০৪:৩২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ৯ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সুদের ফাঁদে স্থবির রপ্তানি সহায়তা প্রাক্-অর্থায়ন তহবিল (ইএফপিএ)

ঋণ তহবিলে অচল অবস্থায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা

মোট অর্থের প্রায় ৬৫ শতাংশই ব্যবহার হচ্ছে না

ব্যাংকগুলো তহবিলকে ব্যবহার করছে নিজেদের সুবিধায়

বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর মনিটরিং না থাকার অভিযোগ

ব্যাংকগুলোর সুদ-স্বার্থ রক্ষার কৌশলে স্থবির হয়ে পড়েছে রপ্তানি খাতের জন্য গঠিত ১০ হাজার কোটি টাকার রপ্তানি সহায়ক প্রাক্-অর্থায়ন তহবিল (ইএফপিএ)। ২০২৩ সালের শুরুতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে রপ্তানিকারকদের সহায়তার জন্য এই তহবিল তৈরি করেছিল। কিন্তু দুই বছর না পেরোতেই এর সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে পড়ে আছে অচল অবস্থায়। বিশ্লেষকদের মতে, এর পেছনে দুটি বাস্তব কারণ কাজ করছে এক, ব্যাংকগুলো উচ্চ সুদের ঋণে লাভ বেশি পায়; দুই, তহবিল বিতরণে কোনো বাধ্যবাধকতা বা জরিমানা না থাকায় তারা নির্লজ্জভাবে অলস রাখছে। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এই তহবিল রপ্তানিকারকদের জন্য লাইফলাইন হওয়ার কথা ছিল। অথচ ব্যাংকগুলো এটাকে নিজেদের সুবিধার খাতায় ফেলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর মনিটরিং না থাকলে এভাবে সরকারি প্রণোদনা মাঠে নামবে না।
ইডিএফ সংকুচিত হওয়ার পর ইএফপিএকে বিকল্প হিসেবে দেখা হলেও ব্যাংকগুলো এতে অংশ নিতে অনাগ্রহী। তারা নিজেদের তহবিল থেকে ১৪.১৫ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই তহবিল থেকে মাত্র ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া সম্ভব। ফলে ঘোষিত সরকারি প্রণোদনা বাস্তবে উদ্যোক্তাদের নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, তহবিলের মোট অর্থের মধ্যে প্রায় ৬৫ শতাংশই এখন ব্যাংকগুলো ব্যবহার করছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলেও ব্যাংকগুলো সেই টাকা রপ্তানিকারকদের দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তারা টাকা নিজেদের কাছে ধরে রেখেছে, বিতরণ করছে না। একজন রপ্তানিকারক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ব্যাংকগুলো আমাদের বলে, ইএফপিএ ঋণ এখন বন্ধ; কিন্তু একই ব্যাংক পরদিন তাদের নিজেদের তহবিলের ঋণ অফার করে ১৫ শতাংশ সুদে। এটা নিছক ব্যবসায়িক স্বার্থ নয়, এটা পলিসির অপব্যবহার। অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম মনে করেন, এটা অর্থনীতির একধরনের ‘নীরব ব্লকেজ’। ব্যাংকগুলো জানে, তারা চাইলেও না দিলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা নেবে না। ফলে এই অর্থ কার্যত একধরনের সুদ-অপচয় চক্রে ঘুরছে।
অন্যদিকে ব্যাংক খাতে এখন তারল্যের কোনো সংকট নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে প্রায় ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ অর্থের ঘাটতি নয়, বরং প্রণোদনা তহবিল ব্যবহার না করার পেছনে আছে সুদ-স্বার্থের মানসিকতা। তবে ব্যাংকারদের একাংশ বলছেন, তহবিলের শর্ত জটিল এবং ফেরত দেওয়ার সময়সীমা কম। এ কারণে তাঁরা ঝুঁকি নিতে চান না। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি ব্যাংকগুলোর সুবিধাবাদী ব্যাখ্যা। কারণ, ইএফপিএ ঋণের ঝুঁকি অনেকটাই বাংলাদেশ ব্যাংক বহন করে; তবু তারা দিতে চায় না। এদিকে, গত ৫ অক্টোবর সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম প্রণোদনা কিস্তি হিসেবে এক হাজার কোটি টাকা ছাড় করেছে। দেশের রপ্তানি খাতকে আরো বহুমুখী করতে এই প্রণোদনা দিয়েছে সরকার। এই প্রণোদনা শুধু তৈরি পোশাক খাতই নয়, বরং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য, হালাল মাংস, হালকা প্রকৌশল এবং বহুমুখী পাটজাত পণ্যের মতো অপ্রচলিত খাত সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা পাচ্ছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই প্রণোদনার মূল লক্ষ্য রপ্তানির ক্ষেত্রকে বহুমুখী করা এবং তৈরি পোশাক খাতের ওপর থেকে নির্ভরতা কমানো। অর্থ বিভাগ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছিল, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটের অধীনে ‘ভর্তুকি ও প্রণোদনা ব্যবস্থাপনা (সাধারণ রপ্তানি প্রণোদনা)’ খাত থেকে বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে এই অর্থ ছাড় করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এই অর্থের মাধ্যমে দেশীয় শিল্প, হিমায়িত চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ, চামড়াজাত দ্রব্যসহ অনুমোদিত অন্যান্য রপ্তানি খাতে নগদ সহায়তা এবং তৈরি পোশাক রপ্তানির বিপরীতে ১ শতাংশ বিশেষ নগদ সহায়তা প্রদান করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, রপ্তানি সহায়তার এই সস্তা ঋণের অর্থ যদি অলস পড়ে থাকে, তাহলে তহবিল গঠনের লক্ষ্যই ব্যর্থ হবে। এতে শুধু রপ্তানিকারকেরাই নয়, পুরো দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কোনো ব্যাংক যদি ইচ্ছাকৃতভাবে এই তহবিলের ঋণ বিতরণে গড়িমসি করে এবং পরিবর্তে নিজেদের উচ্চ সুদের ঋণ চাপিয়ে দেয়, তবে ব্যবসায়ীরা যেন সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ জানান। আমরা তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেব। ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী রেজা ইফতেখার বলেন, ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল থেকে ঋণ দেওয়া স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে রপ্তানির বিশেষ তহবিল থেকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে না, এমন তথ্য আমার কাছে নেই।

