্যিকারের আশ্রয়স্থল।

তবে, তাদের সবচেয়ে হৃদয়স্পর্শী উদ্যোগটি হলো বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসন। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে যখন ভয়াবহ বন্যায় ১১টি জেলার হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি, গবাদিপশু ও শস্যক্ষেত্র হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে, তখন ইউনিভার্সাল হেল্প হাব শুধু ত্রাণ দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। তারা উপলব্ধি করেন, গৃহহীন মানুষের জন্য শুধু ত্রাণসামগ্রী যথেষ্ট নয়। তাই তারা এক অভিনব উদ্যোগ গ্রহণ করেন—বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোর জন্য টিন দিয়ে টেকসই ঘর নির্মাণ। ফেনী জেলার দাগনভূঞা উপজেলার ১০টি বিধবা, স্বামী-পরিত্যক্তা বা উপার্জনে অক্ষম পরিবারের জন্য এই ঘরগুলো ছিল নতুন করে বেঁচে থাকার এক উজ্জ্বল স্বপ্ন। উপকারভোগী জাহান আরা বেগম যখন বলেন,
“বন্যায় আমার বাড়ি ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গেছে। এই মানুষগুলো ঘর না দিলে রাস্তায় থাকার লাগতো,” তখন তার প্রতিটি কথায় ছিল গভীর কৃতজ্ঞতা।

ইউনিভার্সাল হেল্প হাবের মানবিকতার এই ধারা এবার প্রবাহিত হয়েছে শিক্ষার আঙিনায়। গত ১৩ আগস্ট ২০২৫, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২০ জন এতিম ও সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীর জন্য ‘নাহার-অরফান আপলিফ্টমেন্ট স্কলারশিপ’ প্রদান করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক বিল্ডিং ৩-এর এমআইএস গ্যালারি রুমে অনুষ্ঠিত এই আয়োজনে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে এককালীন ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এই টাকা কেবল কিছু নোট নয়, এটি ছিল ১২০টি স্বপ্নকে নতুন করে জ্বালিয়ে তোলার এক অগ্নিশিখা। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মোঃ শওকত আলী এই উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন, “এই শিক্ষার্থীরা শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা বিশ্বে প্রস্তুত হচ্ছে।”

মুজাহিদুল ইসলাম তার বক্তব্যে বলেন, “যাদের বাবা-মা নেই, তারা বোঝে পৃথিবীটা কত কঠিন। বাবা-মা না থাকার অভাব কোনোভাবেই পূরণ হওয়ার নয়।” তার এই কথাগুলো শুধু একটি বিবৃতি নয়, এটি ছিল একটি গভীর অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ, যা প্রতিটি মানুষের হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। ইউনিভার্সাল হেল্প হাব’ শুধু একটি সংগঠন নয়, এটি একটি মানবিক আন্দোলন। খাদ্য বিতরণ থেকে শুরু করে চিকিৎসাসেবা, ঘর নির্মাণ কিংবা শিক্ষাবৃত্তি—প্রতিটি কাজেই ফুটে ওঠে মানবসেবার প্রতি তাদের একান্ত অঙ্গীকার। তাদের এই পথচলা প্রমাণ করে, সত্যিকারের ইচ্ছাশক্তি থাকলে মানুষের জীবনে আলো জ্বালানো অসম্ভব নয়। এই আলোয় আলোকিত হয়ে ১২০ জন শিক্ষার্থীর মুখে যে হাসি আজ দেখা গেছে, তা কেবল একটি বৃত্তির হাসি নয়, এটি মানবতার জয়, ভালোবাসার জয় এবং আগামী দিনের এক উজ্জ্বল বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।

জনপ্রিয় সংবাদ

একনেক সভায় ৪৬ হাজার ৪১৯ কোটি টাকার ২২ প্রকল্প অনুমোদন

মানবতার এক উজ্জ্বল ক্যানভাস ইউনিভার্সাল হেল্প হাব

আপডেট সময় : ০২:৫৬:১৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ অগাস্ট ২০২৫

এই পৃথিবীটা যেন এক বিশাল ক্যানভাস। কোথাও ফুটেছে হাসির উজ্জ্বল রঙ, কোথাওবা আঁকা হয়েছে বেদনার ধূসর ছবি। কিছু মানুষ এই ক্যানভাসে কেবল নিজেদের রঙ ছড়িয়ে যায়, আর কিছু মানুষ আছে, যারা অন্যের মলিন ছবিতে নতুন রঙের ছোঁয়া দিয়ে যায়। ‘ইউনিভার্সাল হেল্প হাব’ (ইউএইচএইচ) হলো সেই বিরল চিত্রশিল্পীদের দল, যারা নিঃস্বার্থভাবে মানবসেবার তুলি হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তাদের পথচলার গল্পটা শুধুই সেবার নয়, এ এক গভীর ভালোবাসার কাব্য, যা ছুঁয়ে যায় হাজারো মানুষের হৃদয়।

