আমরা উৎপাদনমুখী হলে খাদ্যে কোনো দিন অভাব হবে না: প্রধানমন্ত্রী
- ‘বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি কমলেও বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি এখনও ৯ শতাংশের ওপরে
- সরকারের চেষ্টা মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ৬.৫ শতাংশে রাখা
মাসের পর মাস ধরে চলছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। গত দুই বছর ধরে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। জীবনযাত্রার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই বেড়েছে খরচ। চড়া মূল্যস্ফীতিতে কষ্টে আছেন নিম্নআয়ের মানুষ। মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়েছে অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে। যে কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট আলোচনায়ও ঘুরে ফিরে বারবার আসছে মূল্যস্ফীতির কথা। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সুদের হার, রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধিসহ নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট দিয়েছেন
অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। দেশে অর্থনীতির ক্রান্তিকালে প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট সামাল দেওয়া অর্থমন্ত্রীর জন্য বড্ড চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।তারা বলেন, রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও চাপে পড়বে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। বাকি দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা আসবে ঋণ থেকে। এছাড়া বাজেটে ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে মূল্যস্ফীতি রাখার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাকে চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। তিনি বলেন, ‘সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ রাখা, বিশেষ করে খাদ্যমূল্য, সেখানে উৎপাদন এবং সরবরাহ বৃদ্ধি করতে হবে। বৃষ্টির কারণে যেমন আলুর বীজ নষ্ট হয়ে গেছে, তো এই রকম অনেক কিছু আছে। আমরা উৎপাদনমুখী
হলে খাদ্যে কোনো দিন অভাব হবে না।’
গতকাল শুক্রবার তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ছয় দফা দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় বাজেট নিয়ে নিজের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এদিকে ৬ জুন বৃহস্পতিবার নিজের প্রথম বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বাজেটের অন্যতম অগ্রাধিকার। আগামী অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। সামষ্টিক অর্থনীতির প্রধান দুই নীতি- মুদ্রা ও রাজস্ব নীতির আওতায় যুগপৎ কার্যক্রমের মাধ্যমে এটি সম্ভব
হবে বলে আশা করছেন তিনি।
দেশে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি যে এখনো নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি সেটি অকপটেই স্বীকার করেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি কমে আসার সাম্প্রতিক প্রবণতা সত্ত্বেও বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি এখনো ৯ শতাংশের ওপরেই রয়েছে।
মূল্যস্ফীতি কী কারণে বেশি- তার কিছু ব্যাখ্যাও দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বলেছেন, ২০২২ সালের জুলাই থেকে চলতি অর্থবছরের মে মাস পর্যন্ত ইউএস ডলারের বিপরীতে টাকারপ্রায় ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ অবচিতি ঘটেছে। যার ফলে আমদানি করা পণ্যের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ছে। আর আমদানিজনিত মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির ওপর।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কী করা হচ্ছে সে প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, এরই মধ্যে অন্যান্য দেশের নেওয়া পদক্ষেপের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশেও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে সুদের হার উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো হয়েছে। নীতি সুদহার ৮ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। নীতি সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা স্ট্যান্ডিং ল্যান্ডি ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) ১০ শতাংশে ও নিম্নসীমা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) ৭ শতাংশে উন্নীত করে পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে।
আবুল হাসান মাহমুদ আলী জানান, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির আওতায় নেওয়া পদক্ষপেগুলোর সাফল্য নিশ্চিত করার জন্য এর পাশাপাশি রাজস্ব নীতিতেও সহায়ক নীতি-কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দিতে ফ্যামিলি কার্ড, ওএমএস ইত্যাদি কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। এসব নীতি- কৌশলের ফলেই ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশা করছেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, অপ্রয়োজনীয় আমদানি ব্যয় কমানোর পাশাপাশি ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এর ফলে আগামীতে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে। এতে আগামীতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল হবে। স্থিতিশীলতা আসবে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারেও। এটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতির আওতায় যুগপভাবে নেওয়া কার্যক্রমকে সাফল্যমন্ডিত করতে সহায়ক হবে। এদিকে আওয়ামী লীগের এবারের নির্বাচনী ইশতেহারের কথা স্মরণ করে অর্থমন্ত্রী
