১২:২২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সীমান্তে দাপট বাড়াচ্ছে আরাকান আর্মি

  • ঝুঁকিতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও সীমান্তবাসী
  • বাংলাদেশি ল্যান্ডমাইনে আহত অন্তত ৬৫ জন
  • ২০২৪ সালে দুই রোহিঙ্গা নিহত
  • ২০২৩ সালে পাঁচজন মাইন বিস্ফোরণে আহত
  • চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে অপহৃত ২৩৫ জেলে

সীমান্তে নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলা এবং যেকোনো উসকানিমূলক ঘটনা এড়াতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া উচিত-মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম, নিরাপত্তা বিশ্লেষক

 

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় আরকান আর্মির দাপট ক্রমেই বাড়ছে। মিয়ানমারের দুই বাহিনীর সংঘাতের প্রভাব ফেলছে সীমান্তে। এতে করে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। আরাকান আর্মির পুঁতে রাখা ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে আহত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) এক সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। পাহাড়ি এলাকার এই সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও বেসামরিক নাগরিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে, এই ঘটনাই তার সর্বশেষ উদাহরণ। নিহত নায়েক মো. আখতার হোসেন (৩৫) কক্সবাজারের ৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নে কর্মরত ছিলেন। গত ১২ অক্টোবর বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে টহল দেওয়ার সময় শূন্যরেখার কাছে মাইন বিস্ফোরণে তার ডান পা উড়ে যায়। প্রথমে রামু সেনানিবাস হাসপাতাল এবং পরে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেয়া হলে গত শুক্রবার তিনি মারা যান।
বিজিবি কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছরের ডিসেম্বরে মিয়ানমারের সীমান্ত থেকে দেশটির সরকারি বাহিনীর সদস্যরা সরে যাওয়ার পর বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) নিয়ন্ত্রণ নেয়। এরপর থেকেই তারা সীমান্তজুড়ে এমনকি নো-ম্যানস ল্যান্ডের কিছু অংশেও মাইন পুঁতে রাখে বলে জানা গেছে। এদিকে, নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং মিয়ানমারের সিতওয়েতে নিযুক্ত সাবেক কনসাল জেনারেল মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘সীমান্তে নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলা এবং যেকোনো উসকানিমূলক ঘটনা এড়াতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া উচিত। আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে মোকাবিলা করতে কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেই সীমান্তজুড়ে নির্বিচারে ল্যান্ডমাইন স্থাপন করেছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষায় বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় মাইন অপসারণ অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন।’
বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের শুরু থেকে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘাত শুরুর পর এ পর্যন্ত অন্তত ৬৫ জন বাংলাদেশি ল্যান্ডমাইনে আহত হয়েছেন। এ ছাড়া ২০২৪ সালে দুজন রোহিঙ্গা নিহত ও ২০২৩ সালে তাদের পাঁচজন মাইন বিস্ফোরণে আহত হন। বিজিবির রামু সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিজিবি সদস্য শূন্যরেখায় দায়িত্ব পালনের সময় আহত হন। ওই এলাকায় কোনো মাইন থাকার কথা নয়, কিন্তু আরাকান আর্মি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সেখানে মাইন পুঁতে রেখেছে। আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ বা কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ও আরাকান আর্মিকে একটি প্রতিবাদলিপি পাঠিয়েছি। তবে তারা এখনো কোনো জবাব দেয়নি।’ ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা এড়াতে মাইন অপসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। বিজিবি সদর দপ্তর জানিয়েছে, গত শনিবার ভোলায় নিজ গ্রামে পূর্ণ সামরিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আখতার হোসেনকে দাফন করা হয়েছে। এক বিবৃতিতে বিজিবি বলেছে,দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তার এই সর্বোচ্চ ত্যাগ বিজিবি চিরদিন স্মরণ রাখবে। সূত্রমতে, বলছে, নাইক্ষ্যংছড়ির দুছড়ি থেকে টেকনাফের হোয়াইক্যং পর্যন্ত সীমান্তজুড়ে আরাকান আর্মির সঙ্গে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠী আরসা, আরএসও ও আরার সংঘর্ষ এখন নিয়মিত ঘটনা। গত ২৫ অক্টোবর হোয়াইক্যং এলাকায় সীমান্তের ওপার থেকে আসা গুলিতে চেনোয়ারা বেগম নামের এক বাংলাদেশি নারী আহত হন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য সিরাজুল মোস্তফা বলেন, নাফ নদীর তীরে যাদের চিংড়ির ঘের আছে বা যারা কাঁকড়া ধরেন, তারা এখন ভয়ে বের হতে পারছেন না। বিজিবি কর্মকর্তা কর্নেল মহিউদ্দিন বলেন, সংঘর্ষগুলো মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ঘটছে। কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠী যেন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে আমরা স্থানীয়দের ক্রমাগত সতর্ক থাকতে বলি এবং টহল জোরদার করেছি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বঙ্গোপসাগর থেকে বাংলাদেশি জেলেদের অপহরণের ঘটনা। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্ট মাস থেকে এ পর্যন্ত আরাকান আর্মি অন্তত ১১৬ জন বাংলাদেশি জেলেকে অপহরণ করেছে। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে অপহৃত ২৩৫ জেলের মধ্যে ১২৪ জন ফিরলেও এখনো ৬২ জন রোহিঙ্গাসহ ১১১ জন তাদের হাতে বন্দী। টেকনাফ কউকখালী ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি সাজিদ আহমেদ বলেন, জেলেরা এখন সাগরে যেতে ভয় পাচ্ছেন। টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন জানান, প্রাপ্ত অভিযোগ অনুযায়ী এখনো ১০৬ জন জেলে বন্দী আছেন। তিনি বলেন, ‘আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের কোনো আনুষ্ঠানিক মাধ্যম না থাকায় অনানুষ্ঠানিকভাবে তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।

