০৬:৫০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

‘বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্হায় পাশ্চাত্যের আঁচড় ও আমার কিছু কথা’

 

ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনামলে এই বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের এক অকল্পনীয় সূচনা হয়েছিল। এই কোম্পানী একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে, এ অঞ্চলের লোকদের শিক্ষিত করার তেমন কোনো প্রয়োজন অনূভব করেনি বললেই চলে। যতটুকু শিক্ষার প্রসার কিংবা প্রচার করেছে, ইতিহাসের আলোকে বলা যায় তা নিজেদের স্বার্থ’কে রক্ষার তাগিদেই করেছে। শিক্ষার প্রসারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আগ্রহ না থাকলেও ব্রিটিশ হিতবাদী,রাজনীতিবীদ, শিক্ষানুরাগী ও খ্রিস্টধর্ম প্রচারকের চাপের মুখে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলায় সুপরিকল্পিত শিক্ষা সম্প্রসারের মূল দু’টি উদ্দেশ্য ছিলো— এক. সাম্রাজ্যবাদী শাসনের সমর্থনপুষ্ট একটি বিশেষ মধ্যবিত্ত অভিজাত শ্রেণী তৈরী করা। দুই. স্হানীয়দের মাঝে খ্রিস্টধর্মের ব্যপক প্রসার ঘটানো।

(১২০৪-১৭৫৭) এ অঞ্চলের একমাত্র অধিপতি ছিলো মুসলিম শাসকরা, যারা জ্ঞানার্জন’কে ইসমালী বিধান মোতাবেক পরকালীন পূণ্যের কাজ এবং মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ মনে করতো।ফলে মুসলিম শাসনের সূচনালগ্ন থেকেই তারা জ্ঞানার্জনের প্রতি রাষ্টীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছিলো। এ অঞ্চলে আধুনিক শিক্ষার ন্যায় তিন স্তরের শিক্ষাব্যবস্হা ছিলো — এক. প্রাথমিক শিক্ষা। দুই. মাধ্যমিক শিক্ষা। তিন. উচ্চ শিক্ষা। এসকল শিক্ষাব্যবস্হা মসজিদ এবং মন্দির কেন্দ্রিক গড়ে উঠে ছিলো। মুসলমানদের জন্য মাদ্রাসা এবং হিন্দুদের জন্য ছিলো পাঠশালা। উক্ত শিক্ষাব্যবস্হার প্রধান শিক্ষা ছিলো নৈতিকতা ও স্ব স্ব ধর্মের প্রতি গুরুত্বারোপ করা। ইতিহাসের আলোকে আমরা এই মর্মে জানতে পারি যে কোম্পানীর সাম্রাজ্যবাদী শাসনের দ্বারা এদেশীয় শিক্ষাব্যবস্হা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়।

কোম্পানী ১৬৯৮ সালে সনদ আইনের মাধ্যমে খ্রিস্টান পাদ্রিদের দ্বারা খ্রিস্টধর্ম প্রচারের সুবিধার্থে বাংলায় আনুষ্ঠানিকভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষার সূচনা করে। এজন্য এ অঞ্চলের বড় বড় শহরে মিশনারীদের নেতৃত্বে মিশনারী স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় যেমন— ’Society of Promoting christian knowledge ’ এর আওতায় ১৭৩১ সালে প্রথম ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। যেখানে তৎকালীন ছাত্র-ছাত্রীদের বিনামূল্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং খ্রিস্টধর্মের প্রচার করা হতো। নিজেদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য তৎকালীন কোম্পানীর শাসক ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৮১ সালে কলিকাতা মাদ্রাসা, উইলিয়াম জোনস ১৭৮৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি, জোনাথান ডানকান ১৭৯১ সালে বেনারসে সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

ব্রিটেনের শিল্প বিপ্লবের পর শ্রমিকেরা মারাত্মকভাবে শিক্ষাহীনতায় ভুগছিলেন, যার ফলে তৈরী হয় সভ্যতাগত সংকট, জ্ঞানের প্রকৃত আলো না থাকায় ভিন্ন-ভিন্ন শ্রেণীতে বিভাজিত হয়ে অধিকারের সাবলীল কণ্ঠ ধারণ করা ছিলো অলীক সপ্নের মতো। চাইলেই তারা প্রথাগত রীতি-নীতির বাইরে যেতে পারতো না। পরিশেষে তাদেরকে শিক্ষির করার জন্যে কিছু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে যেমন—Sunday School Union( ১৮০৩), Royal Lancastrian Institution(১৮০৮) ইত্যাদি।

