🔰 মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরে বিপাকে বাংলাদেশ
🔰 কূটনৈতিক তৎপরতায় ৭ বছরেও মেলেনি সমাধান
🔰 এ দেশে প্রবেশের অপেক্ষায় হাজারো চাকমা-রোহিঙ্গা
🔰 রোহিঙ্গাদের অপকর্মে নিরাপত্তাহীনতায় স্থানীয় জনগোষ্ঠী
🔰 নতুন করে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সর্বোচ্চ সতর্ক বাংলাদেশ
🔰 সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদারের পরামর্শ নিরাপত্তা বিশ্লেষকের
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সহিংসতার ঘটনায় পালিয়ে এসে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা নিয়ে বিপাকে রয়েছে বাংলাদেশ। নানান কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে দীর্ঘ সাত বছরেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কোনো উদ্যোগের সমাধান মেলেনি। সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী শরণার্থী শিবিরে অবস্থান নিয়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে আশ্রিত রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের অপকর্মে স্থানীয় জনগোষ্ঠীও এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এদের অপতৎপরতা সামাল দিতে নিরাপত্তা বাহিনীকেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এরই মধ্যে নতুন করে আরাকান আর্মির সশস্ত্র হামলায় গুলিবিদ্ধসহ মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) ১০৬ জন সদস্য অস্ত্রসহ পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বিজিবি তাদের নিরস্ত্রীকরণ করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়েছে। অব্যাহত হামলায় প্রাণহানির আশঙ্কায় দেশটির চাকমা সম্প্রদায় ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর হাজারো মানুষ নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম তমব্রুসহ অন্যান্য সীমান্ত এলাকায় অবস্থান নিয়ে এ দেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, আগের অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গারা এমনিতেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি রয়েছে। বিজিবি বলছে, রোহিঙ্গাসহ মিয়ানমারের অন্যান্য সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ ঠেকাতে দেশের সীমান্ত এলাকাজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। গতকাল সোমবার বিজিবিসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে সংঘাত-সহিংসতার ঘটনায় ১৯৪২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বহুসংখ্যক রোহিঙ্গার সীমান্ত পেরিয়ে এ দেশে অনুপ্রবেশ সংঘটিত হয়েছে। ১৯৭৮ সালে প্রায় ২ লাখ, ১৯৯১-৯২ সালে ২ লাখ ৫০ হাজার, ২০১৬ সালে প্রায় ৮৭ হাজার এবং ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে ২০১৮ সালের জানুয়ারির মধ্যে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বর্তমানে প্রায় ৯ লাখ ৬১ হাজার ৭২৯ জন বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী কক্সবাজার জেলার টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলায় অবস্থান করছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ সরকার তাদের আশ্রয় দিলেও বিশাল এ জনগোষ্ঠীকে ফিরিয়ে নিতে দফায় দফায় বৈঠকে আশ^াস দিলেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি মিয়ানমার সরকার। বিভিন্ন অপরাধ মামলায় গ্রেপ্তার রোহিঙ্গারা এ দেশে কারাবন্দি রয়েছেন। এর ফলে এ দেশের অভ্যন্তরে কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির পাহাড়ি অঞ্চলে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী। রোহিঙ্গাদের কারণে মাদকের পাশপাশি অস্ত্রের চোরাচালান বেড়েছে সীমান্ত এলাকায়। রোহিঙ্গাদের হামলায় প্রাণ হারাচ্ছেন স্থানীয়রাও। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অপরাধ কর্মকাণ্ডে প্রতিনিয়তই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন স্থানীয়রা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ সবুজ বাংলাকে বলেন, বিভিন্ন ফ্রন্টে বিরোধী সশস্ত্র গ্রুপের তুমুল প্রতিরোধের কারণে দেশটির জান্তা সরকার কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। এমনিতেই আগে থেকে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা এ দেশের বোঝা হয়ে রয়েছে। এ নিয়ে বিপাকেই রয়েছে বাংলাদেশ। কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে গত ৭ বছরেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক কোনো উদ্যোগ সফল হয়নি। এখনো মেলেনি এর সমাধান। নতুনভাবে যাতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে, এটা নিশ্চিত করতে সীমান্তে অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন এবং গোয়েন্দা নজরদারিসহ নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো বাড়াতে হবে।
বান্দরবান জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন সবুজ বাংলাকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবিক বিবেচনায় বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের এ দেশে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বেশ কয়েকবার বিশ্ব নেতাদেরর জানিয়েছেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এই অঞ্চলের মানবিক সংকট ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি। গতবারের অনুপ্রবেশের পর তাদের দেশে ফেরাতে আন্তর্জাতিক দৃশ্যমান উদ্যোগ না থাকায় এবার বেশি সতর্ক থাকতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। তিনি বলেন, দ্রুত মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের মাধ্যমেই
কেবল রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধান সম্ভব। আশা করি, শিগগিরই মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেবে।
এদিকে গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকায় যুদ্ধ জোরালো করেছে আরাকান আর্মিসহ দেশটির কয়েকটি সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী। তারা সম্মিলিতভাবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। এর মধ্যেই কোনো কোনো সীমান্ত শহর দখল করে নিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গত শনিবার থেকে শুরু হওয়া হামলা পাল্টা হামলার মধ্যে গতকাল সোমবার রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আত্মরক্ষার্থে গুলিবিদ্ধসহ মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ১০৬ সদস্য অস্ত্রসহ পালিয়ে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম-তমব্রু সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। এরপর বিজিবির কাছে তারা আত্মসমর্পণ করে। তুমুল সংঘর্ষ চলাকালে আরাকান আর্মির ছোড়া মর্টারশেল ও গুলি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকার বিভিন্ন গ্রামে এসে পড়ে। এতে বাংলাদেশি এক নারী ও রোহিঙ্গা পুরুষ নিহত এবং ৫ জন আহত হন। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য সীমান্তের ওপারে অবস্থান নিয়েছে অনেক মিয়ানমারের চাকমা সম্প্রদায় ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী।
কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. মিজানুর রহমান সবুজ বাংলাকে বলেন, আর কোনো রোহিঙ্গা যেন এ দেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেদিকে সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে বিজিবি।
বিজিবি-৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আল মাশরোকি বলেন, সীমান্তজুড়ে নিরাপত্তা চৌকিতে জনবল বাড়ানো, নজরদারিসহ টহল ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। একই সঙ্গে নৌ-পথে কোস্টগার্ড ও পুলিশ প্রশাসনও তৎপর রয়েছে।
নাইক্ষ্যংছড়ির পাঁচ প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা : বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় চলমান অস্থিরতার কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিবেচনায় বান্দরবান পার্বত্য জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী নিম্নবর্ণিত পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত সাময়িকভাবে বন্ধ থাকবে। গতকাল সোমবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আক্তারুন্নাহার স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। স্কুলগুলো হচ্ছেÑ বাইশপারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়; ভাজবনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়; তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়; পশ্চিমকুল তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং দক্ষিণ ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, স্থানীয় পরিস্থিতির উন্নতি হলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, বান্দরবান পার্বত্য জেলা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনাক্রমে বর্ণিত বিদ্যালয়সমূহে পুনরায় পাঠদান করাসহ বিদ্যালয়সমূহ খোলার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
স/ম