জনপ্রিয় সংবাদ

সীমান্তে দাপট বাড়াচ্ছে আরাকান আর্মি

আপডেট সময় : ০৭:১১:১৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩ নভেম্বর ২০২৫
  • ঝুঁকিতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও সীমান্তবাসী
  • বাংলাদেশি ল্যান্ডমাইনে আহত অন্তত ৬৫ জন
  • ২০২৪ সালে দুই রোহিঙ্গা নিহত
  • ২০২৩ সালে পাঁচজন মাইন বিস্ফোরণে আহত
  • চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে অপহৃত ২৩৫ জেলে

সীমান্তে নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলা এবং যেকোনো উসকানিমূলক ঘটনা এড়াতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া উচিত-মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম, নিরাপত্তা বিশ্লেষক

 

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় আরকান আর্মির দাপট ক্রমেই বাড়ছে। মিয়ানমারের দুই বাহিনীর সংঘাতের প্রভাব ফেলছে সীমান্তে। এতে করে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। আরাকান আর্মির পুঁতে রাখা ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে আহত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) এক সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। পাহাড়ি এলাকার এই সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও বেসামরিক নাগরিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে, এই ঘটনাই তার সর্বশেষ উদাহরণ। নিহত নায়েক মো. আখতার হোসেন (৩৫) কক্সবাজারের ৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নে কর্মরত ছিলেন। গত ১২ অক্টোবর বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে টহল দেওয়ার সময় শূন্যরেখার কাছে মাইন বিস্ফোরণে তার ডান পা উড়ে যায়। প্রথমে রামু সেনানিবাস হাসপাতাল এবং পরে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেয়া হলে গত শুক্রবার তিনি মারা যান।
বিজিবি কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছরের ডিসেম্বরে মিয়ানমারের সীমান্ত থেকে দেশটির সরকারি বাহিনীর সদস্যরা সরে যাওয়ার পর বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) নিয়ন্ত্রণ নেয়। এরপর থেকেই তারা সীমান্তজুড়ে এমনকি নো-ম্যানস ল্যান্ডের কিছু অংশেও মাইন পুঁতে রাখে বলে জানা গেছে। এদিকে, নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং মিয়ানমারের সিতওয়েতে নিযুক্ত সাবেক কনসাল জেনারেল মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘সীমান্তে নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলা এবং যেকোনো উসকানিমূলক ঘটনা এড়াতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া উচিত। আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে মোকাবিলা করতে কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেই সীমান্তজুড়ে নির্বিচারে ল্যান্ডমাইন স্থাপন করেছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষায় বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় মাইন অপসারণ অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন।’
বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের শুরু থেকে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘাত শুরুর পর এ পর্যন্ত অন্তত ৬৫ জন বাংলাদেশি ল্যান্ডমাইনে আহত হয়েছেন। এ ছাড়া ২০২৪ সালে দুজন রোহিঙ্গা নিহত ও ২০২৩ সালে তাদের পাঁচজন মাইন বিস্ফোরণে আহত হন। বিজিবির রামু সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিজিবি সদস্য শূন্যরেখায় দায়িত্ব পালনের সময় আহত হন। ওই এলাকায় কোনো মাইন থাকার কথা নয়, কিন্তু আরাকান আর্মি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সেখানে মাইন পুঁতে রেখেছে। আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ বা কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ও আরাকান আর্মিকে একটি প্রতিবাদলিপি পাঠিয়েছি। তবে তারা এখনো কোনো জবাব দেয়নি।’ ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা এড়াতে মাইন অপসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। বিজিবি সদর দপ্তর জানিয়েছে, গত শনিবার ভোলায় নিজ গ্রামে পূর্ণ সামরিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আখতার হোসেনকে দাফন করা হয়েছে। এক বিবৃতিতে বিজিবি বলেছে,দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তার এই সর্বোচ্চ ত্যাগ বিজিবি চিরদিন স্মরণ রাখবে। সূত্রমতে, বলছে, নাইক্ষ্যংছড়ির দুছড়ি থেকে টেকনাফের হোয়াইক্যং পর্যন্ত সীমান্তজুড়ে আরাকান আর্মির সঙ্গে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠী আরসা, আরএসও ও আরার সংঘর্ষ এখন নিয়মিত ঘটনা। গত ২৫ অক্টোবর হোয়াইক্যং এলাকায় সীমান্তের ওপার থেকে আসা গুলিতে চেনোয়ারা বেগম নামের এক বাংলাদেশি নারী আহত হন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য সিরাজুল মোস্তফা বলেন, নাফ নদীর তীরে যাদের চিংড়ির ঘের আছে বা যারা কাঁকড়া ধরেন, তারা এখন ভয়ে বের হতে পারছেন না। বিজিবি কর্মকর্তা কর্নেল মহিউদ্দিন বলেন, সংঘর্ষগুলো মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ঘটছে। কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠী যেন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে আমরা স্থানীয়দের ক্রমাগত সতর্ক থাকতে বলি এবং টহল জোরদার করেছি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বঙ্গোপসাগর থেকে বাংলাদেশি জেলেদের অপহরণের ঘটনা। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্ট মাস থেকে এ পর্যন্ত আরাকান আর্মি অন্তত ১১৬ জন বাংলাদেশি জেলেকে অপহরণ করেছে। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে অপহৃত ২৩৫ জেলের মধ্যে ১২৪ জন ফিরলেও এখনো ৬২ জন রোহিঙ্গাসহ ১১১ জন তাদের হাতে বন্দী। টেকনাফ কউকখালী ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি সাজিদ আহমেদ বলেন, জেলেরা এখন সাগরে যেতে ভয় পাচ্ছেন। টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন জানান, প্রাপ্ত অভিযোগ অনুযায়ী এখনো ১০৬ জন জেলে বন্দী আছেন। তিনি বলেন, ‘আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের কোনো আনুষ্ঠানিক মাধ্যম না থাকায় অনানুষ্ঠানিকভাবে তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।