এসময় সংস্কারবাদী Samuel Whitbread ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্ন কক্ষে (House Of Commons) ৭-১৪ বছরের শিশুদের বিনা শিক্ষা প্রদানের জন্য স্কুল স্হাপনের প্রস্তাব করেন ১৮০৭ সালে তবে তা উচ্চ কক্ষে বাদ পড়ে যায়। এক্ষেত্রে বলা যায় সমসাময়িক অনেক ব্যক্তিই এমন প্রস্তাব দিয়ে ছিলেন নিম্ন কক্ষ থেকে উচ্চ কক্ষে তবে তাদের সব প্রস্তাব বাতিল হলেও প্রস্তাবের প্রায় ২০ বছর পর Cort of Directors’দের এই অঞ্চলের লোকদের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করাকে দায়িত্ব মনে করেন নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য।

 

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্হার দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই —কীভাবে বাংলাদেশের শিক্ষা’কে প্রগতিশীলতার মোড়কে লক্ষ্য-লক্ষ্য বেকার তৈরী করছে করা হয়েছে , মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্হাকেও আমরা দেখি পাশ্চাত্য করণ নীতির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নানা বিতর্কিত বিষয়গুলো দিয়ে সমাজে তৈরী করা হচ্ছে মতানৈক্য এবং ইসলাম বিদ্বেষী ছাত্র-ছাত্রী সমাজ। বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ কেন উদ্যোগক্তা হতে আগ্রহী নয় ;এর উত্তর কী হতে পারে?পাগলের জট-পাকানো চুলের মতো এই যে আমাদের জট পাকানো শিক্ষাব্যবস্থা, এর পেছনের কারণ খতিয়ে দেখারও প্রয়োজন আছে। ক্ষমতাসীনদের কেন এই জট খোলার ব্যাপারে কোন আগ্রহ থাকে না, বরং জট আরো বেশী করে পাকান? জাতি শিক্ষা-দীক্ষায় দূর্বল হলে একচ্ছত্র ক্ষমতালোভী ক্ষমতাসীনদের যে লাভ হয়, সেটা একটা প্রমাণিত সত্য।

এটা বোঝার জন্য একজন রকেট সায়েন্টিস্ট হওয়ার প্রয়োজন নেই। বিলাতে ১৯৮৮ সালে সংবিধিবদ্ধ জাতীয় কারিকুলাম চালু করা হয়। এর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো, সব শিক্ষার্থীর জন্য একই পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা, যাতে করে শিক্ষাকালীণ সময়ে কোন ধরনের বৈষম্য কিংবা অসামঞ্জস্যতা না থাকে। জাতীয় পাঠ্যক্রমটি শিক্ষার্থীদের মূল জ্ঞানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় যা তাদের শিক্ষিত নাগরিক হওয়ার জন্য অপরিহার্য। এর লক্ষ্য হলো, কঠোরভাবে শিক্ষার উচ্চমানকে বাস্তবিক রুপ দান করা। বাস্তব দুনিয়া আর স্কুলে যা শেখানো হয় তার মধ্যে একটা যোগাযোগ স্থাপন করা। সর্বোপরি, এটা নিশ্চিত করা যে, সমস্ত শিশুকে মূল বিষয়গুলির বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান হাতে-কলমে শেখানো হচ্ছে।

