- ফের বাড়ছে মেয়াদ, সঙ্গে বাড়ছে প্রকল্পের ব্যয়
- ২০৩৯ কোটি থেকে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫৯৭ কোটি টাকা
- প্রকল্প নিয়ে ত্রুটিপূর্ণ দূরদৃষ্টির অভিযোগ
‘বাস্তবে এ প্রকল্পে থেকে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। বরং ভোগান্তি বাড়াবে এ প্রকল্প। এ কারণে বিআরটি প্রকল্পে অর্থ ব্যয় করা মানে আত্মহত্যার শামিল। জনগণের অর্থ গচ্চা যাবে’-শামসুল হক, অধ্যাপক, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বুয়েট
‘প্রকল্পটির নকশায় ক্রটি আছে। যদি এসব সমস্যা সমাধান না করে আরও অর্থ বিনিয়োগ না করা হয়, তাহলে ইতোমধ্যে বিনিয়োগ করা অর্থগুলো নষ্ট হবে’-ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, পরিকল্পনা উপদেষ্টা
গাজীপুরকে ঢাকা বিমানবন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত করতে দীর্ঘদিন আগে শুরু হওয়া ও ব্যাপক সমালোচিত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পটির ব্যয় ও আরও চার বছর মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে প্রকল্পটির কার্যকারিতা ও সুফল নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এদিকে ১৩ বছর আগে নেওয়া এই প্রকল্পের ব্যয় পঁচিশ গুণের বেশি বাড়ানো হয়েছে। ২ হাজার ৩৯.৮৪ কোটি টাকাইয় নেওয়া প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৫৯৭.৩২ কোটি টাকা। তবে ত্রুটিপূর্ণ নকশায় গৃহীত প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলেও ঢাকা শহরের চিরচেনা যানজট কতটা কমবে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সংশয় রয়েছে। এর মধ্যেই প্রকল্প ব্যয় ও মেয়াদ নতুন করে বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস্তবে এ প্রকল্পে থেকে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। বরং ভোগান্তি বাড়াবে এ প্রকল্প। এ কারণে বিআরটি প্রকল্পে অর্থ ব্যয় করা মানে আত্মহত্যার শামিল। জনগণের অর্থ গচ্চা যাবে। সংশি¬ষ্টরা বলছেন, যদি এসব সমস্যা সমাধান না করে আরও অর্থ বিনিয়োগ না করা হয়, তাহলে ইতোমধ্যে বিনিয়োগ করা অর্থগুলো নষ্ট হবে।
জানা গেছে, সম্প্রতি সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর থেকে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। প্রস্তাবটি অনুমোদন পেলে এটা হবে চতুর্থ সংশোধনী। ২০১২ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের ব্যয় প্রথমে ধরা হয়েছিলো ২ হাজার ৩৯.৮৪ কোটি টাকা। চতুর্থ সংশোধনী প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৫৯৭.৩২ কোটি টাকা। ফলে প্রস্তাবটি অনুমোদন পেলে মূল প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে ব্যয় বাড়বে ২২৩ শতাংশ। এদিকে পাঁচবার মেয়াদ বাড়ানোর পর গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়। নতুন প্রস্তাবে প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত এই সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হলে প্রকল্পটির বাস্তবায়নে লাগছে মোট ১৭ বছর।
এদিকে, এ প্রকল্পের লক্ষ্য হলো গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ২০.৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) ব্যবস্থা নির্মাণের মাধ্যমে গাজীপুর-টঙ্গী এলাকার নগর জীবনমান উন্নত করা। পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত এ প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৮১০.৬২ কোটি টাকা এবং প্রকল্পে ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৭৭.৪৮ শতাংশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কাজ করছে চারটি সংস্থা: ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি (ঢাকা বিআরটি পিএলসি), সড়ক ও জনপথ বিভাগ (আরএইচডি), বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি)। বাংলাদেশের বিআরটি প্রকল্পের চতুর্থ সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (৪র্থ আরডিপিপি) অনুযায়ী, ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড অংশে ব্যয় বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি মোট ১৯৬৭.৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাস ডিপো সম্প্রসারণ, বিমানবন্দর টার্মিনাল নির্মাণ, অফিস সংস্কার এবং ট্রাফিক সিগনাল স্থাপনে প্রয়োজন ৩৩.১৬ কোটি টাকা। অপারেশন চালু ও রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রমে ভায়াবিলিটি গ্যাপ পূরণে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ২৬৯ কোটি টাকা। এছাড়া বিআরটি বাস, দুটি ট্রাক ও অন্যান্য যানবাহন ক্রয়ে প্রয়োজন ৯৮৪ কোটি টাকা।
