“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী অর্ধের তার নর।”
কাজী নজরুল ইসলামের “নারী” কবিতার এই লাইন শুনে নাই এমন শিক্ষার্থী হয়তো পাওয়া যাবেনা। যারাই স্কুল কলেজের বারান্দায় পা রেখেছে, তাঁরাই এই কবিতাংশ শুনেছে, কিন্তু উপলব্ধি করেছে কতজন? প্রতি বছর ৮ মার্চ পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারী-পুরুষের সমানাধিকারের জন্য সারা বিশ্ব জুড়েই পালন করা হয় এই দিনটি। এই দিনটি নারীদের অধিকার, স্বাধীনতা,সাম্য নিয়ে আলাপ আলোচনা হয় পুরো বিশ্বজুরে।
নারী দিবসে আমাদের আলোচনায় থাকে সেলিব্রিটি, বৃত্তবান এমনকি ক্ষমতাবান নারীদের নিয়ে। আড়ালে থেকে যায় সংগ্রামী, সাহসী কিংবা প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে টিকে থাকা নারীদের কথা। এই বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ২০২৪ সালে প্রাতিপাদ্য, ” নারীর সম-অধিকার, সমসুযোগ এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ” এই স্লোগানকে সামনে রেখে পালিত হচ্ছে বিশ্বনারী দিবস। নারী দিবস সম্পর্কে কথা বলেছিলাম কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন নারী শিক্ষার্থীর সাথে। জানতে চেয়েছিলাম, নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর অধিকার বাস্তবায়নে নারী দিবস কতটুকু কার্যকর ভূমিকা রাখছে?
” নারী দিবস যেন শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ না থেকে নারীর অধিকার বাস্তবায়িত হয়”
বাংলাদেশের নারী ক্ষমতায়নে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতাটি এখনো নারী বিরোধী নেতিবাচক সমাজ মনস্তত্ত্ব। সমাজের অধিকাংশ মানুষের ধারণা নারীর প্রাথমিক কাজ ঘর সামলানো, স্বামী শ্বশুরের খেদমত করা। মানুষের এই দৃষ্টিভঙ্গির না পাল্টানোর কারণে মেয়েদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডির পেরনোর আগে শিক্ষার ইতি টানতে হয়।যার কারণে অধিকাংশ নারী তাদের অধিকার ও আইন সম্পর্কে অবগত না। ফলে তারা নির্যাতিত ও নিপিড়ীত। আর তাদের নিজেদের কোনো আয়ের উৎস না থাকার কারণে বৈষম্যের শিকার হয়।
আসলে যুগ যুগ ধরে বিরাজমান পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীদের সমান অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা সহজ কোনো বিষয় নয়। তার মধ্যে চলাফেরা ক্ষেত্রে নারীরা সবথেকে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হয়। আমার নিজের ক্ষেত্রে যদি বলি,কুমিল্লা থেকে আমার বাড়ি যেতে প্রায় নয় ঘন্টার সময় লাগে। আর এতটা পথ একা যাওয়ার সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাছাড়া রাস্তাঘাটে নারীরা ইভটিজিং এ শিকার হওয়ার একটা ভয় থাকে।এই সকল প্রকার বৈষম্য ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে নারীকে জাগ্রত করায় নারী দিবসের মূল উদ্দেশ্য। শিল্প-সাহিত্য – সহ সকল ক্ষেত্রে এবং সমাজের সমস্ত কাজে নারীর অবদানকে স্বীকৃতি দিতেই এই দিনটি পালিত হয়।
আমার প্রত্যাশা নারী দিবস যেন শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ না থেকে তাদের অধিকার বাস্তবায়িত হয়। নারী দিবসে নারীদের অবস্থান নিয়ে কথা বলেছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন নারী শিক্ষার্থী।
ডওয়াংনুং মার্মা (গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ)
“পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে”
