০৮:৫২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

খুলনায় রমজান ঘিরে খেজুর, চাল, ডাল, পেঁয়াজে চাপ

পবিত্র মাহে রমজান মাসটি ঘিরে খুলনায় খেজুর, চাল, ডাল, ছোলা, বেসন, চিনি ও পেঁয়াজের ওপর একটু বেশি চাপ পড়েছে। রোজা শুরুর এক সপ্তাহ আগে থেকেই বাজার ঘুরে শুরু হয়েছে কেনাকাটা। তবে ক্রেতাদের পূর্ব প্রস্তুতিতে প্রতিবারের মতো এবারও দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বিক্রেতারা। বরাবরের মতো এবারও রোজার আগেই বাজারে সক্রিয় হয়েছে অতিমুনাফালোভী চক্র।

নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যে ক্রেতাদের মধ্যে অসন্তোষ ছিল লক্ষণীয়। আলু, দেশি রসুন, বেগুন, সব ধরনের মুরগির গোশত, গরুর গোশত এবং প্রায় সব ধরনের ডাল বিক্রি হচ্ছে বেশি দামে।

বাজার করতে আসা ক্রেতারা বলছেন, সরকার রোজায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকবে বললেও সেটা হচ্ছে না। সবকিছুর দামই বেড়েছে। অন্যদিকে বিক্রেতারা বলছেন, ক্রেতারা বেশি চাহিদা দেখাচ্ছে বলেই সবকিছুর দাম বাড়তি।

দুই মাসের ব্যবধানে বিভিন্ন বাজার ও এলাকার মুদি দোকানে প্রতি কেজি ছোলা, মুড়ি, খেজুর, বেসন, সরিষার তেল, বুটের ডালের দাম ১০-৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। আর শরবত তৈরির উপকরণ ইসবগুলের ভুসির দাম কেজিতে ৫০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া রমজাননির্ভর বিভিন্ন খাদ্যপণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত আলু, ধনেপাতা, পুদিনাপাতা, ট্যাং, রুহ-আফজার দামও অহেতুক বাড়ানো হয়েছে।

শুক্রবার নগরীর মিস্ত্রিপাড়া, শেখপাড়া, বয়রা ও গল্লামারী এলাকার বিভিন্ন বাজার ঘুরে খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা, যা ২ মাস আগেও ৯০ টাকা ছিল। বাজারে মান ও দাম ভেদে সাদা মুড়ি বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে গত ২ মাস আগে যে মুড়ি ৮০ টাকা ছিল তা এখন ১১০/১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি মাঝারিমানের তিউনিশিয়ান খেজুর বিক্রি হয়েছে ৬০০ টাকা। যা ২ মাস আগে ৩০০-৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়। মান ও বাজারভেদে প্রতি কেজি বেসন বিক্রি হচ্ছে ৭০-১০০ টাকা, যা আগে ৬০-৮০ টাকায় বিক্রি হয়। বুটের ডাল প্রতি কেজি বিক্রি হয় ১১০ টাকা। যা আগে ৯০ টাকা বিক্রি হয়েছিল।
এছাড়া ইফতারে শরবত তৈরিতে ব্যবহৃত ইসবগুলের ভুসি ট্যাং, রুহ-আফজার দামও বাড়ানো হয়েছে। প্রতি কেজি ইসবগুলের ভুসি দুই মাস আগে ১৬০০ টাকা বিক্রি হলেও এখন ২১০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি প্যাকেটজাত ট্যাং বিক্রি হয়েছে ৮৫০ টাকা, যা আগে ৮০০ টাকা ছিল। বড় সাইজের রুহ-আফজা বিক্রি হচ্ছে ৫০০-৫৫০ টাকা। যা আগে ৩৫০ টাকা ছিল। ছোট সাইজের রুহ-আফজা বিক্রি হচ্ছে ২৮০-৩০০ টাকা, যা আগে ২০০ টাকা ছিল।