শুধুমাত্র পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও ব্যবস্থার আদলে শিক্ষাকে সাজাতে গেলে আমরা তামাশার বস্তুতে রূপান্তরিত হবো; হবো নব্য উপিনিবেশবাদের নয়া পুতুল। দেশীয় ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির যোগসাজশ না থাকলে শুধু পাশ্চাত্যের শিক্ষার আধুনিক মোড়কে নিজেদের সঁপে দিলে আমাদের অন্তর্নিহিত শক্তি কখনো জাগ্রত হবে না। শির উঁচু করে নিজের দেশকে বহির্বিশ্বে তুলে ধরতে ব্যর্থ হবো। চাপানো কিছু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘সৃষ্টির আনন্দে জীবন’ দান করতে পারে না, ঠিক যেমন পারে না ‘মনের মধ্যে ঘা’ দিতে।১৮৩৫ সালের মেকেলের মিনিটের মতো কেরানি বানানোর কেরামতি দেখানো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাজ নয়।

আমদানি-নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা ও নীতি দিয়ে আমরা বেশিদূর এগোতে পারব না। নিজেদের ভূমি, মানুষ ও সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত শক্তি ও দাবিকে সামনে রেখেই সাজাতে হবে শিক্ষার রূপকল্প, যা প্রথমে নিজস্ব দেশজ বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় এবং সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বকেও যাতে ধরে ফেলতে পারে ক্রমান্বয়ে। এজন্য নিজস্ব ভাষায় বিদ্যা দান, বই রচনা এবং এর পাঠ ও পঠন জরুরি। নিজস্ব ভাষায় বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানের উৎকর্ষ হয় ফল্গুধারার মতো—তা মাথায় না রাখলে জাতি বেশি দূর এগোতে পারবে না।১৮৭৪ সালে জার্মান দার্শনিক কান্ট ‘এনলাইটমেন্ট’ বা আলোকায়নের কথা বলেন। সেই সূত্র ধরে কিছু বলতে গেলে বলতে হবে, শিক্ষা নিজের আত্মাকে জাগায় পরাধীনতার শিকল ভাঙার গল্প বলে বলে। নিজেদের উন্নত মানুষ, জাতি ও রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্যই সবার কল্যাণে শিক্ষার বিস্তার করতে হবে এবং টেকসই ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। তাহলে কামিয়াব হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে।

 

-ইতাঙ্গীর খন্দকার

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

জনপ্রিয় সংবাদ

প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত, সম্ভাব্য তারিখ ৯ জানুয়ারি

‘বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্হায় পাশ্চাত্যের আঁচড় ও আমার কিছু কথা’

আপডেট সময় : ০৯:২৪:৫২ অপরাহ্ন, বুধবার, ৬ নভেম্বর ২০২৪

 

ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনামলে এই বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের এক অকল্পনীয় সূচনা হয়েছিল। এই কোম্পানী একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে, এ অঞ্চলের লোকদের শিক্ষিত করার তেমন কোনো প্রয়োজন অনূভব করেনি বললেই চলে। যতটুকু শিক্ষার প্রসার কিংবা প্রচার করেছে, ইতিহাসের আলোকে বলা যায় তা নিজেদের স্বার্থ’কে রক্ষার তাগিদেই করেছে। শিক্ষার প্রসারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আগ্রহ না থাকলেও ব্রিটিশ হিতবাদী,রাজনীতিবীদ, শিক্ষানুরাগী ও খ্রিস্টধর্ম প্রচারকের চাপের মুখে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলায় সুপরিকল্পিত শিক্ষা সম্প্রসারের মূল দু’টি উদ্দেশ্য ছিলো— এক. সাম্রাজ্যবাদী শাসনের সমর্থনপুষ্ট একটি বিশেষ মধ্যবিত্ত অভিজাত শ্রেণী তৈরী করা। দুই. স্হানীয়দের মাঝে খ্রিস্টধর্মের ব্যপক প্রসার ঘটানো।