জনপ্রিয় সংবাদ

একনেক সভায় ৪৬ হাজার ৪১৯ কোটি টাকার ২২ প্রকল্প অনুমোদন

সুদের ফাঁদে স্থবির রপ্তানি সহায়তা প্রাক্-অর্থায়ন তহবিল (ইএফপিএ)

আপডেট সময় : ০৭:১১:৪৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৫

ঋণ তহবিলে অচল অবস্থায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা

মোট অর্থের প্রায় ৬৫ শতাংশই ব্যবহার হচ্ছে না

ব্যাংকগুলো তহবিলকে ব্যবহার করছে নিজেদের সুবিধায়

বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর মনিটরিং না থাকার অভিযোগ

ব্যাংকগুলোর সুদ-স্বার্থ রক্ষার কৌশলে স্থবির হয়ে পড়েছে রপ্তানি খাতের জন্য গঠিত ১০ হাজার কোটি টাকার রপ্তানি সহায়ক প্রাক্-অর্থায়ন তহবিল (ইএফপিএ)। ২০২৩ সালের শুরুতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে রপ্তানিকারকদের সহায়তার জন্য এই তহবিল তৈরি করেছিল। কিন্তু দুই বছর না পেরোতেই এর সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে পড়ে আছে অচল অবস্থায়। বিশ্লেষকদের মতে, এর পেছনে দুটি বাস্তব কারণ কাজ করছে এক, ব্যাংকগুলো উচ্চ সুদের ঋণে লাভ বেশি পায়; দুই, তহবিল বিতরণে কোনো বাধ্যবাধকতা বা জরিমানা না থাকায় তারা নির্লজ্জভাবে অলস রাখছে। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এই তহবিল রপ্তানিকারকদের জন্য লাইফলাইন হওয়ার কথা ছিল। অথচ ব্যাংকগুলো এটাকে নিজেদের সুবিধার খাতায় ফেলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর মনিটরিং না থাকলে এভাবে সরকারি প্রণোদনা মাঠে নামবে না।
ইডিএফ সংকুচিত হওয়ার পর ইএফপিএকে বিকল্প হিসেবে দেখা হলেও ব্যাংকগুলো এতে অংশ নিতে অনাগ্রহী। তারা নিজেদের তহবিল থেকে ১৪.১৫ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই তহবিল থেকে মাত্র ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া সম্ভব। ফলে ঘোষিত সরকারি প্রণোদনা বাস্তবে উদ্যোক্তাদের নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, তহবিলের মোট অর্থের মধ্যে প্রায় ৬৫ শতাংশই এখন ব্যাংকগুলো ব্যবহার করছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলেও ব্যাংকগুলো সেই টাকা রপ্তানিকারকদের দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তারা টাকা নিজেদের কাছে ধরে রেখেছে, বিতরণ করছে না। একজন রপ্তানিকারক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ব্যাংকগুলো আমাদের বলে, ইএফপিএ ঋণ এখন বন্ধ; কিন্তু একই ব্যাংক পরদিন তাদের নিজেদের তহবিলের ঋণ অফার করে ১৫ শতাংশ সুদে। এটা নিছক ব্যবসায়িক স্বার্থ নয়, এটা পলিসির অপব্যবহার। অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম মনে করেন, এটা অর্থনীতির একধরনের ‘নীরব ব্লকেজ’। ব্যাংকগুলো জানে, তারা চাইলেও না দিলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা নেবে না। ফলে এই অর্থ কার্যত একধরনের সুদ-অপচয় চক্রে ঘুরছে।