সরেজমিনে দেখা গেছে, চিনি, চাল-ডালসহ প্রতিটি পণ্যের দাম সপ্তাহ ব্যবধানে কেজিপ্রতি ১০ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। সরকারের বেঁধে দেওয়া দেশি পেঁয়াজের খুচরা মূল্য প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ৬৫ টাকা হলেও বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকায়। সম্প্রতি ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির খবরে দাম কমতে শুরু করে। এক সপ্তাহ আগে যে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১১০-১২০ টাকা কেজিতে, গত দু’দিন সেই পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৮০-৮৫ টাকায়। তবে রোজার আগ মুহূর্তে শুক্রবার থেকে আবারও দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকায়। বিক্রেতারা বলছেন, গতকাল (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত দেশি পেঁয়াজ ৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি করলেও শুক্রবার ৯০ টাকা করে বিক্রি করছে। এই দামে বিক্রি করলেও কোনো লাভ থাকছে না।

রবিউল আলম নামে এক বিক্রেতা বলেন, বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ কম। কারণ মুড়িকাটা পেঁয়াজ একেবারে শেষ দিকে। এ কারণে বাড়তি দাম যাচ্ছিল পেঁয়াজের। প্রধান জাতের পেঁয়াজ অর্থাৎ হালিকাটা পেঁয়াজ বাজারে পর্যাপ্ত এলেই দাম কমে যেত। এর মধ্যে ভারত থেকে পেঁয়াজ আসার খবরে এখনই দাম কমতে শুরু করেছে। আশা করছি, ৪-৫ রোজা থেকেই পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি আরও ১০-১৫ টাকা কমে যাবে।

জানা গেছে, দেশে বছরে চিনির চাহিদা ২০ লাখ টন। স্বাভাবিক সময়ে মাসে চাহিদা থাকে দেড় লাখ টন। আর রমজানে চাহিদা ৩ লাখ টন।
এদিকে রমজান মাসকে সামনে রেখে সরকার চিনির আমদানি শুল্ক কমিয়েছে। তবে বাজারে এর কোনো প্রভাব নেই, উল্টো দাম বাড়ার প্রবণতা দেখা গেছে। এর ওপর নতুন করে একটি সুগার মিলের অগ্নিকাণ্ডকে পুঁজি করে বাজারে চিনির কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

বাজারঘুরে দেখা গেছে, গত এক সপ্তাহ আগেও যেখানে খোলা চিনি কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা পর্যন্ত, সেখানে রোজার আগ মুহূর্তে কেজিপ্রতি চিনির দাম উঠেছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা।

মিস্ত্রিপাড়া বাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, চিনির দাম পাইকারিতে কিছুটা বেড়েছে। আমাদের যদি বেশি দামে কিনে আনতে হয়, দাম বাড়ানো ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। তবে বাজারে সরবরাহের যেহেতু বড় সংকট নেই, তাই দাম আর বাড়ার আশঙ্কা কম।

রমজান মাসকে ঘিরে অন্যান্য দ্রব্যের ন্যায় লাগামহীন দামের আঁচ পড়ছে ডাল, ছোলা আর বেসনের দামে। ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, গত কয়েকদিনে ডালের দাম কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। একই হারে বেড়েছে বেসনের দাম। ভালো মানের ছোলার দামও নতুন করে কেজিতে ২ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে ছোলার দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে এখন ১০০ টাকা থেকে ১১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বুটের ডালের দামও কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে এখন ১০০ টাকা। কয়েকদিন আগেও ১২০-১৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি হওয়া ছোট দানার মসুর ডালের দাম বেড়ে হয়েছে ১৪০-১৪৫ টাকা। মাঝারি দানার মসুর ডালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৩০ টাকায়, যা কিছুদিন আগেও ছিল ১১০-১১৫ টাকা কেজি।

এদিকে ডালের দাম বাড়ায় বেড়েছে বেসনের দামও। বুটের ডালের বেসন বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায়, যা কিছুদিন আগে ছিল ১০০ থেকে ১১০ টাকার মধ্যে। আর অ্যাংকর ডালের বেসন বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকা কেজিতে, যা কিছুদিন আগে ছিল ৭০ টাকার মধ্যে।