(১২০৪-১৭৫৭) এ অঞ্চলের একমাত্র অধিপতি ছিলো মুসলিম শাসকরা, যারা জ্ঞানার্জন’কে ইসমালী বিধান মোতাবেক পরকালীন পূণ্যের কাজ এবং মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ মনে করতো।ফলে মুসলিম শাসনের সূচনালগ্ন থেকেই তারা জ্ঞানার্জনের প্রতি রাষ্টীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছিলো। এ অঞ্চলে আধুনিক শিক্ষার ন্যায় তিন স্তরের শিক্ষাব্যবস্হা ছিলো — এক. প্রাথমিক শিক্ষা। দুই. মাধ্যমিক শিক্ষা। তিন. উচ্চ শিক্ষা। এসকল শিক্ষাব্যবস্হা মসজিদ এবং মন্দির কেন্দ্রিক গড়ে উঠে ছিলো। মুসলমানদের জন্য মাদ্রাসা এবং হিন্দুদের জন্য ছিলো পাঠশালা। উক্ত শিক্ষাব্যবস্হার প্রধান শিক্ষা ছিলো নৈতিকতা ও স্ব স্ব ধর্মের প্রতি গুরুত্বারোপ করা। ইতিহাসের আলোকে আমরা এই মর্মে জানতে পারি যে কোম্পানীর সাম্রাজ্যবাদী শাসনের দ্বারা এদেশীয় শিক্ষাব্যবস্হা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়।

কোম্পানী ১৬৯৮ সালে সনদ আইনের মাধ্যমে খ্রিস্টান পাদ্রিদের দ্বারা খ্রিস্টধর্ম প্রচারের সুবিধার্থে বাংলায় আনুষ্ঠানিকভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষার সূচনা করে। এজন্য এ অঞ্চলের বড় বড় শহরে মিশনারীদের নেতৃত্বে মিশনারী স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় যেমন— ’Society of Promoting christian knowledge ’ এর আওতায় ১৭৩১ সালে প্রথম ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। যেখানে তৎকালীন ছাত্র-ছাত্রীদের বিনামূল্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং খ্রিস্টধর্মের প্রচার করা হতো। নিজেদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য তৎকালীন কোম্পানীর শাসক ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৮১ সালে কলিকাতা মাদ্রাসা, উইলিয়াম জোনস ১৭৮৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি, জোনাথান ডানকান ১৭৯১ সালে বেনারসে সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

ব্রিটেনের শিল্প বিপ্লবের পর শ্রমিকেরা মারাত্মকভাবে শিক্ষাহীনতায় ভুগছিলেন, যার ফলে তৈরী হয় সভ্যতাগত সংকট, জ্ঞানের প্রকৃত আলো না থাকায় ভিন্ন-ভিন্ন শ্রেণীতে বিভাজিত হয়ে অধিকারের সাবলীল কণ্ঠ ধারণ করা ছিলো অলীক সপ্নের মতো। চাইলেই তারা প্রথাগত রীতি-নীতির বাইরে যেতে পারতো না। পরিশেষে তাদেরকে শিক্ষির করার জন্যে কিছু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে যেমন—Sunday School Union( ১৮০৩), Royal Lancastrian Institution(১৮০৮) ইত্যাদি।

এসময় সংস্কারবাদী Samuel Whitbread ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্ন কক্ষে (House Of Commons) ৭-১৪ বছরের শিশুদের বিনা শিক্ষা প্রদানের জন্য স্কুল স্হাপনের প্রস্তাব করেন ১৮০৭ সালে তবে তা উচ্চ কক্ষে বাদ পড়ে যায়। এক্ষেত্রে বলা যায় সমসাময়িক অনেক ব্যক্তিই এমন প্রস্তাব দিয়ে ছিলেন নিম্ন কক্ষ থেকে উচ্চ কক্ষে তবে তাদের সব প্রস্তাব বাতিল হলেও প্রস্তাবের প্রায় ২০ বছর পর Cort of Directors’দের এই অঞ্চলের লোকদের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করাকে দায়িত্ব মনে করেন নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য।

 

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্হার দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই —কীভাবে বাংলাদেশের শিক্ষা’কে প্রগতিশীলতার মোড়কে লক্ষ্য-লক্ষ্য বেকার তৈরী করছে করা হয়েছে , মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্হাকেও আমরা দেখি পাশ্চাত্য করণ নীতির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নানা বিতর্কিত বিষয়গুলো দিয়ে সমাজে তৈরী করা হচ্ছে মতানৈক্য এবং ইসলাম বিদ্বেষী ছাত্র-ছাত্রী সমাজ। বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ কেন উদ্যোগক্তা হতে আগ্রহী নয় ;এর উত্তর কী হতে পারে?পাগলের জট-পাকানো চুলের মতো এই যে আমাদের জট পাকানো শিক্ষাব্যবস্থা, এর পেছনের কারণ খতিয়ে দেখারও প্রয়োজন আছে। ক্ষমতাসীনদের কেন এই জট খোলার ব্যাপারে কোন আগ্রহ থাকে না, বরং জট আরো বেশী করে পাকান? জাতি শিক্ষা-দীক্ষায় দূর্বল হলে একচ্ছত্র ক্ষমতালোভী ক্ষমতাসীনদের যে লাভ হয়, সেটা একটা প্রমাণিত সত্য।

