১০:১৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

টিফিনের টাকা জমিয়ে রোবট তৈরি করল সপ্তম শ্রেণীর আলামিন

দিনাজপুর প্রতিনিধি
বাংলা প্রবাদে আছে, ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। মনের ইচ্ছা শক্তি থাকলে শত বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। টিফিনের টাকা জমিয়ে রোবট বানিয়ে অনেকটাই তাক লাগিয়ে দিয়েছেন দিনাজপুর সদর উপজেলার কাশীপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আলামিন হোসেন। তার এই সাফল্যের পথ কিন্তু মোটেও সহজ ছিলো না।
আলামিন ইসলামের বাসা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকার মুক্তিযোদ্ধা পাড়ায়। নয় বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় বাবাকে হারান আলামিন। মা আর ছোটভাইকে নিয়ে বর্তমানে মামার বাড়িতে থাকেন। সংসারে অভাব-অনটনের পরেও হাল ছাড়েনি আলামিন। টিফিনের টাকা জমিয়ে তৈরি করেছে রোবট।
সরেজমিনে দেখা যায়, আলামিনের তৈরি রোবটের সাথে কথা বলতে ঘিরে আছে শিক্ষার্থীরা। একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে চলেছে সেই রোবট। সালাম দিলে জবাব দিচ্ছে সালামের। স্বল্প গতিতে চলাফেরাও করছে রোবটটি। বøুটুথ ডিভাইসের মাধ্যমে অ্যান্ড্রয়েড ফোনের সাহায্যে সংযোগ করা হয় রোবটটি। এরপর সুইচ অন করে আপনার ইচ্ছে মত করা প্রশ্নের উত্তর দেয় রোবটটি। বৈদ্যুতিক চার্জের মাধ্যমে চলে রোবটটি। এই রোবটের নাম দিয়েছে “জিজ্ঞাসা যন্ত্র”।
কথা হলে আলামিন ইসলাম বলেন, অনেকদিন থেকেই রোবট বানানোর পরিকল্পনা করেছি। টিফিনের জন্য দেয়া টাকা জমিয়ে বিভিন্ন রকম যন্ত্রাংশ কিনতাম। কিন্তু রোবটটি পরিচালনার জন্য একটি অ্যান্ড্রয়েড ফোন দরকার যেটা আমার ছিলো না। একদিন ক্লাসে আমার রোবটের কথা বললে ম্যাডাম সেটি স্কুলে নিয়ে যেতে বলে। তারপর ম্যাডামের ফোনের সাহায্যে সেটি চালিয়ে দেখাই। সেটি ভালো ভাবে কাজ করছে। রোবটটিকে যেকোন প্রশ্ন করলে সে উত্তর দিতে পারে।
আলামিনের সহপাঠী মুশফিকা নাজনীন মিম বলেন, আমি প্রাইমারী থেকে আলামিনের সাথে পড়ালেখা করছি। সে অনেক মেধাবী। কাগজের ফুল তৈরি করতে পারে। ইলেক্ট্রিকেল বিষয়ে ওর অনেক আগ্রহ। আমি মাঝেমধ্যে তাকে জিজ্ঞাসা করি যে সে কিভাবে এগুলো তৈরি করতে পারে। আলামিনের কাছ থেকে আমিও কাগজ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের জিনিষ তৈরি করতে শিখছি। সে আমাদের এবং আমাদের স্কুলের গর্ব।
আলামিনের সহপাঠী আফরিন জান্নাত নিশি বলেন, আলামিন যখন প্রথমে আমাদেরকে রোবট তৈরির কথা জানায় তখন আমরা বিষয়টি ম্যাডামকে জানাই। পরে একদিন সে তার রোবটটি স্কুলে নিয়ে এসে ম্যাডামের অ্যান্ড্রয়েড ফোনের সাহায্যে চালিয়ে দেখায়। আমরা রোবটটিকে যেগুলো প্রশ্ন করেছি সেগুলোর সঠিক উত্তর দিচ্ছিল। আমরা তো ভাবতেই পারিনি আমাদের সহপাঠী এরকম একটা রোবট তৈরি করতে পারবে। আমাদের অনেক ভালো লাগতেছে এজন্য। এখন আমরাও আলামিনের কাছে অনেক কিছু শিখতে পারব।