রমজানের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় দ্রব্য ছোলা। রমজান উপলক্ষে ভারত থেকে এক সপ্তাহে ১ হাজার ৪০৩ টন ছোলা আমদানি করা হয়েছে। সরকার ব্যবসায়ীদের শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচা ছোলা আমদানির সুযোগ দিলেও তার সুফল পাচ্ছেন না ক্রেতারা।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ছোলা বিক্রি হচ্ছে ১০৫ থেকে ১১০ টাকা কেজি দরে। গত বছর বাজারে এ সময় ছোলার কেজি ছিল ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। সেই হিসাবে এবার কেজিতে দাম বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের দাম বেশি হওয়ায় ছোলা আমদানি করতে হয়েছে বেশি দামে। যে কারণে দামও তুলনামূলক একটু বেশি। তবে রোজা শুরু হলেই আবার দাম কমে আসবে।

বাজারঘুরে দেখা গেছে, রমজান মাসকে ঘিরে প্রতিটি পণ্যে বাড়তি দাম থাকলেও প্রত্যেকেই চাহিদা মতো কেনাকাটা করছেন। তবে দাম প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলেই ক্রেতাদের মধ্যে দেখা গেছে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ। ভোক্তাদের ভাষ্য, বাজারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যে কারণে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জনগণের পকেট কাটছে। সরকার খুচরা পর্যায়ে লোক দেখানো কিছু অভিযান পরিচালনা করলেও সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে রাঘব-বোয়ালরা।
তবে বাজারে বেশ কিছু সবজির দাম কমেছে। এসব সবজির মধ্যে রয়েছে মটরশুঁটি, ঢ্যাঁড়স, পটোল, উচ্ছে। এগুলোর দাম কমেছে ২০ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত। আবার রোজায় চাহিদা বেশি থাকে এমন সবজির দাম বেড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আলু ও সব ধরনের বেগুন। এই দুই সবজির দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৫ টাকা ও ২০ টাকা। এসব সবজি ছাড়া অন্যান্য সবজির দাম কিছুটা বাড়া-কমা বা অপরিবর্তিত রয়েছে।

নগরীর বিভিন্ন বাজারে শিম ৬০ টাকা, টমেটো ৫০ টাকা, পেঁয়াজ কলি ৪০ টাকা, মটরশুঁটি ৬০ টাকা, সাদা মুলা ৬০ টাকা, দেশি গাজর ৪০ টাকা, লম্বা বেগুন ৮০ টাকা, সাদা গোল বেগুন ৮০ টাকা, কালো গোল বেগুন ৮০ টাকা, শসা ৬০-৮০ টাকা, খিরাই ৪০ টাকা, উচ্ছে ১০০ টাকা, করলা ১৬০ টাকা, পেঁপে ৪০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৩০ টাকা, ঢ্যাঁড়স ১০০ টাকা, পটোল ১০০ টাকা, চিচিঙা ৬০ টাকা, ধুন্দল ৬০ টাকা, বরবটি ১২০ টাকা, কচুর লতি ১০০ টাকা, সজনে ২০০ টাকা, কচুরমুখী ১২০, কাঁচামরিচ ১০০ টাকা, ধনেপাতা ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতিটি লাউ ১০০ টাকা, ফুলকপি ৫০ টাকা, বাঁধাকপি ৫০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।
কমেনি নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোজ্য তেল সয়াবিন। বাজারে ফ্রেশ, তীর, বসুন্ধরা সয়াবিন (৫ লিটার) বিক্রি হচ্ছে ৮৪০ টাকা দরে। যা লিটার প্রতি বিক্রি হচ্ছে ১৬৮ টাকা দরে। এখনো চড়ামূল্যে বিক্রি হচ্ছে ডাল। প্রতিকেজি মশুর ডাল (চিকন) ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা, মশুর ডাল (মোটা) ১১০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