এটা বোঝার জন্য একজন রকেট সায়েন্টিস্ট হওয়ার প্রয়োজন নেই। বিলাতে ১৯৮৮ সালে সংবিধিবদ্ধ জাতীয় কারিকুলাম চালু করা হয়। এর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো, সব শিক্ষার্থীর জন্য একই পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা, যাতে করে শিক্ষাকালীণ সময়ে কোন ধরনের বৈষম্য কিংবা অসামঞ্জস্যতা না থাকে। জাতীয় পাঠ্যক্রমটি শিক্ষার্থীদের মূল জ্ঞানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় যা তাদের শিক্ষিত নাগরিক হওয়ার জন্য অপরিহার্য। এর লক্ষ্য হলো, কঠোরভাবে শিক্ষার উচ্চমানকে বাস্তবিক রুপ দান করা। বাস্তব দুনিয়া আর স্কুলে যা শেখানো হয় তার মধ্যে একটা যোগাযোগ স্থাপন করা। সর্বোপরি, এটা নিশ্চিত করা যে, সমস্ত শিশুকে মূল বিষয়গুলির বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান হাতে-কলমে শেখানো হচ্ছে।

শুধুমাত্র পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও ব্যবস্থার আদলে শিক্ষাকে সাজাতে গেলে আমরা তামাশার বস্তুতে রূপান্তরিত হবো; হবো নব্য উপিনিবেশবাদের নয়া পুতুল। দেশীয় ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির যোগসাজশ না থাকলে শুধু পাশ্চাত্যের শিক্ষার আধুনিক মোড়কে নিজেদের সঁপে দিলে আমাদের অন্তর্নিহিত শক্তি কখনো জাগ্রত হবে না। শির উঁচু করে নিজের দেশকে বহির্বিশ্বে তুলে ধরতে ব্যর্থ হবো। চাপানো কিছু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘সৃষ্টির আনন্দে জীবন’ দান করতে পারে না, ঠিক যেমন পারে না ‘মনের মধ্যে ঘা’ দিতে।১৮৩৫ সালের মেকেলের মিনিটের মতো কেরানি বানানোর কেরামতি দেখানো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাজ নয়।

আমদানি-নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা ও নীতি দিয়ে আমরা বেশিদূর এগোতে পারব না। নিজেদের ভূমি, মানুষ ও সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত শক্তি ও দাবিকে সামনে রেখেই সাজাতে হবে শিক্ষার রূপকল্প, যা প্রথমে নিজস্ব দেশজ বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় এবং সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বকেও যাতে ধরে ফেলতে পারে ক্রমান্বয়ে। এজন্য নিজস্ব ভাষায় বিদ্যা দান, বই রচনা এবং এর পাঠ ও পঠন জরুরি। নিজস্ব ভাষায় বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানের উৎকর্ষ হয় ফল্গুধারার মতো—তা মাথায় না রাখলে জাতি বেশি দূর এগোতে পারবে না।১৮৭৪ সালে জার্মান দার্শনিক কান্ট ‘এনলাইটমেন্ট’ বা আলোকায়নের কথা বলেন। সেই সূত্র ধরে কিছু বলতে গেলে বলতে হবে, শিক্ষা নিজের আত্মাকে জাগায় পরাধীনতার শিকল ভাঙার গল্প বলে বলে। নিজেদের উন্নত মানুষ, জাতি ও রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্যই সবার কল্যাণে শিক্ষার বিস্তার করতে হবে এবং টেকসই ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। তাহলে কামিয়াব হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে।

 

-ইতাঙ্গীর খন্দকার

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়