আরেক সহপাঠী রিফাত হোসেন বলেন, আলামিন আগে থেকেই কাগজ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের জিনিষপত্র তৈরি করত। এর আগেও সে একটি লাইট, ফ্যান তৈরি করেছিল। লেখাপড়াতেও সে ভালো। আর খেলাধুলাও ভালো পারে বিশেষ করে দাবা খেলা। আমরা সবাই তার জন্য অনেক খুশি।
আলামিনের মা মরিয়ম আক্তার বলেন, রাতে পড়া শেষ করে অনেকক্ষণ ধরে কি কি জানি কাজ করত। আমি জিজ্ঞেস করলে বলত কাজ শেষ হইলে বলব। আমি টিফিন খাওয়ার জন্য যে টাকা দিতাম সেগুলো জমিয়ে সে রোবটের বিভিন্ন পার্টসগুলো কিনত। আমাকে বলত যে একটা স্মার্ট ফোন হলে আমার কাজটা হয়ে যেত। কিন্তু আমাদের অভাবের সংসার, এখনও আলামিনকে ফোন কিনে দিতে পারিনি। পরে সে স্কুলের আপার ফোন দিয়ে রোবাট চালাত। এটা আমার মা হিসেবে অনেক ভালো লাগছে যে আমার ছেলে এরকম একটা রোবট তৈরি করেছে। সকলে তার জন্য দোয়া করবেন সে ভবিষ্যতেও যেন ভালো কিছু করতে পারে।
আলামিনের শ্রেণী শিক্ষিকা আজমিরা খাতুন বলেন, আলামিন ইলেক্ট্রিকেল বিভিন্ন ডিভাইস তৈরি করতে পছন্দ করত। ষষ্ঠ শ্রেণীতে থাকা কালীন একটি লাইট সিস্টেম চার্জার ফ্যান আমাকে বানিয়ে দিয়েছিল। শিক্ষার্থী হিসেবেও সে বেশ মেধাবী। স্কুলের অনেক শিক্ষার্থী তাকে দেখে উৎসাহিত হচ্ছে এরকম কিছু তৈরি করতে। আমাদেরও ভালো লাগতেছে আমাদের স্কুলের শিক্ষার্থী এরকম একটা রোবট তৈরি করেছে।
কাশীপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লোকমান হাকিম বলেন, আলামিনের এই উদ্ভাবন অন্যান্য শিক্ষার্থীদেরকে উৎসাহিত করবে। আমরা স্কুলেও বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভালো কিছু করতে আমরা বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম চালু রেখেছি। প্রত্যেকটা স্কুলে আইসিটি তথা বিজ্ঞান ল্যাব ও উন্নত চর্চার ব্যবস্থা থাকা উচিৎ। এতে করে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পাবে।
আলামিনের রোবট আবিষ্কারের খবরে বিদ্যালয় পরিদর্শন শেষে আলামিনকে উৎসাহিতকরণ ও নগদ অর্থ সহয়তা দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রমিজ আলম। কথা হলে তিনি বলেন, তথ্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আলামিনের রোবট উদ্ভাবনকে আমরা অনেক ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থায় আইসিটি কারিকুলাম সংযোজনের ফলে শিক্ষার্থীরা সেখানে অর্জিত মেধা কাজে লাগাতে পারছে। আলামিনের মধ্যেও সেই চেষ্টা রয়েছে ভালো কিছু করার। আমাদের উপজেলা বিজ্ঞানের পক্ষ থেকে আলামিনকে সার্বক্ষণিক সহায়তা করা হবে।
জনপ্রিয় সংবাদ

সাড়ে ৯ ঘণ্টা পর দৌলতদিয়া–পাটুরিয়া নৌরুটে ফেরি চলাচল শুরু