কমছে না চালের দাম। দীর্ঘদিন ধরে চালের বাজার স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। শুক্রবার নগরীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে প্রতিকেজি স্বর্না মোটা চাল ৪৮ থেকে ৫০, ২৮ বালাম ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, মিনিকেট ভালোমানের ৬৮ টাকা, নিম্নমানের ৬০ টাকা, বাসমতি ৭৮ থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।

মহানগরীর এ্যাপ্রোচ রোডস্থ কেসিসি সুপার মার্কেটে আসা ক্রেতা সফিকুল ইসলাম বলেন, ভোজ্য সয়াবিন তেল, চিনি ও পেঁয়াজের মূল্য এখনো নাগালের বাইরে। যারা নিম্নআয়ের মানুষ তাদের জন্য এসব পণ্য সামগ্রী ক্রয় করা খুব কষ্টকর। তিনি বলেন, সামনে রমজান মাস। তাই রমজানের আগে আগে নিত্যপ্রয়োজনীয় এসব পণ্যের পাশাপাশি অন্যান্য জিনিসের দাম যাতে নিয়ন্ত্রণে আসে এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তিনি।

নগরীর ময়লাপোতাস্থ কেসিসি সন্ধ্যা বাজারে আসা ক্রেতা মৎস্য ব্যবসায়ী মোঃ শরিফুল ইসলাম বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ও পণ্যের দাম খুবই চড়া। তিনি বলেন, রোজার মাসে পণ্য সামগ্রীর দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত।

অপর ব্যবসায়ী মো. রবিউল ইসলাম বলেন, বাজারে সবজির সরবরাহ আছে। তবে বেশি দামে সবজি কিনতে হয়। ফলে খুচরা বাজারে দাম বেশি। অপর ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, প্রতিকেজি আলু ৩০ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। আরেক ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম বলেন, সবজির সরবরাহ আছে। সবজির মূল্য আগের চেয়ে অনেকটা কমে গেছে। তবে অন্য সব পণ্যেরই দাম বেড়েছে।

 

জনপ্রিয় সংবাদ

বিচার না হওয়া পর্যন্ত, আমরা রাজপথ ছাড়ব না: জুমা

খুলনায় রমজান ঘিরে খেজুর, চাল, ডাল, পেঁয়াজে চাপ

আপডেট সময় : ০৬:৪৩:৩৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১০ মার্চ ২০২৪

পবিত্র মাহে রমজান মাসটি ঘিরে খুলনায় খেজুর, চাল, ডাল, ছোলা, বেসন, চিনি ও পেঁয়াজের ওপর একটু বেশি চাপ পড়েছে। রোজা শুরুর এক সপ্তাহ আগে থেকেই বাজার ঘুরে শুরু হয়েছে কেনাকাটা। তবে ক্রেতাদের পূর্ব প্রস্তুতিতে প্রতিবারের মতো এবারও দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বিক্রেতারা। বরাবরের মতো এবারও রোজার আগেই বাজারে সক্রিয় হয়েছে অতিমুনাফালোভী চক্র।

নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যে ক্রেতাদের মধ্যে অসন্তোষ ছিল লক্ষণীয়। আলু, দেশি রসুন, বেগুন, সব ধরনের মুরগির গোশত, গরুর গোশত এবং প্রায় সব ধরনের ডাল বিক্রি হচ্ছে বেশি দামে।

বাজার করতে আসা ক্রেতারা বলছেন, সরকার রোজায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকবে বললেও সেটা হচ্ছে না। সবকিছুর দামই বেড়েছে। অন্যদিকে বিক্রেতারা বলছেন, ক্রেতারা বেশি চাহিদা দেখাচ্ছে বলেই সবকিছুর দাম বাড়তি।

দুই মাসের ব্যবধানে বিভিন্ন বাজার ও এলাকার মুদি দোকানে প্রতি কেজি ছোলা, মুড়ি, খেজুর, বেসন, সরিষার তেল, বুটের ডালের দাম ১০-৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। আর শরবত তৈরির উপকরণ ইসবগুলের ভুসির দাম কেজিতে ৫০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া রমজাননির্ভর বিভিন্ন খাদ্যপণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত আলু, ধনেপাতা, পুদিনাপাতা, ট্যাং, রুহ-আফজার দামও অহেতুক বাড়ানো হয়েছে।

