- চিকিৎসকের পরামর্শ অমান্য করেই কেনা হয় ওষুধ
- সব ধরনের ওষুধই অব্যবহৃত থেকে ডাস্টবিনে
- গবেষণা ও নীতিমালার অভাবে সমস্যা বাড়লেও প্রতিকারের ব্যবস্থা নেই
‘দেশে নানা বিষয়ে গবেষণা হয়, অথচ ওষুধের অপচয়ের ওপর কোনো জাতীয় পর্যায়ের গবেষণা নেই। এটা খুবই দুঃখজনক’- অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মাসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
‘ফার্মেসি মালিকরা ওষুধ ফেরত নিতে রাজি থাকলেও উৎপাদকরা তা ফেরত নেন না। ফলে মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে সেই ওষুধ আর কোথাও ব্যবহার হয় না। এতে শুধু ওষুধ নয়, অর্থ ও সম্পদেরও অপচয় হচ্ছে’- আব্দুল হাই, সাবেক সিনিয়র সভাপতি, বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতি
মানুষের জীবনে সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে ওষুধ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু দেশে এই জরুরি পণ্যটি এখন ব্যাপকভাবে অপচয় হচ্ছে। আর এই অপচয়ের মূল কারণ—অসচেতনতা। দেশের প্রতিটি পরিবারেই কমবেশি ওষুধ কিনে সেগুলো ব্যবহার না করেই ফেলে দেওয়া হয়, যার কারণে নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার মূল্যবান ওষুধ। চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, জনস্বাস্থ্যের জন্যও এক ভয়ংকর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে নানা বিষয়ে গবেষণা হয়, অথচ ওষুধের অপচয়ের ওপর কোনো জাতীয় পর্যায়ের গবেষণা নেই। এটাকে খুবই দুঃখজনক বলছেন তারা। এদিকে, সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফার্মেসি মালিকরা ওষুধ ফেরত নিতে রাজি থাকলেও উৎপাদকরা তা ফেরত নেন না। ফলে মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে সেই ওষুধ আর কোথাও ব্যবহার হয় না। এতে শুধু ওষুধ নয়, অর্থ ও সম্পদেরও অপচয় হচ্ছে।
জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় ময়লার ভাগাড়ে পরে থাকে অব্যবহৃত বিভিন্ন ওষুধ। আম্নূষ ব্যবহার শেষে বাড়তি ওষুধ ফেলে দেন সেখানে। এতে অপচয় হচ্ছে অনেক ওষুধ। আবার চিকিৎসকের পরামর্শ বছাড়াই ওষুধ না কেনার ফলেও নোষ্ট হচ্ছে অনেক ওষুধ, মিরপুর ২ নম্বর এলাকার বাসিন্দা সজীব আহমেদ বলেন, আমার পরিবারে মা-বাবা ও বোন মিলে আমরা ৪ জন। প্রায়ই কারো না কারো অসুস্থতা দেখা দেয়। তখন ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে আনি। কিন্তু অধিকাংশ সময় ওষুধ পুরোটা খাওয়া হয় না। ফলে অনেক ওষুধ অব্যবহৃত থেকে যায়, পরে সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়। গত ৬ মাসেই প্রায় দুই হাজার টাকার ওষুধ জমে গেছে আমাদের বাসায়। তিনি আরও জানান, প্রাথমিক সমস্যা যেমন জ্বর, অ্যাসিডিটি বা হালকা পেট খারাপ হলে নিজেরাই ওষুধ কিনে আনেন। কয়েকটি ট্যাবলেট খেয়েই যদি সমস্যা সেরে যায়, তখন বাকিগুলো আর খাওয়া হয় না। একসময় ওষুধের মোড়ক নষ্ট হয়ে যায়, তাই পরবর্তীতে দরকার হলেও সেগুলো খাওয়া হয় না।
