০৪:১০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

১৫ শতাংশ কর পরিশোধ নিয়ে উদ্বেগে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়

🟠আইন সংশোধন করে ‘লাভজনক’ প্রতিষ্ঠানেরও সুবিধা চান মালিকরা

🟠বর্তমান পদ্ধতিতে কর দিলে অনেক বিশ^বিদ্যালয় বন্ধের আশঙ্কা

🟠 জটিলতা নিরসনে রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ কামনা

🟠প্রয়োজনে রিভিউ পিটিশনের প্রস্তুতি

আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী ১৫ শতাংশ হারে আয়কর প্রদান নিয়ে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় পড়েছে দেশের বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলো। ট্রাস্টের আওতায় অলাভজনক হিসেবে পরিচালিত এ বিশ^বিদ্যালয়গুলোর কর দেওয়ার বিষয়টি বিশ^বিদ্যালয় আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। উদ্ভূত পরিস্থিতি আইনে সংশোধন এনে লাভজনক ও অলাভজনকÑদুই পদ্ধতিই চালুর দাবি জানিয়েছেন বিশ^বিদ্যাালয় মালিকরা। অন্যথায় বিদ্যমান আইনে কর দিতে গেলে বিশ^বিদ্যালয়গুলো চরম বিপাকে পড়বে এবং অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধের আশঙ্কা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এ জটিলতা নিরসনে হস্তক্ষেপ চেয়ে এরই মধ্যে বিশ^বিদ্যালয়গুলোর আচার্য ও রাষ্ট্রপতির কাছে লিখিত আবেদন করেছে মালিকদের সংগঠন-বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় সমিতি। এখন রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের পাশাপাশি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন মালিকরা। প্রয়োজনে রিভিউ পিটিশন করারও প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।

সূত্রমতে, দেশের সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে ১৫ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হবে বলে রায় দেন আপিল বিভাগ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকারের ১৫ শতাংশ হারে আয়কর আদায় সংক্রান্ত আপিল নিষ্পত্তি করে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বোরহান উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ এ আদেশ দেন।

এ আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ^বিদ্যালয়গুলোর সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে ‘বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় সমিতির’ সচিব বেলাল আহমেদ গতকাল সবুজ বাংলাকে বলেন, আদেশ অনুযায়ী কর প্রদান নিয়ে আমরা খুব দুশ্চিন্তায় আছি। আমরা ভ্যাট দিতে রাজি তবে সেটার জন্য আইনের পরিবর্তন দরকার। কারণ আইন অনুযায়ী বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। ট্রাস্টের মাধ্যমে এগুলো পরিচালিত হয়। কর দিতে হলে আইনে পরিবর্তন এনে অলাভজনকের পাশাপাশি লাভজনক অপশন রাখা দরকার। এতে যারা লাভজনক হবে তারা কর দিবে আর যারা ট্রাস্টের আওতায় থাকবে তাদের কর দেয়া লাগবে না। অন্যথায় অলাভজনক হয়েও কর দেয়া বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলোর পক্ষে সম্ভব হবে না। এতে অনেক বিশ^বিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে। বিদেশের বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলো লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবেই পরিচালিত হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।

আপিল বিভাগের সর্বশেষ রায়ের আগে ২০০৭ সালের ২৮ জুন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন অনুমোদিত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং অপরাপর বিশ্ববিদ্যালয় যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়, তাদের উদ্ভূত আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে আয়কর পুনর্নির্ধারণ করা হলো। ১ জুলাই থেকে এটা কার্যকর হবে।’

২০১০ সালের ১ জুলাই এনবিআরের আরেক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ, বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বা শুধু তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষাদানে নিয়োজিত বেসরকারি কলেজের উদ্ভূত আয়ের ওপর প্রদেয় আয়করের হার হ্রাস করে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হলো।’ এরপর বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ৪৬টি রিট করা হয়েছিল।

২০২১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকারের ১৫ শতাংশ হারে আয়কর আদায়ের দুই প্রজ্ঞাপন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি (লিভ টু আপিল) দেন আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে এ আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এ আয়কর আদায় থেকে বিরত থাকতে এনবিআরকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