শুক্রবার নগরীর মিস্ত্রিপাড়া, শেখপাড়া, বয়রা ও গল্লামারী এলাকার বিভিন্ন বাজার ঘুরে খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা, যা ২ মাস আগেও ৯০ টাকা ছিল। বাজারে মান ও দাম ভেদে সাদা মুড়ি বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে গত ২ মাস আগে যে মুড়ি ৮০ টাকা ছিল তা এখন ১১০/১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি মাঝারিমানের তিউনিশিয়ান খেজুর বিক্রি হয়েছে ৬০০ টাকা। যা ২ মাস আগে ৩০০-৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়। মান ও বাজারভেদে প্রতি কেজি বেসন বিক্রি হচ্ছে ৭০-১০০ টাকা, যা আগে ৬০-৮০ টাকায় বিক্রি হয়। বুটের ডাল প্রতি কেজি বিক্রি হয় ১১০ টাকা। যা আগে ৯০ টাকা বিক্রি হয়েছিল।
এছাড়া ইফতারে শরবত তৈরিতে ব্যবহৃত ইসবগুলের ভুসি ট্যাং, রুহ-আফজার দামও বাড়ানো হয়েছে। প্রতি কেজি ইসবগুলের ভুসি দুই মাস আগে ১৬০০ টাকা বিক্রি হলেও এখন ২১০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি প্যাকেটজাত ট্যাং বিক্রি হয়েছে ৮৫০ টাকা, যা আগে ৮০০ টাকা ছিল। বড় সাইজের রুহ-আফজা বিক্রি হচ্ছে ৫০০-৫৫০ টাকা। যা আগে ৩৫০ টাকা ছিল। ছোট সাইজের রুহ-আফজা বিক্রি হচ্ছে ২৮০-৩০০ টাকা, যা আগে ২০০ টাকা ছিল।

সরেজমিনে দেখা গেছে, চিনি, চাল-ডালসহ প্রতিটি পণ্যের দাম সপ্তাহ ব্যবধানে কেজিপ্রতি ১০ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। সরকারের বেঁধে দেওয়া দেশি পেঁয়াজের খুচরা মূল্য প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ৬৫ টাকা হলেও বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকায়। সম্প্রতি ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির খবরে দাম কমতে শুরু করে। এক সপ্তাহ আগে যে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১১০-১২০ টাকা কেজিতে, গত দু’দিন সেই পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৮০-৮৫ টাকায়। তবে রোজার আগ মুহূর্তে শুক্রবার থেকে আবারও দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকায়। বিক্রেতারা বলছেন, গতকাল (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত দেশি পেঁয়াজ ৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি করলেও শুক্রবার ৯০ টাকা করে বিক্রি করছে। এই দামে বিক্রি করলেও কোনো লাভ থাকছে না।

রবিউল আলম নামে এক বিক্রেতা বলেন, বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ কম। কারণ মুড়িকাটা পেঁয়াজ একেবারে শেষ দিকে। এ কারণে বাড়তি দাম যাচ্ছিল পেঁয়াজের। প্রধান জাতের পেঁয়াজ অর্থাৎ হালিকাটা পেঁয়াজ বাজারে পর্যাপ্ত এলেই দাম কমে যেত। এর মধ্যে ভারত থেকে পেঁয়াজ আসার খবরে এখনই দাম কমতে শুরু করেছে। আশা করছি, ৪-৫ রোজা থেকেই পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি আরও ১০-১৫ টাকা কমে যাবে।

জানা গেছে, দেশে বছরে চিনির চাহিদা ২০ লাখ টন। স্বাভাবিক সময়ে মাসে চাহিদা থাকে দেড় লাখ টন। আর রমজানে চাহিদা ৩ লাখ টন।
এদিকে রমজান মাসকে সামনে রেখে সরকার চিনির আমদানি শুল্ক কমিয়েছে। তবে বাজারে এর কোনো প্রভাব নেই, উল্টো দাম বাড়ার প্রবণতা দেখা গেছে। এর ওপর নতুন করে একটি সুগার মিলের অগ্নিকাণ্ডকে পুঁজি করে বাজারে চিনির কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