এদিকে কোর্স অসম্পূর্ণ রাখাই অপচয়ের বড় কারণ বলছেন অনেকে। তারা বলছেন, অনেকেই ওষুধ কেনার পর কিছুদিন খেলেই সুস্থতা অনুভব করলে সেই ওষুধের আর কোর্স শেষ করেন না। এতে অপচয় হয় অনেক ওষুধ। যাত্রাবাড়ীর ধোলাইপার এলাকার অনিক মৃধা বলেন, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ কিনলেও অনেক সময়ই কোর্স শেষ করা হয় না। চিকিৎসক যদি ৭ দিনের কোর্স দেন, রোগী ৫ দিনেই সুস্থ হলে বাকি ওষুধ আর খেতে চান না। এভাবেই ওষুধ জমে যায়। একই সমস্যার কথা বলে হাসান আলী নামের একজন জানান, তার তিনটি ছোট শিশু সন্তান। তিনি বলেন, ছোটদের জন্য সবচেয়ে বেশি সিরাপ কেনা হয়, আর সেগুলোরই অর্ধেক পরে নষ্ট হয়। একবার খোলার পর সিরাপ আর বেশিদিন ভালো থাকে না।
এদিকে, সিরাপ ছাড়াও ইনজেকশন, ক্যাপসুল, ট্যাবলেটসহ অন্যান্য ওষুধও অনেক সময় ভুলে যাওয়ার কারণে খাওয়া হয় না। কিছু ওষুধ সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করায় তাদের কার্যকারিতাও হারিয়ে ফেলে। এদিকে, ফার্মেসিগুলোর সীমাবদ্ধতা ও উৎপাদকদের দায়িত্বহীনতাও কারণ এই অপচয়ের পেছনে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাড়তি ওষুধ ফেরত নেওয়া হয়না। মোহাম্মদপুরের বসিলার ‘মদিনা ফার্মেসি’র মালিক সোলাইমান মিয়া বলেন, আমরা সাধারণত গ্যাস্ট্রিক বা প্যারাসিটামলের মতো ওষুধ ফেরত নেই না। তবে কার্ডিয়াক বা ক্যান্সারের মতো দামি ওষুধ ফেরত নেওয়া হয় না, কারণ বিক্রি কম।
তবে সিরাপ বা ইঞ্জেকশনের মতো তরল ওষুধ ফেরত নেওয়া একেবারেই অসম্ভব বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বোতলের ক্যাপ একবার খোলার পরই কার্যকারিতা কমে যায়। আর বেশিরভাগ মানুষই ঠিকমতো সংরক্ষণ করেন না, তাই মোড়ক নষ্ট হয়, ফেরত নেওয়ার উপায় থাকে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল ফার্মাসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগের এক অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দেশে নানা বিষয়ে গবেষণা হয়, অথচ ওষুধের অপচয়ের ওপর কোনো জাতীয় পর্যায়ের গবেষণা নেই। এটা খুবই দুঃখজনক। চিকিৎসক যখন ৭ দিনের জন্য ওষুধ দেন, তখন সেটি পুরোটা খেতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ৩-৪ দিন খেলেই অনেকে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেন। এতে শরীরের ভেতরে জীবাণু প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়, আর বাকি ওষুধও নষ্ট হয়। তিনি আরও সতর্ক করে বলেন, আপাতত আমরা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকায় অনেক ওষুধ পেটেন্ট ছাড়াই কম দামে পাই। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশের কাতারে গেলে সেই সুযোগ থাকবে না। তখন ওষুধের দাম বহুগুণ বেড়ে যাবে। এখনই সচেতন না হলে ভবিষ্যতে ভোগান্তি বাড়বে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ওষুধ অপচয় ঠেকাতে আমাদের হাতে কোনো আইন নেই। তাই বাধ্যবাধকতাও নেই। মানুষ নিজের ঘরে বসেই অপচয় করছে, আমরা সেখানে আইন প্রয়োগ করতে পারি না। আমরা বিভিন্ন সময় সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম করি, যেখানে সাধারণ মানুষকে ওষুধ ব্যবহারে সচেতন করা হয়। কিন্তু মানুষ যদি নিজেরা সচেতন না হয়, তবে সমস্যা সমাধান হবে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সাবেক সিনিয়র সভাপতি আব্দুল হাই বলেন, ফার্মেসি মালিকরা ওষুধ ফেরত নিতে রাজি থাকলেও উৎপাদকরা তা ফেরত নেন না। ফলে মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে সেই ওষুধ আর কোথাও ব্যবহার হয় না। এতে শুধু ওষুধ নয়, অর্থ ও সম্পদেরও অপচয় হচ্ছে।