অন্যদিকে ব্যাংক খাতে এখন তারল্যের কোনো সংকট নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে প্রায় ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ অর্থের ঘাটতি নয়, বরং প্রণোদনা তহবিল ব্যবহার না করার পেছনে আছে সুদ-স্বার্থের মানসিকতা। তবে ব্যাংকারদের একাংশ বলছেন, তহবিলের শর্ত জটিল এবং ফেরত দেওয়ার সময়সীমা কম। এ কারণে তাঁরা ঝুঁকি নিতে চান না। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি ব্যাংকগুলোর সুবিধাবাদী ব্যাখ্যা। কারণ, ইএফপিএ ঋণের ঝুঁকি অনেকটাই বাংলাদেশ ব্যাংক বহন করে; তবু তারা দিতে চায় না। এদিকে, গত ৫ অক্টোবর সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম প্রণোদনা কিস্তি হিসেবে এক হাজার কোটি টাকা ছাড় করেছে। দেশের রপ্তানি খাতকে আরো বহুমুখী করতে এই প্রণোদনা দিয়েছে সরকার। এই প্রণোদনা শুধু তৈরি পোশাক খাতই নয়, বরং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য, হালাল মাংস, হালকা প্রকৌশল এবং বহুমুখী পাটজাত পণ্যের মতো অপ্রচলিত খাত সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা পাচ্ছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই প্রণোদনার মূল লক্ষ্য রপ্তানির ক্ষেত্রকে বহুমুখী করা এবং তৈরি পোশাক খাতের ওপর থেকে নির্ভরতা কমানো। অর্থ বিভাগ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছিল, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটের অধীনে ‘ভর্তুকি ও প্রণোদনা ব্যবস্থাপনা (সাধারণ রপ্তানি প্রণোদনা)’ খাত থেকে বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে এই অর্থ ছাড় করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এই অর্থের মাধ্যমে দেশীয় শিল্প, হিমায়িত চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ, চামড়াজাত দ্রব্যসহ অনুমোদিত অন্যান্য রপ্তানি খাতে নগদ সহায়তা এবং তৈরি পোশাক রপ্তানির বিপরীতে ১ শতাংশ বিশেষ নগদ সহায়তা প্রদান করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, রপ্তানি সহায়তার এই সস্তা ঋণের অর্থ যদি অলস পড়ে থাকে, তাহলে তহবিল গঠনের লক্ষ্যই ব্যর্থ হবে। এতে শুধু রপ্তানিকারকেরাই নয়, পুরো দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কোনো ব্যাংক যদি ইচ্ছাকৃতভাবে এই তহবিলের ঋণ বিতরণে গড়িমসি করে এবং পরিবর্তে নিজেদের উচ্চ সুদের ঋণ চাপিয়ে দেয়, তবে ব্যবসায়ীরা যেন সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ জানান। আমরা তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেব। ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী রেজা ইফতেখার বলেন, ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল থেকে ঋণ দেওয়া স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে রপ্তানির বিশেষ তহবিল থেকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে না, এমন তথ্য আমার কাছে নেই।