বাজারঘুরে দেখা গেছে, গত এক সপ্তাহ আগেও যেখানে খোলা চিনি কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা পর্যন্ত, সেখানে রোজার আগ মুহূর্তে কেজিপ্রতি চিনির দাম উঠেছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা।

মিস্ত্রিপাড়া বাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, চিনির দাম পাইকারিতে কিছুটা বেড়েছে। আমাদের যদি বেশি দামে কিনে আনতে হয়, দাম বাড়ানো ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। তবে বাজারে সরবরাহের যেহেতু বড় সংকট নেই, তাই দাম আর বাড়ার আশঙ্কা কম।

রমজান মাসকে ঘিরে অন্যান্য দ্রব্যের ন্যায় লাগামহীন দামের আঁচ পড়ছে ডাল, ছোলা আর বেসনের দামে। ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, গত কয়েকদিনে ডালের দাম কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। একই হারে বেড়েছে বেসনের দাম। ভালো মানের ছোলার দামও নতুন করে কেজিতে ২ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে ছোলার দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে এখন ১০০ টাকা থেকে ১১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বুটের ডালের দামও কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে এখন ১০০ টাকা। কয়েকদিন আগেও ১২০-১৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি হওয়া ছোট দানার মসুর ডালের দাম বেড়ে হয়েছে ১৪০-১৪৫ টাকা। মাঝারি দানার মসুর ডালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৩০ টাকায়, যা কিছুদিন আগেও ছিল ১১০-১১৫ টাকা কেজি।

এদিকে ডালের দাম বাড়ায় বেড়েছে বেসনের দামও। বুটের ডালের বেসন বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায়, যা কিছুদিন আগে ছিল ১০০ থেকে ১১০ টাকার মধ্যে। আর অ্যাংকর ডালের বেসন বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকা কেজিতে, যা কিছুদিন আগে ছিল ৭০ টাকার মধ্যে।

রমজানের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় দ্রব্য ছোলা। রমজান উপলক্ষে ভারত থেকে এক সপ্তাহে ১ হাজার ৪০৩ টন ছোলা আমদানি করা হয়েছে। সরকার ব্যবসায়ীদের শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচা ছোলা আমদানির সুযোগ দিলেও তার সুফল পাচ্ছেন না ক্রেতারা।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ছোলা বিক্রি হচ্ছে ১০৫ থেকে ১১০ টাকা কেজি দরে। গত বছর বাজারে এ সময় ছোলার কেজি ছিল ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। সেই হিসাবে এবার কেজিতে দাম বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের দাম বেশি হওয়ায় ছোলা আমদানি করতে হয়েছে বেশি দামে। যে কারণে দামও তুলনামূলক একটু বেশি। তবে রোজা শুরু হলেই আবার দাম কমে আসবে।

বাজারঘুরে দেখা গেছে, রমজান মাসকে ঘিরে প্রতিটি পণ্যে বাড়তি দাম থাকলেও প্রত্যেকেই চাহিদা মতো কেনাকাটা করছেন। তবে দাম প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলেই ক্রেতাদের মধ্যে দেখা গেছে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ। ভোক্তাদের ভাষ্য, বাজারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যে কারণে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জনগণের পকেট কাটছে। সরকার খুচরা পর্যায়ে লোক দেখানো কিছু অভিযান পরিচালনা করলেও সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে রাঘব-বোয়ালরা।
তবে বাজারে বেশ কিছু সবজির দাম কমেছে। এসব সবজির মধ্যে রয়েছে মটরশুঁটি, ঢ্যাঁড়স, পটোল, উচ্ছে। এগুলোর দাম কমেছে ২০ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত। আবার রোজায় চাহিদা বেশি থাকে এমন সবজির দাম বেড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আলু ও সব ধরনের বেগুন। এই দুই সবজির দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৫ টাকা ও ২০ টাকা। এসব সবজি ছাড়া অন্যান্য সবজির দাম কিছুটা বাড়া-কমা বা অপরিবর্তিত রয়েছে।