টিফিনের টাকা জমিয়ে রোবট তৈরি করল সপ্তম শ্রেণীর আলামিন

আপডেট সময় : ০৪:৪৬:৩৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ নভেম্বর ২০২৩
দিনাজপুর প্রতিনিধি
বাংলা প্রবাদে আছে, ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। মনের ইচ্ছা শক্তি থাকলে শত বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। টিফিনের টাকা জমিয়ে রোবট বানিয়ে অনেকটাই তাক লাগিয়ে দিয়েছেন দিনাজপুর সদর উপজেলার কাশীপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আলামিন হোসেন। তার এই সাফল্যের পথ কিন্তু মোটেও সহজ ছিলো না।
আলামিন ইসলামের বাসা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকার মুক্তিযোদ্ধা পাড়ায়। নয় বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় বাবাকে হারান আলামিন। মা আর ছোটভাইকে নিয়ে বর্তমানে মামার বাড়িতে থাকেন। সংসারে অভাব-অনটনের পরেও হাল ছাড়েনি আলামিন। টিফিনের টাকা জমিয়ে তৈরি করেছে রোবট।
সরেজমিনে দেখা যায়, আলামিনের তৈরি রোবটের সাথে কথা বলতে ঘিরে আছে শিক্ষার্থীরা। একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে চলেছে সেই রোবট। সালাম দিলে জবাব দিচ্ছে সালামের। স্বল্প গতিতে চলাফেরাও করছে রোবটটি। বøুটুথ ডিভাইসের মাধ্যমে অ্যান্ড্রয়েড ফোনের সাহায্যে সংযোগ করা হয় রোবটটি। এরপর সুইচ অন করে আপনার ইচ্ছে মত করা প্রশ্নের উত্তর দেয় রোবটটি। বৈদ্যুতিক চার্জের মাধ্যমে চলে রোবটটি। এই রোবটের নাম দিয়েছে “জিজ্ঞাসা যন্ত্র”।
কথা হলে আলামিন ইসলাম বলেন, অনেকদিন থেকেই রোবট বানানোর পরিকল্পনা করেছি। টিফিনের জন্য দেয়া টাকা জমিয়ে বিভিন্ন রকম যন্ত্রাংশ কিনতাম। কিন্তু রোবটটি পরিচালনার জন্য একটি অ্যান্ড্রয়েড ফোন দরকার যেটা আমার ছিলো না। একদিন ক্লাসে আমার রোবটের কথা বললে ম্যাডাম সেটি স্কুলে নিয়ে যেতে বলে। তারপর ম্যাডামের ফোনের সাহায্যে সেটি চালিয়ে দেখাই। সেটি ভালো ভাবে কাজ করছে। রোবটটিকে যেকোন প্রশ্ন করলে সে উত্তর দিতে পারে।
আলামিনের সহপাঠী মুশফিকা নাজনীন মিম বলেন, আমি প্রাইমারী থেকে আলামিনের সাথে পড়ালেখা করছি। সে অনেক মেধাবী। কাগজের ফুল তৈরি করতে পারে। ইলেক্ট্রিকেল বিষয়ে ওর অনেক আগ্রহ। আমি মাঝেমধ্যে তাকে জিজ্ঞাসা করি যে সে কিভাবে এগুলো তৈরি করতে পারে। আলামিনের কাছ থেকে আমিও কাগজ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের জিনিষ তৈরি করতে শিখছি। সে আমাদের এবং আমাদের স্কুলের গর্ব।
আলামিনের সহপাঠী আফরিন জান্নাত নিশি বলেন, আলামিন যখন প্রথমে আমাদেরকে রোবট তৈরির কথা জানায় তখন আমরা বিষয়টি ম্যাডামকে জানাই। পরে একদিন সে তার রোবটটি স্কুলে নিয়ে এসে ম্যাডামের অ্যান্ড্রয়েড ফোনের সাহায্যে চালিয়ে দেখায়। আমরা রোবটটিকে যেগুলো প্রশ্ন করেছি সেগুলোর সঠিক উত্তর দিচ্ছিল। আমরা তো ভাবতেই পারিনি আমাদের সহপাঠী এরকম একটা রোবট তৈরি করতে পারবে। আমাদের অনেক ভালো লাগতেছে এজন্য। এখন আমরাও আলামিনের কাছে অনেক কিছু শিখতে পারব।