২০২৩ সালের জুন মাসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকারের ১৫ শতাংশ হারে আয়কর আদায় সংক্রান্ত আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আয়কর আদায় থেকে বিরত থাকতে আপিল বিভাগের আদেশ বহাল রাখা হয়। একইসঙ্গে আয়কর আদায় নিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে দায়ের করা ৪৬টি রিট হাইকোর্টে চূড়ান্ত শুনানির আদেশ বহাল রাখা হয়।

এদিকে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি বরাবার পাঠানো বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় সমিতির আবেদনে বলা হয়, অতি সম্প্রতি অলাভজনক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর ১৫ শতাংশ হারে আয়কর প্রদান সংক্রান্ত ২০২১ সালে করা রিট আপিলের নিষ্পত্তি ঘোষণা করা হয়েছে। যার ফলে অলাভজনক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ আয়কর প্রদানের আওতাভুক্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে এবং এ খাতে ব্যাপক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে।
আবেদনে সমিতির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ (ধারা-১৫) অনুযায়ী ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ অলাভজনক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে। উক্ত আইনের ৪৪(৭) ধারা অনুযায়ী ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলের অর্থ উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় ব্যয় ব্যতীত অন্য কোনো উদ্দেশে ব্যয় করা যাইবে না’ মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। এমতাবস্থায়, আয়কর প্রদানের নির্দেশনা বিশ্ববিদ্যালয়কে উভয় সংকটে ফেলবে। কেননা, প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলের কোনোরূপ অর্থ উদ্যোক্তা-প্রতিষ্ঠাতাগণ যেমন গ্রহণ করতে পারেন না, তেমনি আয়কর হিসেবে প্রদান করা বা অন্যভাবে ব্যয় করার বিষয়টিও সরাসরি আইনের লঙ্ঘন হিসেবেই প্রতীয়মান।

তিনি বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ কোনোরূপ সরকারি অনুদান ব্যতিরেকে কেবলমাত্র শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি এবং সংকটকালীন সময় ট্রাস্টি উদ্যোক্তাগণের কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলে অর্থ সংকটের কারণে নিজস্ব ক্যাম্পাস ভবনের জন্য অখন্ড জমি ক্রয়, ক্যাম্পাস নির্মাণ করা অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এমনিতেই ক্যাম্পাস নির্মাণ সামগ্রীসহ শিক্ষা সামগ্রী, ল্যাবের যন্ত্রপাতি ইত্যাদি ক্রয়ের উপর সরকারি ভ্যাট/ট্যাক্স প্রদান করতে হয়। উপরন্ত আয়কর আরোপ করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক উন্নয়ন কাজ বিঘ্নিত তথা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা হ্রাসসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ সংকটের আশংকা রয়েছে। সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা-ট্রাস্টিগণ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বেন।

শেখ কবির হোসেন বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০’-এর আওতায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের নির্দেশনা মোতাবেক ট্রাস্ট গঠনের মাধ্যমে সব ধরনের বিধিবিধান মেনে পরিচালিত। এক্ষেত্রে ট্রাস্ট আইনে পরিচালিত সব প্রতিষ্ঠানই করের আওতামুক্ত। ট্রাস্ট কর্তৃক পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের উপর করারোপ আইনতগতভাবে সাংঘর্ষিক হয়। করারোপের ক্ষেত্রে ভিন্ন আইনে বিশ্ববিদ্যালয় গঠন ও পরিচালনার নজির উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ, ব্রিটেনের কনভেনটি ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়ার টোরেন্স ইউনিভার্সিটি লাভজনক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচালিত হয়। যার মাধ্যমে সরকার রাজস্ব আদায় করে অন্য খাতে বিনিয়োগ করে। ফিলিপাইন ও চীনে লাভজনক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মাঝে জনপ্রিয়। ভারতেও এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০-এর নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন এনে লাভজনক ও অলাভজনক উভয় পদ্ধতির বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অনুমোদন বিবেচনা করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বর্তমানে উদ্ভূত পরিস্থিতি ও আইনি জটিলতা পরিহার করা সম্ভব।

জনপ্রিয় সংবাদ

সোনারগাঁয়ে অবৈধ গ্যাস ব্যবহার করায় গুড়িয়ে দেয়া হয় দু’টি প্রতিষ্ঠান, একটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা

১৫ শতাংশ কর পরিশোধ নিয়ে উদ্বেগে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়

আপডেট সময় : ০৬:৫৬:৪৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ মার্চ ২০২৪

🟠আইন সংশোধন করে ‘লাভজনক’ প্রতিষ্ঠানেরও সুবিধা চান মালিকরা

🟠বর্তমান পদ্ধতিতে কর দিলে অনেক বিশ^বিদ্যালয় বন্ধের আশঙ্কা

🟠 জটিলতা নিরসনে রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ কামনা

🟠প্রয়োজনে রিভিউ পিটিশনের প্রস্তুতি

আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী ১৫ শতাংশ হারে আয়কর প্রদান নিয়ে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় পড়েছে দেশের বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলো। ট্রাস্টের আওতায় অলাভজনক হিসেবে পরিচালিত এ বিশ^বিদ্যালয়গুলোর কর দেওয়ার বিষয়টি বিশ^বিদ্যালয় আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। উদ্ভূত পরিস্থিতি আইনে সংশোধন এনে লাভজনক ও অলাভজনকÑদুই পদ্ধতিই চালুর দাবি জানিয়েছেন বিশ^বিদ্যাালয় মালিকরা। অন্যথায় বিদ্যমান আইনে কর দিতে গেলে বিশ^বিদ্যালয়গুলো চরম বিপাকে পড়বে এবং অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধের আশঙ্কা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এ জটিলতা নিরসনে হস্তক্ষেপ চেয়ে এরই মধ্যে বিশ^বিদ্যালয়গুলোর আচার্য ও রাষ্ট্রপতির কাছে লিখিত আবেদন করেছে মালিকদের সংগঠন-বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় সমিতি। এখন রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের পাশাপাশি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন মালিকরা। প্রয়োজনে রিভিউ পিটিশন করারও প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।

সূত্রমতে, দেশের সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে ১৫ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হবে বলে রায় দেন আপিল বিভাগ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকারের ১৫ শতাংশ হারে আয়কর আদায় সংক্রান্ত আপিল নিষ্পত্তি করে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বোরহান উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ এ আদেশ দেন।

এ আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ^বিদ্যালয়গুলোর সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে ‘বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় সমিতির’ সচিব বেলাল আহমেদ গতকাল সবুজ বাংলাকে বলেন, আদেশ অনুযায়ী কর প্রদান নিয়ে আমরা খুব দুশ্চিন্তায় আছি। আমরা ভ্যাট দিতে রাজি তবে সেটার জন্য আইনের পরিবর্তন দরকার। কারণ আইন অনুযায়ী বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। ট্রাস্টের মাধ্যমে এগুলো পরিচালিত হয়। কর দিতে হলে আইনে পরিবর্তন এনে অলাভজনকের পাশাপাশি লাভজনক অপশন রাখা দরকার। এতে যারা লাভজনক হবে তারা কর দিবে আর যারা ট্রাস্টের আওতায় থাকবে তাদের কর দেয়া লাগবে না। অন্যথায় অলাভজনক হয়েও কর দেয়া বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলোর পক্ষে সম্ভব হবে না। এতে অনেক বিশ^বিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে। বিদেশের বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলো লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবেই পরিচালিত হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।

আপিল বিভাগের সর্বশেষ রায়ের আগে ২০০৭ সালের ২৮ জুন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন অনুমোদিত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং অপরাপর বিশ্ববিদ্যালয় যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়, তাদের উদ্ভূত আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে আয়কর পুনর্নির্ধারণ করা হলো। ১ জুলাই থেকে এটা কার্যকর হবে।’

২০১০ সালের ১ জুলাই এনবিআরের আরেক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ, বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বা শুধু তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষাদানে নিয়োজিত বেসরকারি কলেজের উদ্ভূত আয়ের ওপর প্রদেয় আয়করের হার হ্রাস করে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হলো।’ এরপর বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ৪৬টি রিট করা হয়েছিল।

২০২১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকারের ১৫ শতাংশ হারে আয়কর আদায়ের দুই প্রজ্ঞাপন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি (লিভ টু আপিল) দেন আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে এ আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এ আয়কর আদায় থেকে বিরত থাকতে এনবিআরকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