নগরীর বিভিন্ন বাজারে শিম ৬০ টাকা, টমেটো ৫০ টাকা, পেঁয়াজ কলি ৪০ টাকা, মটরশুঁটি ৬০ টাকা, সাদা মুলা ৬০ টাকা, দেশি গাজর ৪০ টাকা, লম্বা বেগুন ৮০ টাকা, সাদা গোল বেগুন ৮০ টাকা, কালো গোল বেগুন ৮০ টাকা, শসা ৬০-৮০ টাকা, খিরাই ৪০ টাকা, উচ্ছে ১০০ টাকা, করলা ১৬০ টাকা, পেঁপে ৪০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৩০ টাকা, ঢ্যাঁড়স ১০০ টাকা, পটোল ১০০ টাকা, চিচিঙা ৬০ টাকা, ধুন্দল ৬০ টাকা, বরবটি ১২০ টাকা, কচুর লতি ১০০ টাকা, সজনে ২০০ টাকা, কচুরমুখী ১২০, কাঁচামরিচ ১০০ টাকা, ধনেপাতা ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতিটি লাউ ১০০ টাকা, ফুলকপি ৫০ টাকা, বাঁধাকপি ৫০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।
কমেনি নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোজ্য তেল সয়াবিন। বাজারে ফ্রেশ, তীর, বসুন্ধরা সয়াবিন (৫ লিটার) বিক্রি হচ্ছে ৮৪০ টাকা দরে। যা লিটার প্রতি বিক্রি হচ্ছে ১৬৮ টাকা দরে। এখনো চড়ামূল্যে বিক্রি হচ্ছে ডাল। প্রতিকেজি মশুর ডাল (চিকন) ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা, মশুর ডাল (মোটা) ১১০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

কমছে না চালের দাম। দীর্ঘদিন ধরে চালের বাজার স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। শুক্রবার নগরীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে প্রতিকেজি স্বর্না মোটা চাল ৪৮ থেকে ৫০, ২৮ বালাম ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, মিনিকেট ভালোমানের ৬৮ টাকা, নিম্নমানের ৬০ টাকা, বাসমতি ৭৮ থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।

মহানগরীর এ্যাপ্রোচ রোডস্থ কেসিসি সুপার মার্কেটে আসা ক্রেতা সফিকুল ইসলাম বলেন, ভোজ্য সয়াবিন তেল, চিনি ও পেঁয়াজের মূল্য এখনো নাগালের বাইরে। যারা নিম্নআয়ের মানুষ তাদের জন্য এসব পণ্য সামগ্রী ক্রয় করা খুব কষ্টকর। তিনি বলেন, সামনে রমজান মাস। তাই রমজানের আগে আগে নিত্যপ্রয়োজনীয় এসব পণ্যের পাশাপাশি অন্যান্য জিনিসের দাম যাতে নিয়ন্ত্রণে আসে এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তিনি।

নগরীর ময়লাপোতাস্থ কেসিসি সন্ধ্যা বাজারে আসা ক্রেতা মৎস্য ব্যবসায়ী মোঃ শরিফুল ইসলাম বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ও পণ্যের দাম খুবই চড়া। তিনি বলেন, রোজার মাসে পণ্য সামগ্রীর দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত।

অপর ব্যবসায়ী মো. রবিউল ইসলাম বলেন, বাজারে সবজির সরবরাহ আছে। তবে বেশি দামে সবজি কিনতে হয়। ফলে খুচরা বাজারে দাম বেশি। অপর ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, প্রতিকেজি আলু ৩০ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। আরেক ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম বলেন, সবজির সরবরাহ আছে। সবজির মূল্য আগের চেয়ে অনেকটা কমে গেছে। তবে অন্য সব পণ্যেরই দাম বেড়েছে।