এই সংগঠনের মূল রূপকার মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলামের হাতে গড়া এক স্বপ্ন। সময়টা ছিল ২০১৬ সালের ২১ নভেম্বর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য স্নাতক শেষ করা এক তরুণ, যিনি উচ্চবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠলেও তার হৃদয় সবসময় কাঁদত সুবিধাবঞ্চিত মানুষের দুঃখে। ছোটবেলায় নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় দেখা সেই স্বপ্নকে তিনি বাস্তবে রূপ দেন ‘ইউনিভার্সাল হেল্প হাব’ নামের এক মানবিক সংগঠন গড়ে তুলে। তার উদ্দেশ্য ছিল খুব সহজ, অথচ গভীর মানবিক—অসহায় মানুষের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা, ত্রাণ বিতরণ এবং জরুরি মুহূর্তে
তাদের পাশে থাকা। আজ তিনি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, কিন্তু তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন মানবতার প্রেমিক।

ইউনিভার্সাল হেল্প হাবের হাত প্রসারিত হয়েছে দেশের আনাচে-কানাচে। রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী থেকে শুরু করে সিলেট, পাবনা, ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ—নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে তারা ছুটে গেছেন মানুষের পাশে। তাদের স্পর্শে কখনও বন্যাদুর্গত মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে ত্রাণসামগ্রী পেয়ে, কখনও শীতের রাতে উষ্ণতা পেয়েছে অসহায় মানুষ। রমজান মাসে ইফতার বিতরণ কিংবা কোরবানির ঈদে গরিবের ঘরে মাংস পৌঁছে দেওয়াও তাদের মানবিকতারই অংশ। করোনাকালীন দুর্যোগেও তাদের সেবার ধারা থেমে থাকেনি, যা প্রমাণ করে তাদের অঙ্গীকার কতটা দৃঢ়। গত ডিসেম্বর মাসে খুলনার পাইকগাছা উপজেলায় পনেরতম ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে ১০০০ অসুস্থ মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিয়ে তারা আবারও প্রমাণ করেছেন, তারা কেবল নামেই হাব নয়, তারা মানুষের সত্যিকারের আশ্রয়স্থল।

তবে, তাদের সবচেয়ে হৃদয়স্পর্শী উদ্যোগটি হলো বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসন। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে যখন ভয়াবহ বন্যায় ১১টি জেলার হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি, গবাদিপশু ও শস্যক্ষেত্র হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে, তখন ইউনিভার্সাল হেল্প হাব শুধু ত্রাণ দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। তারা উপলব্ধি করেন, গৃহহীন মানুষের জন্য শুধু ত্রাণসামগ্রী যথেষ্ট নয়। তাই তারা এক অভিনব উদ্যোগ গ্রহণ করেন—বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোর জন্য টিন দিয়ে টেকসই ঘর নির্মাণ। ফেনী জেলার দাগনভূঞা উপজেলার ১০টি বিধবা, স্বামী-পরিত্যক্তা বা উপার্জনে অক্ষম পরিবারের জন্য এই ঘরগুলো ছিল নতুন করে বেঁচে থাকার এক উজ্জ্বল স্বপ্ন। উপকারভোগী জাহান আরা বেগম যখন বলেন,
“বন্যায় আমার বাড়ি ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গেছে। এই মানুষগুলো ঘর না দিলে রাস্তায় থাকার লাগতো,” তখন তার প্রতিটি কথায় ছিল গভীর কৃতজ্ঞতা।

ইউনিভার্সাল হেল্প হাবের মানবিকতার এই ধারা এবার প্রবাহিত হয়েছে শিক্ষার আঙিনায়। গত ১৩ আগস্ট ২০২৫, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২০ জন এতিম ও সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীর জন্য ‘নাহার-অরফান আপলিফ্টমেন্ট স্কলারশিপ’ প্রদান করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক বিল্ডিং ৩-এর এমআইএস গ্যালারি রুমে অনুষ্ঠিত এই আয়োজনে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে এককালীন ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এই টাকা কেবল কিছু নোট নয়, এটি ছিল ১২০টি স্বপ্নকে নতুন করে জ্বালিয়ে তোলার এক অগ্নিশিখা। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মোঃ শওকত আলী এই উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন, “এই শিক্ষার্থীরা শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা বিশ্বে প্রস্তুত হচ্ছে।”

মুজাহিদুল ইসলাম তার বক্তব্যে বলেন, “যাদের বাবা-মা নেই, তারা বোঝে পৃথিবীটা কত কঠিন। বাবা-মা না থাকার অভাব কোনোভাবেই পূরণ হওয়ার নয়।” তার এই কথাগুলো শুধু একটি বিবৃতি নয়, এটি ছিল একটি গভীর অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ, যা প্রতিটি মানুষের হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। ইউনিভার্সাল হেল্প হাব’ শুধু একটি সংগঠন নয়, এটি একটি মানবিক আন্দোলন। খাদ্য বিতরণ থেকে শুরু করে চিকিৎসাসেবা, ঘর নির্মাণ কিংবা শিক্ষাবৃত্তি—প্রতিটি কাজেই ফুটে ওঠে মানবসেবার প্রতি তাদের একান্ত অঙ্গীকার। তাদের এই পথচলা প্রমাণ করে, সত্যিকারের ইচ্ছাশক্তি থাকলে মানুষের জীবনে আলো জ্বালানো অসম্ভব নয়। এই আলোয় আলোকিত হয়ে ১২০ জন শিক্ষার্থীর মুখে যে হাসি আজ দেখা গেছে, তা কেবল একটি বৃত্তির হাসি নয়, এটি মানবতার জয়, ভালোবাসার জয় এবং আগামী দিনের এক উজ্জ্বল বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।