২০২৩ সালের জুন মাসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকারের ১৫ শতাংশ হারে আয়কর আদায় সংক্রান্ত আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আয়কর আদায় থেকে বিরত থাকতে আপিল বিভাগের আদেশ বহাল রাখা হয়। একইসঙ্গে আয়কর আদায় নিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে দায়ের করা ৪৬টি রিট হাইকোর্টে চূড়ান্ত শুনানির আদেশ বহাল রাখা হয়।

এদিকে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি বরাবার পাঠানো বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় সমিতির আবেদনে বলা হয়, অতি সম্প্রতি অলাভজনক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর ১৫ শতাংশ হারে আয়কর প্রদান সংক্রান্ত ২০২১ সালে করা রিট আপিলের নিষ্পত্তি ঘোষণা করা হয়েছে। যার ফলে অলাভজনক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ আয়কর প্রদানের আওতাভুক্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে এবং এ খাতে ব্যাপক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে।
আবেদনে সমিতির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ (ধারা-১৫) অনুযায়ী ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ অলাভজনক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে। উক্ত আইনের ৪৪(৭) ধারা অনুযায়ী ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলের অর্থ উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় ব্যয় ব্যতীত অন্য কোনো উদ্দেশে ব্যয় করা যাইবে না’ মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। এমতাবস্থায়, আয়কর প্রদানের নির্দেশনা বিশ্ববিদ্যালয়কে উভয় সংকটে ফেলবে। কেননা, প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলের কোনোরূপ অর্থ উদ্যোক্তা-প্রতিষ্ঠাতাগণ যেমন গ্রহণ করতে পারেন না, তেমনি আয়কর হিসেবে প্রদান করা বা অন্যভাবে ব্যয় করার বিষয়টিও সরাসরি আইনের লঙ্ঘন হিসেবেই প্রতীয়মান।

তিনি বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ কোনোরূপ সরকারি অনুদান ব্যতিরেকে কেবলমাত্র শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি এবং সংকটকালীন সময় ট্রাস্টি উদ্যোক্তাগণের কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলে অর্থ সংকটের কারণে নিজস্ব ক্যাম্পাস ভবনের জন্য অখন্ড জমি ক্রয়, ক্যাম্পাস নির্মাণ করা অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এমনিতেই ক্যাম্পাস নির্মাণ সামগ্রীসহ শিক্ষা সামগ্রী, ল্যাবের যন্ত্রপাতি ইত্যাদি ক্রয়ের উপর সরকারি ভ্যাট/ট্যাক্স প্রদান করতে হয়। উপরন্ত আয়কর আরোপ করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক উন্নয়ন কাজ বিঘ্নিত তথা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা হ্রাসসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ সংকটের আশংকা রয়েছে। সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা-ট্রাস্টিগণ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বেন।

শেখ কবির হোসেন বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০’-এর আওতায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের নির্দেশনা মোতাবেক ট্রাস্ট গঠনের মাধ্যমে সব ধরনের বিধিবিধান মেনে পরিচালিত। এক্ষেত্রে ট্রাস্ট আইনে পরিচালিত সব প্রতিষ্ঠানই করের আওতামুক্ত। ট্রাস্ট কর্তৃক পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের উপর করারোপ আইনতগতভাবে সাংঘর্ষিক হয়। করারোপের ক্ষেত্রে ভিন্ন আইনে বিশ্ববিদ্যালয় গঠন ও পরিচালনার নজির উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ, ব্রিটেনের কনভেনটি ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়ার টোরেন্স ইউনিভার্সিটি লাভজনক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচালিত হয়। যার মাধ্যমে সরকার রাজস্ব আদায় করে অন্য খাতে বিনিয়োগ করে। ফিলিপাইন ও চীনে লাভজনক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মাঝে জনপ্রিয়। ভারতেও এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০-এর নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন এনে লাভজনক ও অলাভজনক উভয় পদ্ধতির বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অনুমোদন বিবেচনা করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বর্তমানে উদ্ভূত পরিস্থিতি ও আইনি জটিলতা পরিহার করা সম্ভব।