- রাখাইনে ত্রিমুখী লড়াই
- শঙ্কিত সীমান্তবাসী
- ধরে নিয়ে যাওয়া জেলেদের কী হবে
- সীমান্তে সতর্কতা বজায় রাখা হয়েছে
মায়ানমার সীমান্তের ওপারে সংঘাতের কারণে বাংলাদেশের সীমান্তজুড়ে উদ্বেগ, আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। গুলি, মর্টার শেলিং ও সংঘাতের কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা রীতিমতো মৃত্যু আতঙ্কে থাকেন। তা ছাড়া মাইন বিস্ফোরণের ভয় এখন সবার মাঝেই। এর ফলে সীমান্তের মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। টেকনাফের নাফ নদী আর বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা থেকে জানা গেছে এসব তথ্য। নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমের ধানখেতের চাষি আর গ্রামবাসী এখন সংঘর্ষের শব্দের মধ্যেই ঘুমাতে যান। আর তাতেই আতঙ্কিত জীবন-জীবিকা। অন্যদিকে গুলির শব্দ বেড়ে গেলেই নাফ নদীর জেলেরা তড়িঘড়ি করে তাদের নৌকা পাড়ে ভিড়িয়ে রাখেন। আর ধরে নিয়ে যাওয়ার ভয়তো লেগেই আছে।
শঙ্কিত সীমান্তবাসী : তুমব্রু সীমান্তের কৃষক ওসমান গণি বলেন, এখন প্রতি রাতেই গুলির শব্দ শুনি। অন্ধকার নামলে বিজিবি ভেতরে থাকে। আমরা শুধু প্রার্থনা করি যেন কোনো বিপথগামী গুলি আমাদের খুঁজে না পায়। যদিও প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো পয়েন্ট দিয়ে গুলি এসে পড়ার খবর আসছে। বিচ্ছিন্নভাবে এসব গুলি আসার কারণে বেশির ভাগ মানুষ আতঙ্কে রয়েছেন। নাইক্ষ্যংছড়ির ফুলতলা সীমান্তের বাসিন্দা আতাউর রহমান বলেন, প্রতিদিনই গুলির শব্দ ভেসে আসছে। গুলিও বিভিন্ন সময় আসছে। তাতেই আতঙ্ক বাড়ছে। তবে মায়ানমারে বর্তমানে সক্রিয় তিনটি সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে যে সংঘর্ষ চলছে সেখানে কোনো ভারী অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে। আর তা থেকেই এই শব্দের উৎপত্তি। আবার কেউ কেউ বলছেন, এটি সীমান্তের কাছে আরাকান আর্মির পুঁতে রাখা স্থলমাইনের বিস্ফোরণও হতে পারে বলে এলাকাবাসীর ধারণা।
ধরে নিয়ে যাওয়া জেলেদের কী হবে : আরাকান কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে গত ১৮ জুলাই পর্যন্ত প্রায় ১৮৮ জন বাংলাদেশি জেলে ও ৩০টি নৌকা আটক করে পরবর্তী সময়ে মুক্তি দেওয়া হয়। তবে নতুন করে ধরে নেওয়া শতাধিক জেলেকে এখনো ফেরত দেয়নি বিদ্রোহী আরাকান আর্মি। শাহপরীর দ্বীপ ইউনিয়নের আব্দুস সালাম বলেন, সোমবারও স্থানীয় জেলেদের কাছ থেকে শুনেছি, জালিয়াপাড়ার আব্দুর রহমানের মালিকানাধীন নৌকাসহ চার জেলেকে আরাকান আর্মি আটক করেছে। বিষয়টি আমরা প্রশাসনকে জানিয়েছি। তিনি আরও বলেন, নাফ নদীর জেলেরা এখন সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে। চর জেগে ওঠায় সীমান্তে ঘেঁষে আসতে গিয়ে আরাকান আর্মির সদস্যরা এসে জেলেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মায়ানমারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল আরাকান নেটওয়ার্ক জানায়, আরাকান আর্মি দাবি করেছে, অবৈধভাবে আরাকানের জলসীমায় প্রবেশ করে মাছ ধরার অভিযোগে জেলেদের আটক করা হয়েছে। পরে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের আইনি প্রক্রিয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
রাখাইনে ত্রিমুখী লড়াই : মায়ানমারের অভ্যন্তরে বিশেষ করে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি এবং কক্সবাজারের ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষের কারণে প্রতিনিয়ত গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলাকে মায়ানমারের রাখাইন বা আরাকান থেকে বিভক্তকারী সীমান্তটি ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছে। নতুন-পুরোনো মিলিয়ে বর্তমানে রাখাইনে চারটি রোহিঙ্গা সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী রয়েছে। এগুলো হলো আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), ইসলামী মাহাজ ও আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি (এআরএ)। তার মধ্যে জান্তা বাহিনীর পাশাপাশি আরসা-আরএসওর সঙ্গেও লড়াইয়ে জড়িয়েছে মায়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ)। এদের মধ্যে আরাকান আর্মি হলো রাখাইনভিত্তিক মিলিশিয়া বাহিনী। যারা ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। চব্বিশের শেষের দিকে রাখাইনের নিয়ন্ত্রণও নিয়ে নেয় তারা। তারপর বাংলাদেশ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে নতুন করে কয়েকটি ঘাঁটিও করেছে, যা এপার থেকে স্পষ্ট। যদিও বর্তমানে জান্তা ও রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর পাল্টা আক্রমণের শিকার হচ্ছে এএ।
রোহিঙ্গা সশস্ত্র বিদ্রোহীরা যে কারণে যুদ্ধে : আরএসও সিনিয়র কমান্ডার মাস্টার রফিক খবরের কাগজকে বলেন, রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে প্রতারণা করেছে আরাকান আর্মি। রাখাইনে নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলে আমাদের জাতির সব সদস্য ভিটেমাটি ফিরে পাবে বলে আমরা তাদের পক্ষেও ছিলাম, সহযোগিতাও করেছি। কিন্তু যখন রাখাইনে তারা এল তখন ভোল পাল্টে তারাও জান্তার মতো রোহিঙ্গা জাতির ওপর নির্যাতন শুরু করল। তাই এখন আমাদের লড়াই তাদের সঙ্গে। যতদিন রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী তাদের অধিকার মর্যাদা নিয়ে আরাকানে ফিরবে না, ততদিন আরএসওর লড়াই অব্যাহত থাকবে বলে জানান এই কমান্ডার। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরসার মুজাহিদ ফোর্সের কমান্ডার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের যোদ্ধা সমগ্র আরাকানে ছড়িয়ে পড়েছে। আমি নিজেও আছি আরাকানের পাহাড় চান্দা এলাকায়। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক সীমান্ত পিলার ৫০-৫২-এর কাছে। যেখানে আরাকান আর্মির সঙ্গে কিছুদিন আগেও লড়াই হয়েছে। এখনো আমাদের সম্মুখযোদ্ধারা সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। কৌশলগত নানা দিক বিবেচনা করে আরাকানে আমরা রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে তাদের ভিটেমাটিতে ফেরানোর লড়াই করছি। অধিকার আর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই করছি। জীবন বাজি রেখেই আরসার প্রত্যেক যোদ্ধা জিহাদ করেছেন। এ লড়াই অধিকার ও মর্যাদার। যতদিন মিলবে না ততদিন চলবে।
সীমান্তে কঠোর বিজিবি : গত শনিবার বিকেলে মায়ানমার সীমান্তসংলগ্ন নাফ নদীতে আরাকান আর্মির সঙ্গে সশস্ত্র রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের সংঘর্ষ হয়। সে সময় টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের তেচ্ছিব্রিজ এলাকায় সীমান্তের ওপার থেকে ছোড়া গুলি এসে স্থানীয় একটি কম্পিউটারের দোকানে পড়লে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। একই সময়ে ওই এলাকার ছেনুয়ারা বেগম নামের এক নারী বাড়ির উঠানে হাঁটাহাঁটি করার সময় পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। স্থানীয়রা আহত ছেনুয়ারাকে উদ্ধার করে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন। তা ছাড়া গত সোমবার বিকেলেও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের বিপরীতে এক ঘণ্টার ব্যবধানে দুটি শক্তিশালী বিস্ফোরণের শব্দে সীমান্তজুড়ে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) রামু সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, সীমান্তের স্থানীয় বাসিন্দারা দুপুর ও বিকেলে মায়ানমারের অভ্যন্তর থেকে ভেসে আসা দুটি বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেয়েছেন বলে জানা গেছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সীমান্তে কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি বা প্রভাব পড়ার খবর পাওয়া যায়নি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে, তবে সীমান্তে সতর্কতা বজায় রাখা হয়েছে।






