বলেন, নির্বাচনী ইশতেহারে যে ১১টি বিষয়ে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে, তার একটি হচ্ছে দ্রব্যমূল্য সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
বাজেট বক্তৃতার উপসংহারেও অর্থমন্ত্রী বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কৃচ্ছসাধন কর্মসূচি সীমিত পরিসরে চালু রাখা হলেও উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ হতে নিম্নআয়েরমানুষের সুরক্ষা প্রদান কার্যক্রমের পরিধি বাড়ানো হবে। তিনি জানান, যেসব বিষয়ে প্রাধিকার দিয়ে এবারের বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে তার একটি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। গতকাল প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্ব পরিস্থিতি মাথায় রেখে আমাদের পরিকল্পনা নিয়ে চলতে হবে। আমাদের দেশে যারা হচ্ছে… কিছু ভালো লাগে না। তাদের ভালো না লাগাই থাক, কান দেয়ার দরকার নাই।’
মানুষের চাহিদা পূরণের ভাবনা থেকেই এই বাজেট দেওয়া হয়েছে জানিয়ে শেখ হাসি- না বলেন, ‘অনেকে বসে বসে হিসাব কষে, আগে এত পার্সেন্ট বেড়েছে, এবার কম পার্সেন্ট বাড়ল কেন?’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘সীমিতভাবে, খুব সংরক্ষিতভাবেই আমরা এগোতে চাই। যেটা আমাদের দেশের মানুষের কষ্ট না হয়, মানুষের যে চাহিদাটা সেটা যেন পূরণ করতে পারি, সে দিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা বাজেট করেছি।’
তিনি বলেন, ‘পারিবারিক কার্ড আমরা দিচ্ছি। কারণ, এখন মূল্যস্ফীতি বেশি। সব থেকে অবাক কাণ্ড, আমাদের উৎপাদন বেড়েছে! চাল উৎপাদনই আমরা চার গুণ বাড়িয়েছি। প্রত্যেকটা জিনিসের আমরা উৎপাদন বাড়িয়েছি। মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা বেড়েছে, মানুষের খাদ্যগ্রহণের পরিমাণও বেড়েছে। এখন আর দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতে হয় না। কমপক্ষে দুইবেলা খাবার তো পাচ্ছে মানুষ। সেখানে গ্রহণটাও বেড়েছে, চাহিদাটাও বেড়েছে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদনও বাড়িয়েছি।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘যেহেতু মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, নিম্নআয়ের মানুষ যারা, সীমিত
আয়ের মানুষ যারা, তাদের জন্য আমরা পারিবারিক কার্ড করে দিয়েছি। যারা
একেবারে হতদরিদ্র, তাদের তো একেবারে বিনা পয়সায় খাবার দিচ্ছি। আর সামাজিক নিরাপত্তা তো বিনা পয়সায় দিয়ে যাচ্ছি।’
বাজেটে এবার মৌলিক চাহিদাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা ৬ জুন বৃহস্পতিবার বাজেট দিয়েছি। বিএনপির আমলে সবশেষ বাজেট মাত্র ৬২ হাজার কোটি টাকার বাজেট ছিল। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিয়েছিল ৬৮ হাজার কোটি টাকা। সেখানে আমরা ৭ লাখ ৯৮ হাজার কোটি টাকা বাজেট প্রস্তাব করেছি। এই বাজেটে এবার কতগুলো মৌলিক চাহিদা… মানুষের মৌলিক যে অধিকার, সেটাকে নিশ্চিত করার জন্য যেমন- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, তারপর দেশীয় শিল্প, সেগুলো এবং সামাজিক নিরাপত্তা, এইগুলোকে সব থেকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যা মানুষের জীবনটাকে উন্নত করবে, নিশ্চয়তা দেবে।’ তিনি বলেন, ‘তার কারণ হচ্ছে- আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম, কোভিড ১৯-এর অতিমারি দেখা দিয়েছে। এই অতিমারির ফলে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা হয়েছে, আমরাও সেই মন্দায় পড়ে গেলাম। সারা বিশ্বে প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়ে গেল। এরপর আসল ইউক্রেন- রাশিয়ার যুদ্ধ, এরপর স্যাংশন, পাল্টা-স্যাংশন, স্যাংশনের ফলে প্রত্যেকটা জিনিসেরদাম বৃদ্ধি পেয়েছে।’ সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমাদের মানুষকে খাওয়াতে হবে আগে। আমাদের রিজার্ভ কত আছে না আছে, সেটার চেয়ে বেশি দরকার, আমার দেশের মানুষের চাহিদাটা পূরণ করা। সে দিকে লক্ষ্য রেখে আমরা পানির মতো টাকা খরচ করেছি। বাংলাদেশএকমাত্র দেশ, যেটা কোনো উন্নত দেশ করে নাই যে বিনা পয়সায় কোভিড ১৯-এর ভ্যাকসিন দিয়েছি, বিনা পয়সায় টেস্ট করিয়েছি। সেটা করেছি কেন? মানুষ বাঁচাতে। চিকিৎসা বিনা পয়সায়, যে ডাক্তার চিকিৎসা করেছে তাদের প্রতিদিন আলাদা ভাতা দিতে হতো, তারা যে চিকিৎসা দিচ্ছে- এভাবে পানির মতো টাকা খরচ হয়েছে। তারপর যখন দাম বেড়েছে, তখন ২০০ ডলারের গম ৬০০ ডলার করেও আমি কিনে নিয়ে এসেছি।’ তিনি বলেন, ‘ঠিক সেইভাবে তেল, ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে, উন্নত দেশগুলোও হিমশিম খাচ্ছে। তারপরেও আমরা যে এবার বাজেট দিতে পারলাম।’ প্রসঙ্গত, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতাতেও মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্যের কথা জানানো হয়। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমার কোনো লক্ষণ নেই। তাই শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে।
কিন্তু গত মে মাস পর্যন্ত গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার অনেক বেশি। এমন প্রেক্ষাপটে আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে রাখা খুব কঠিন বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

