আরেক সহপাঠী রিফাত হোসেন বলেন, আলামিন আগে থেকেই কাগজ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের জিনিষপত্র তৈরি করত। এর আগেও সে একটি লাইট, ফ্যান তৈরি করেছিল। লেখাপড়াতেও সে ভালো। আর খেলাধুলাও ভালো পারে বিশেষ করে দাবা খেলা। আমরা সবাই তার জন্য অনেক খুশি।
আলামিনের মা মরিয়ম আক্তার বলেন, রাতে পড়া শেষ করে অনেকক্ষণ ধরে কি কি জানি কাজ করত। আমি জিজ্ঞেস করলে বলত কাজ শেষ হইলে বলব। আমি টিফিন খাওয়ার জন্য যে টাকা দিতাম সেগুলো জমিয়ে সে রোবটের বিভিন্ন পার্টসগুলো কিনত। আমাকে বলত যে একটা স্মার্ট ফোন হলে আমার কাজটা হয়ে যেত। কিন্তু আমাদের অভাবের সংসার, এখনও আলামিনকে ফোন কিনে দিতে পারিনি। পরে সে স্কুলের আপার ফোন দিয়ে রোবাট চালাত। এটা আমার মা হিসেবে অনেক ভালো লাগছে যে আমার ছেলে এরকম একটা রোবট তৈরি করেছে। সকলে তার জন্য দোয়া করবেন সে ভবিষ্যতেও যেন ভালো কিছু করতে পারে।
আলামিনের শ্রেণী শিক্ষিকা আজমিরা খাতুন বলেন, আলামিন ইলেক্ট্রিকেল বিভিন্ন ডিভাইস তৈরি করতে পছন্দ করত। ষষ্ঠ শ্রেণীতে থাকা কালীন একটি লাইট সিস্টেম চার্জার ফ্যান আমাকে বানিয়ে দিয়েছিল। শিক্ষার্থী হিসেবেও সে বেশ মেধাবী। স্কুলের অনেক শিক্ষার্থী তাকে দেখে উৎসাহিত হচ্ছে এরকম কিছু তৈরি করতে। আমাদেরও ভালো লাগতেছে আমাদের স্কুলের শিক্ষার্থী এরকম একটা রোবট তৈরি করেছে।
কাশীপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লোকমান হাকিম বলেন, আলামিনের এই উদ্ভাবন অন্যান্য শিক্ষার্থীদেরকে উৎসাহিত করবে। আমরা স্কুলেও বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভালো কিছু করতে আমরা বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম চালু রেখেছি। প্রত্যেকটা স্কুলে আইসিটি তথা বিজ্ঞান ল্যাব ও উন্নত চর্চার ব্যবস্থা থাকা উচিৎ। এতে করে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পাবে।
আলামিনের রোবট আবিষ্কারের খবরে বিদ্যালয় পরিদর্শন শেষে আলামিনকে উৎসাহিতকরণ ও নগদ অর্থ সহয়তা দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রমিজ আলম। কথা হলে তিনি বলেন, তথ্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আলামিনের রোবট উদ্ভাবনকে আমরা অনেক ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থায় আইসিটি কারিকুলাম সংযোজনের ফলে শিক্ষার্থীরা সেখানে অর্জিত মেধা কাজে লাগাতে পারছে। আলামিনের মধ্যেও সেই চেষ্টা রয়েছে ভালো কিছু করার। আমাদের উপজেলা বিজ্ঞানের পক্ষ থেকে আলামিনকে সার্বক্ষণিক সহায়তা করা হবে।