নারী দিবস মানে হচ্ছে নারী এবং নারীকেই সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে সবার কাছে তুলে ধরার একটা প্রয়াস। নারী তার অধিকার আদায়ে কতটা সংগ্রামী তা বিশ্বকে জানান দেওয়ার একটা বিশেষ পন্থা। একজন নারী চাইলেই তার সুনিপুণ কর্মদক্ষতা দ্বারা একটা জাতিকে সুশীল ও সুদক্ষ এমনকি একটি দেশকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে পারে। এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে নারীরা পদচারণ পরেনি। ঘর সামলানোর কাজ থেকে শুরু করে, কোট-কাচারী, অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা, ব্যবসা-বাণিজ্য এমনকি দেশ চালনার মতো কঠিন কাজেও নারীরা পিছিয়ে নেই। কিন্তু, আমার ভাবতেই অবাক লাগে যে, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমাদেরকে দেখতে হচ্ছে নারী উন্নয়নের প্রধান বাধা ‘পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি’ যা মোটেই কাম্য নয়। এখনো কিছু কিছু কাজের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বৈষম্য করা হয় যা একটা দেশের উন্নয়নের বাধা হতে পারে। নানান ক্ষেত্রে বৈষম্য, নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরও উন্নয়নমূলক প্রতিটি কাজে নারীরা অংশগ্রহণ করছে যা প্রশংসনীয়।
নারী কখনো মা কখনো বোন আবার কখনো স্ত্রী। এভাবে একজন নারী তিনটা ভূমিকা পালন করে থাকে। একটা বাড়ির মূল হচ্ছে নারী। কথায় আছে, সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে। এ রমনীকে যদি সঠিক মূল্যায়ন না করা হয় তাহলে সে সংসার কখনও উন্নত হতে পারে না।
শিশুর প্রথম শিক্ষক হচ্ছে তার মা। মা ছাড়া শিশু কখনও বিকশিত হতে পারে না। নেপোলিয়ন বলেছিলেন- “তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দিবো।”
তাছাড়া আমি মনে করি, একটা দেশ তখনই স্বাবলম্বী হয়ে উঠে যখন সেই দেশের নারী এবং পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার সুযোগ পায়।আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আমার তথা একজন নারীর একটাই চাওয়া সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা যেন নারীর উন্নয়নের পথকে আরো মসৃণ করে তোলে।
উম্মে হাবিবা শান্তা (গণিত বিভাগ)
“সর্বস্তরের নারীর মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে”
৮ মার্চ “বিশ্ব নারী দিবস”। নারী এবং পুরুষ নিয়ে আমাদের সমাজ গঠিত।সুতরাং তাদের উভয়ের সম্মিলিত অবদানেই সমাজ এগিয়ে চলেছে। পূর্বে নারীরা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই পিছিয়ে ছিলো।কিন্তু বর্তমান সমাজের চিত্র পূর্বের চেয়ে অনেকাংশে পাল্টেছে।নারীরা বর্তমানে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়েছে,সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান সুদৃর ।বিশ্ব নারী দিবস এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।নারীরা এখন সমাজের সকল ক্ষেত্রে তাদের উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে যা বিশ্ব নারী দিবসের উদ্দেশ্যকে সফল করতে ভূমিকা রাখছে। বিশ্ব নারী দিবসে একজন নারী শিক্ষার্থী হিসেবে আমার চাওয়া এই যে সর্বস্তরের নারীরা যেন সমাজে তাদের যোগ্য মর্যাদা পায় এবং তাদের অধিকার আদায়ে সচেতন হয়।
মারিয়া মুরছালিন (পরিসংখ্যান বিভাগ)
“শুধু নারী দিবস না, প্রতিটি দিনই হোক নারীর”
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু নারী ক্ষমতায়ন এবং নারীর অধিকার রক্ষায় অনেক পিছিয়ে। একজন উপরের দিকে উঠলে বাকি দশজন মিলে তাকে টেনে নিচের দিকে নামাবে এটাই যেন আমাদের সমাজের একটি রীতিনীতি হয়ে গিয়েছে। তাই আমাদের দেশে কিছু নারী নক্ষত্রের মতো আলো ছড়ালেও তাদেরও পড়তে হয় অনেক ধরনের সমালোচনায়। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার কমেন্ট বক্সগুলোই তার একমাত্র প্রমাণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী হিসেবে আমাকেও অনেক সময় কাছের বন্ধুর থেকে শুনতে হয় “তুমি মেয়ে তুমি এত রাতে বের হবে কেন?” যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসই আমাদের জন্য সবথেকে নিরাপত্তের জায়গা। নারী যদি তার স্থানটা তৈরি করে নিতে না পারে তবে, নারী ক্ষমতায়ন কখনো সম্ভব নয়। এগিয়ে আসতে হবে প্রতিটি নারীকে। জানতে হবে ৮ই মার্চের আসল ইতিহাস। প্রশ্ন তুলতে হবে প্রতিটি বৈষম্য, নির্যাতন এবং ধর্ষনের বিরুদ্ধে। পৃথিবীতে সত্যের জয় হোক, দূর হয়ে যাক কুসংস্কার সহ যত গোঁড়ামি। তাই শুধু নারী দিবসই না প্রতিটা দিবসই নারীর হোক।
সাদিয়া নওশীন ঐশি ( মার্কেটিং বিভাগ)
























