ঈদের খুশি পরিবারের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ঢাকা ছাড়ছে কর্মজীবী মানুষ। গতকাল রোববার রেলস্টেশন, সদরঘাটে অবস্থিত লঞ্চ টার্মিনাল ও বাস টার্মিনালগুলোতে যাত্রীর যথেষ্ট চাপ লক্ষ্য করা গেছে। যাত্রীদের নিজেদের ব্যাগ, ট্রলি নিয়ে স্টেশনে স্টেশনে নির্ধারিত ট্রান্সপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। অনেকেই পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে নিয়ে ভিড় করছেন রাজধানীর স্টেশনগুলোতে। সবার চোখে-মুখে এক পরম তৃপ্তি, ফিরছেন স্বপ্নের নীড়ে। যেখানে অপেক্ষায় আছে স্বজন। কেউ ছুটছেন প্রিয় মা-বাবার কাছে। কেউ ছুটছেন ভাইবোনদের কাছে। কেউ ছুটছেন ফেলে আসা শৈশবের ছোঁয়া পেতে।
ঈদের ছুটির শুরুর মুহুর্তে প্রচণ্ড ভিড় হয় তাই, কেউ কেউ পরিবার-পরিজনদের আগেই বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। অফিসের ছুটি পাওয়া সাপেক্ষে একা একা বাড়ি ফিরছেন। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান আগে ছুটি হয়ে যাওয়ায় বহু শিক্ষার্থী আগেই বাড়ি পৌঁছেছে। এখন বাড়ি ফিরছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা। এদিকে, গার্মেন্ট কর্মীদের ছুটি শুরু হচ্ছে। তাই, এবার পথে চাপ বাড়বে বলে মনে করছেন, পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। এবার ঈদের সঙ্গেই বাংলা নববর্ষ হওয়ায় সরকারি চাকরিজীবীদের ছুটি বেড়ে পাঁচ দিন হয়েছে। আর দেশের গণমাধ্যম কর্মীরা এবার প্রথমবারের মতো টানা ছয়দিনের ছুটি পাচ্ছে। অনেকেই তাদের এক-দুই দিনের ছুটি ম্যানেজ করে গতকাল রোববার ঢাকা ছেড়েছেন।
গতকাল নগরীর কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে বাঁশ দিয়ে তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কমলাপুর রেলস্টেশনের গেট দিয়ে ঢুকতেই প্রথমেই বাঁশের গেট পার হতে হচ্ছে যাত্রীদের। এসময় সংশ্লিষ্ট টিকিট চেকার যাত্রীর টিকিট চেক করে তাকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছেন। এরপর যাত্রীকে আবারো টিকিট চেকারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। পরবর্তীতে আবার প্ল্যাটফর্মে ঢোকার মুখে টিকিট চেক করা হচ্ছে। তিন স্তরের নিরাপত্তা শেষে একজন যাত্রী ট্রেনে ওঠার জন্য অপেক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন।
রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে যাত্রীদের প্রচণ্ড ভিড় দেখা যায়। সকাল ১০টার দিকে দেখা যায়, ট্রেনের শিডিউল বিপর্র্যয় তখনও শুরু হয়নি। কিন্তু এ সুখবর দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিডিউল বিপর্যয় দেখা যায়।
প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষারত নকশিকাঁথা এক্সপ্রেসের যাত্রী সোহেল আহমেদ বলেন, রাস্তার জ্যামের ঝুঁকি এড়াতে সকালেই স্টেশনের উদ্দেশে রওয়ানা দিয়েছেন। সকাল ৯টায় স্টেশনে পৌঁছেছেন। টানা চার ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছেন।
রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রাজশাহীগামী বনলতা এক্সপ্রেসের যাত্রী মোরশেদা ইয়াসমিন ঝুমু বলেন, এবার ঈদে ছুটি পেয়েছি, তাই বাড়ি যেতে পারছি। বাড়িতে বাবা-মা আছেন। ভাইবোন, আঙ্কেল-আন্টিরা আছেন। আমি তো চাকরির প্রয়োজনে ঢাকায় থাকি কিন্তু আমার মন পড়ে থাকে বাড়িতে। তাই ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। চার মাস আগে বাড়ি গেছি। এবার আবার বাড়ি যাচ্ছি। বাড়িতে সবাই আমার জন্য অপেক্ষায় আছে। এটাই আমার জন্য অন্যরকম একটা আনন্দ।
খুুলনাগামী নকশিকাঁথা এক্সপ্রেস ট্রেনটি কমলাপুর রেলস্টেশনের ৮ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছেড়ে যায়। কিন্তু এই প্ল্যাটফর্মে বসার জন্য কোনো সিটের ব্যবস্থা নেই।
ফলে, বিপদে পড়তে হয় যাত্রীদের। অনেককেই মেঝেতে বসে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। ট্রেনটি ১১টা ৪০ মিনিটে ছেড়ে যাবার কথা ছিল। কিন্তু ট্রেনটি পৌনে ৩ ঘণ্টা দেরিতে বেলা ২টা ২৭ মিনিটে ঢাকা ছেড়েছে। যাত্রীদের মধ্যে অনেকেই ফুরফুরে মেজাজে ছিলেন আবার অনেকে অপেক্ষা করতে করতে ভীষণ ক্লান্তি অনুভব করেন। এ প্রসঙ্গে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মাসুদ সারওয়ার বলেন, পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ট্রেনে প্রতিদিন প্রায় ২ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়ছেন। আমরা এখন পর্যন্ত রেলের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ধরে রাখতে পেরেছি। আগামী দুই দিন যাত্রীর চাপ আরো বাড়বে। তখনও এমন পরিবেশ থাকবে বলে প্রত্যাশা করছি।
