০৩:৪৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার ঐতিহাসিক নিদর্শন

যুদ্ধ শব্দটি শুনলেই মানুষের মনে আতঙ্ক নেমে আসে। যুদ্ধ মানেই ধ্বংস, অনিশ্চয়তা আর মানুষের জীবনের নিরাপত্তাহীনতা। তবুও দেশ ও মানুষের স্বার্থ রক্ষায় ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। মানব ইতিহাসে সংঘটিত দুটি ভয়াবহ যুদ্ধ—প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ—আজও বিশ্ববাসীকে নাড়া দেয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই এবং শেষ হয় ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর। প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ সংঘাত। জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, অটোমান সাম্রাজ্য ও বুলগেরিয়া একদিকে এবং গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, ইতালি, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো মিত্রশক্তি অন্যদিকে অবস্থান নেয়।

এর দুই দশক পর শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ—১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে। ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর অক্ষশক্তির আত্মসমর্পণের মাধ্যমে শেষ হয় মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ এই যুদ্ধ। এ যুদ্ধে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে পড়ে।

সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় বিশ্বযুদ্ধের স্মারক বাংকার

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমারু বিমান হামলা থেকে শ্রমিক-কর্মচারীদের জীবন রক্ষার জন্য বিশেষ বাংকার নির্মাণ করা হয়েছিল। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বৃহত্তম শিল্প স্থাপনাগুলোর একটি ছিল নীলফামারীর সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা। এ কারখানাটি নাৎসি বাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়ায় শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কারখানার ভেতরে ইট ও সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করা হয় গোলাকৃতি বিশেষ বাংকার।

কারখানাটিতে তখন প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কর্মরত ছিলেন। যুদ্ধের সময় সাইরেন বাজলে তারা দ্রুত বাংকারে আশ্রয় নিতেন। গোলাকৃতি বাংকারগুলো এমনভাবে নকশা করা হয়েছিল, যাতে বোমা হামলা হলেও বিস্ফোরণ লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় এবং ভেতরে থাকা মানুষ নিরাপদ থাকে।

কালের পরিক্রমায় বহু বাংকার ধ্বংস হয়ে গেলেও বর্তমানে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় সাতটি বাংকার এখনো অক্ষত অবস্থায় রয়েছে।

অবহেলায় হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা

রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এসব ঐতিহাসিক বাংকারে গজিয়েছে গাছপালা। লোহার দরজাগুলোতে ঝুলছে তালা। বর্তমানে কিছু বাংকার গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানান শ্রমিকরা।

পর্যটক, দর্শনার্থী ও শিক্ষার্থীরা সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা পরিদর্শনে এসে বাষ্পীয় ইঞ্জিন, পুরোনো যন্ত্রপাতির পাশাপাশি এই বাংকারগুলোও ঘুরে দেখেন। তাদের নানা কৌতূহলের জবাব দেন কারখানার প্রবীণ শ্রমিক ও কর্মচারীরা।

সংরক্ষণের দাবি

সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক (ডিএস) শাহ সুফী নূর মোহাম্মদ বলেন,
“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মারক হিসেবে বাংকারগুলো ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। ১৮৭০ সালে ১১০ একর জমির ওপর সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা গড়ে ওঠে। যুদ্ধের সময় শত্রুবাহিনীর হুমকির কারণে এখানে অসংখ্য বাংকার তৈরি করা হয়েছিল, যার মধ্যে সাতটি এখনো দৃশ্যমান।”

তিনি আরও বলেন, “ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শহর সৈয়দপুরে বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি বহনকারী এসব বাংকার, বাষ্পীয় ইঞ্জিন ও প্রাচীন যন্ত্রপাতি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি।”

শু/সবা

জনপ্রিয় সংবাদ

সোনারগাঁয়ে অবৈধ গ্যাস ব্যবহার করায় গুড়িয়ে দেয়া হয় দু’টি প্রতিষ্ঠান, একটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা

রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার ঐতিহাসিক নিদর্শন

আপডেট সময় : ০৫:১৮:০৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫

যুদ্ধ শব্দটি শুনলেই মানুষের মনে আতঙ্ক নেমে আসে। যুদ্ধ মানেই ধ্বংস, অনিশ্চয়তা আর মানুষের জীবনের নিরাপত্তাহীনতা। তবুও দেশ ও মানুষের স্বার্থ রক্ষায় ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। মানব ইতিহাসে সংঘটিত দুটি ভয়াবহ যুদ্ধ—প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ—আজও বিশ্ববাসীকে নাড়া দেয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই এবং শেষ হয় ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর। প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ সংঘাত। জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, অটোমান সাম্রাজ্য ও বুলগেরিয়া একদিকে এবং গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, ইতালি, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো মিত্রশক্তি অন্যদিকে অবস্থান নেয়।

এর দুই দশক পর শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ—১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে। ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর অক্ষশক্তির আত্মসমর্পণের মাধ্যমে শেষ হয় মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ এই যুদ্ধ। এ যুদ্ধে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে পড়ে।

সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় বিশ্বযুদ্ধের স্মারক বাংকার

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমারু বিমান হামলা থেকে শ্রমিক-কর্মচারীদের জীবন রক্ষার জন্য বিশেষ বাংকার নির্মাণ করা হয়েছিল। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বৃহত্তম শিল্প স্থাপনাগুলোর একটি ছিল নীলফামারীর সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা। এ কারখানাটি নাৎসি বাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়ায় শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কারখানার ভেতরে ইট ও সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করা হয় গোলাকৃতি বিশেষ বাংকার।

কারখানাটিতে তখন প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কর্মরত ছিলেন। যুদ্ধের সময় সাইরেন বাজলে তারা দ্রুত বাংকারে আশ্রয় নিতেন। গোলাকৃতি বাংকারগুলো এমনভাবে নকশা করা হয়েছিল, যাতে বোমা হামলা হলেও বিস্ফোরণ লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় এবং ভেতরে থাকা মানুষ নিরাপদ থাকে।

কালের পরিক্রমায় বহু বাংকার ধ্বংস হয়ে গেলেও বর্তমানে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় সাতটি বাংকার এখনো অক্ষত অবস্থায় রয়েছে।

অবহেলায় হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা

রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এসব ঐতিহাসিক বাংকারে গজিয়েছে গাছপালা। লোহার দরজাগুলোতে ঝুলছে তালা। বর্তমানে কিছু বাংকার গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানান শ্রমিকরা।

পর্যটক, দর্শনার্থী ও শিক্ষার্থীরা সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা পরিদর্শনে এসে বাষ্পীয় ইঞ্জিন, পুরোনো যন্ত্রপাতির পাশাপাশি এই বাংকারগুলোও ঘুরে দেখেন। তাদের নানা কৌতূহলের জবাব দেন কারখানার প্রবীণ শ্রমিক ও কর্মচারীরা।

সংরক্ষণের দাবি

সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক (ডিএস) শাহ সুফী নূর মোহাম্মদ বলেন,
“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মারক হিসেবে বাংকারগুলো ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। ১৮৭০ সালে ১১০ একর জমির ওপর সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা গড়ে ওঠে। যুদ্ধের সময় শত্রুবাহিনীর হুমকির কারণে এখানে অসংখ্য বাংকার তৈরি করা হয়েছিল, যার মধ্যে সাতটি এখনো দৃশ্যমান।”

তিনি আরও বলেন, “ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শহর সৈয়দপুরে বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি বহনকারী এসব বাংকার, বাষ্পীয় ইঞ্জিন ও প্রাচীন যন্ত্রপাতি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি।”

শু/সবা