এদিকে, ২০২৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত রক্ষণাবেক্ষণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, টোল প¬াজা স্থাপন, সরঞ্জাম মেরামত ও পুনঃস্থাপনসহ সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অংশে ১৬ কি.মি. সড়কের উন্নয়নের জন্য ব্যয় বৃদ্ধি প্রস্তাব করা হয়েছে ২২৮ কোটি টাকা। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের অংশে আরও ১৩৩.৬৭ কোটি ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। যার মধ্যে প্রধান ব্যয় হচ্ছে ভেরিয়েশন অর্ডার অনুসারে ৪.৫ কিমি উঁচু সড়ক নির্মাণের জন্য। প্রকল্পের সময়কাল ৬০ মাস বাড়ায় প্রশাসনিক খরচও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ কোটি টাকার বেশি। তবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল যে অংশটি বাস্তবায়ন করছে, তার ব্যয় বাড়বেনা। এদিকে, গত জানুয়ারিতে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প তদারকি সংস্থা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) প্রকল্পটি পরিদর্শন করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে উলে¬খ করা হয়, বিআরটি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলেও এতে জনগণের ভোগান্তি কমবে না। শুধু বিশেষায়িত লেনে যান চলাচলের বিশেষ সুবিধা দিতে গিয়ে এই শিল্প করিডোরে অন্যান্য লেনে যানজট বাড়বে। সেই সঙ্গে বাড়বে ভোগান্তি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, লেনটি শুধু বিআরটির বিশেষায়িত বাস চলাচলের জন্য নির্মিত। বর্তমানে ওই বিশেষায়িত লেন দিয়ে অন্যান্য গাড়ি চলাচল করছে। লেনটিতে শুধু বিআরটির গাড়ি চলাচল শুরু হলে অন্যান্য লেনে যানজট বাড়বে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, বাস্তবে এ প্রকল্পে থেকে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। বরং ভোগান্তি বাড়াবে এ প্রকল্প। এ কারণে বিআরটি প্রকল্পে অর্থ ব্যয় করা মানে আত্মহত্যার শামিল। জনগণের অর্থ গচ্চা যাবে। এ প্রকল্পের ব্যয় ৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী বিআরটি প্রকল্প সাধারণত কম খরচে, দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য এবং সহজতর গণপরিবহন হিসেবে বিবেচিত হয়। সেখানে বাংলাদেশের এ প্রকল্পে এমআরটি (মেট্রো রেল) প্রকল্পের মতোই খরচ হচ্ছে, অথচ কার্যকারিতা কিছুই নেই। প্রকল্পটি একটি চাপানো প্রকল্প’ ছিল, যেখানে কোনো পেশাদারিত্বের ছাপ পাওয়া যায় না। প্রকল্পের যে অংশগুলো এখন সংযোজন করা হচ্ছে, সেগুলো যদি শুরুতেই বিবেচনায় আনা হতো, তাহলে এ প্রকল্পকে ফিজিবল বা বাস্তবসম্মত ঘোষণা করা সম্ভব হতো না।
এ বিষয়ে ঢাকা বিআরটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল আমিন খান বলেন, প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশের কাজ শেষ হয়েছে। সংশোধিত প্রকল্প অনুমোদন পেলে ৬ মাসের মধ্যে বাকি কাজও শেষ হবে। এছাড়া বিআরটি কর্তৃপক্ষের অংশে বাস কেনার কাজ বাকি রয়েছে। ইতোমধ্যে ১৩৭টি বাস কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। আরো ৫০টি ইলেকট্রিক বাস কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ত্রুটিপূর্ণ ও অকার্যকর বলে ব্যাপকভাবে সমালোচিত এ প্রকল্পে সরকারি তহবিল থেকে আরও ব্যয় কেন দরকার- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এর কোনো উত্তর আমার কাছে নেই।
এ বিষয়ে সম্প্রতি পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ প্রকল্পটির ‘ক্রটিপূর্ণ নকশার’ কথা স্বীকার করে করে বলেন, যদি এসব সমস্যা সমাধান না করে আরও অর্থ বিনিয়োগ না করা হয়, তাহলে ইতোমধ্যে বিনিয়োগ করা অর্থগুলো নষ্ট হবে।






