তিনি জানান, গতকাল কমলাপুর ও এর আশপাশের স্টেশন থেকে ৬৯টি ট্রেন ছেড়ে গেছে। এর মধ্যে ৪৪টি আন্তঃনগর ট্রেনের যাত্রীসংখ্যা ৩৩ হাজার ৫০০ জন। এছাড়া লোকাল, মেইল ও কমিউটার ট্রেন রয়েছে। এবছর আগে থেকেই ট্রেনের ছাদে কোনো যাত্রীর যাতায়াত সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রয়েছে।
চট্টগ্রামগামী ট্রেনের যাত্রী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সুখেলা বর্ধন বলেন, ঈদ আসবে আর বাড়ি যাব না এটা হতেই পারে না। বাড়িই হচ্ছে আমার আসল ঠিকানা। এবার ট্রেনের টিকেট পাব কি না তা নিয়ে ভয়ে ছিলাম। এখন পর্যন্ত ট্রেনের কোনো শিডিউল বিপর্যয় হয়নি শুনে স্বস্তিতে আছি। আশা করছি, নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে যাব।
রাজধানীর গাবতলী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালে দুপুরে গেলে দেখা যায়, সেখানে বিভিন্ন জেলার বাস দাঁড়িয়ে আছে। বাসের হেলপাররা যাত্রীদের নিজ জেলায় যাবার জন্য ডাকছেন। যাত্রীরা এসে নির্ধারিত বাসের টিকিট কেটে উঠছেন। এসময় এই টার্মিনালে তেমন ভিড় দেখা যায়নি।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে এসেছেন জোহরা-সাজিদুর দম্পতি। সঙ্গে দুই সন্তান। জোহরা জাহান, ঢাকার একটি কোচিংয়ে দুজনে শিক্ষকতা করেন, জোহরা বলেন, আমরা বগুড়া যাব। বাস এবং ট্রেনের টিকিট কাটার চেষ্টা করেছি, পাইনি। তাই এখন এই লোকাল বাস ধরেই যাব। ভাড়া একটু বেশি নিচ্ছে। কিছু করার নাই। ঈদে বাড়ি যেতে চাইলে ভাড়া বেশি দিতেই হবে।
বাসের কাউন্টারগুলো সকালের দিকে বেশ ফাঁকা থাকলেও দুপুরের দিকে ভিড় বাড়তে থাকে। কোনো সিএনজি বা রিকশা নিয়ে যাত্রী এলেই তাদের নিয়ে টানা হেঁচড়া শুরু করে হেলপাররা। আবার যখন দেখে এই যাত্রী তার রুটের না তখন ঐ যাত্রীকে দ্রুত ছেড়ে দিয়ে অন্য যাত্রীর দিকে দৃষ্টি দেয়।
টার্মিনালগুলোতে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি), রেল পুলিশ, র্যাব, ফায়ার সার্ভিস, বিআরটিএ’র কর্মকর্তাদের সরব উপস্থিতি দেখা গেছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল পরিদর্শন করেন। এসময় সাংবাদিকদের তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্য কমার পর দূরপাল্লার বাসে নতুন ভাড়া নির্ধারণের পরও যেসব কোম্পানি কাউন্টারে এখনো তালিকা প্রকাশ করেনি তাদেরকে সতর্ক করা হচ্ছে। কোনো কোম্পানি বাস যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া নিলে তাদেরকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে আইনের আওতায় আনা হবে।
ইদযাত্রায় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা জানিয়ে হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত আইজি মো. শাহাবুদ্দিন খান বলেছেন, বিগত যেকোনো বছরের চেয়ে এবারের ঈদযাত্রা অনেক বেশি নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় হবে। পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে, ঈদের দিন ও ঈদের পরে, এই তিন স্তরের পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি। এছাড়াও আমরা প্রযুক্তিগতভাবেও এবার সড়ক পরিদর্শন করছি। ড্রোনের সাহায্যে সড়কে নজরদারি করছি।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, সারা দেশে ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে নৌপথ, রেলপথ ও সড়কপথে পুলিশের কয়েক হাজার সদস্যকে তৎপর রাখা হয়েছে। এছাড়া নৌপথে বিশেষ নিরাপত্তায় টহল ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। ঈদের মৌসুমে নগরীতে চোর, ছিনতাইকারী, মলম পার্টি ও অজ্ঞান পার্টির বিরুদ্ধে কাজ করছে পুলিশ। তিনি বলেন, কেউ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে যানবাহনে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে আরোহণ করবেন না।




















