◉ রাজধানীতে একজন রিকশাচালকের মৃত্যু
◉ রোগীর প্রচণ্ড চাপ শিশু হাসপাতালে, শয্যা সংকট
◉ গরমে স্যালাইনের চাহিদা তুঙ্গে
সহসা কমছেনা রোদের তীব্রতা। তীব্র রোদ আর প্রচণ্ড গরম থেকে বাঁচতে সাবধানতা অবলম্বন করেই কাটাতে হবে আগামী আরও তিনদিন। এমনটিই জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এর আগে জারি করা ‘হিট এলার্টের সময় আরও বাড়িয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
প্রচণ্ড গরমে সাধারণ জীবনযাপন চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ রাস্তায় বের হচ্ছে না। এদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে স্কুল-কলেজ ছুটি দেয়ায় অভিভাবকরা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে। তবে, শ্রমজীবী ও কর্মজীবী মানুষকে জীবিকার প্রয়োজনে রাস্তায় নামতেই হচ্ছে। রাস্তায় সবচেয়ে বিপদে আছে রিকশাচালক, গণ পরিবহনের চালক, সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী, ট্রাফিক পুলিশ, পুলিশ ও গণমাধ্যমকর্মীরা। এরা তীব্র রোদ ও তাপের মধ্যেই তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় চরম অস্বস্তিকর সময় কাটাচ্ছে কৃষকেরা। কেননা, তীব্র খরা এবং প্রচণ্ড গরমে ধান, সবজি খেতসহ ফসলের খেতগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। সেখানে পর্যাপ্ত পানির যোগান দেয়া কৃষকের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
গতকাল সোমবার সকালে আগামী ৭২ ঘণ্টার জন্য নতুন সতর্কবার্তা দিয়েছে। সতর্কবার্তায় আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ জানান, দেশের ওপর দিয়ে চলমান তাবদাহ ২২ এপ্রিল থেকে পরবর্তী ৭২ ঘন্টা অর্থাৎ ২৫ এপ্রিল সকাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। এর আগে, গত ১৯ এপ্রিলও তিন দিনের হিট অ্যালার্ট তথা তাপপ্রবাহের সতর্কতা জারি করেছিল অধিদফতর। তখন দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছিল, এপ্রিলে ছয়টির মতো তাপপ্রবাহের শঙ্কা রয়েছে। এর মধ্যে একটি হতে পারে অতি তীব্র। এ সময় তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যেতে পারে।
দেশের দুই বিভাগের তাপমাত্রা কমতে পারে। অন্যত্র তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকবে। এদিকে তিন বিভাগে বৃষ্টিপাত হতে পারে। এদিকে, গতকাল সোমবার ঢাকা মেডিকেল নার্সিং কলেজের পেছনের রাস্তায় আব্দুল আওয়াল (৪৫) নামে এক রিকশা চালকের মৃত্যু হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে হিট স্ট্রোকে তার মৃত্যু হয়েছে। বিকেলে ওই রিকশা চালক অচেতন হয়ে গেলে আশপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। পরীক্ষ-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ প্রসঙ্গে শাহবাগ থানার উপ পরিদর্শক (এসআই) সুমন বসাক বলেন, অচেতন অবস্থায় ওই রিকশা চালককে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
রাজধানীতে পুলিশের উদ্যোগে পথচারিদের বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ করতে দেখা গেছে। তবে, দুই সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলরদের পক্ষ থেকে পথচারিদের পানি খাওয়ানোর উদ্যোগ বা গরম প্রতিরোধে কোন ধরণের উদ্যোগ চোখে পড়েনি। আবহাওয়াবিদ মো. শাহীনুল ইসলাম জানিয়েছেন, আজ মঙ্গলবার সিলেট বিভাগের দু’এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা/ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সে সঙ্গে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলা বৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে।
তীব্র গরমে নাকাল শিশুরা : গরমে রাজধানীর শিশু হাসপাতালে প্রতিদিন বেড়েই চলছে রোগীর চাপ। ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, ঠান্ডা কাশি, জ্বর, অ্যাজমাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। রোগীর চাপ বাড়ার কারণে রাজধানীর শিশু হাসপাতালে শয্যা সংকট দেখা দিয়েছে। রাজধানীর আগারগাঁও শিশু হাসপাতালে, গত ২৪ ঘণ্টায় আউটডোরে ৩২ জন নিউমোনিয়া রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৯ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এখনো ভর্তি আছে ৮৭ জন। চলতি বছরে মোট ভর্তি রোগী এক হাজার ৮৯৮ জন।
সাধারণ জ্বরে ২৪ ঘণ্টায় আউটডোরে ১৮৯ জন চিকিৎসা নিয়েছে। অ্যাজমায় ২৩ জন, স্ক্যাবিস এবং স্কিন ডিজিজে ৬৬ জন এবং ১০৯ জন চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন। এছাড়াও ডায়রিয়ায় গত ২৪ ঘণ্টায় আউটডোরে ৫৩ জন চিকিৎসা নিয়েছে, একজন নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, বর্তমানে ভর্তি আছেন পাঁচজন। চলতি বছরে ডায়রিয়া হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে মোট ৩৮০ জন। পাশাপাশি ঢাকা শিশু হাসপাতালে আউটডোরে ইমার্জেন্সিতে ২৪৮ জন রোগী, মেডিসিন বিভাগে ৬৮১ জন এবং সার্জারি বিভাগে ১৬৪ জনসহ মোট এক হাজার ৯৩ জন চিকিৎসা নিয়েছে।
গরমে সুস্থ থাকতে প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি ও তরল খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। পাশাপাশি বাইরের খোলা খাবার শরবত খাওয়া থেকে বিরত থাকতে এবং প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না হওয়া এবং প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি ও তরল খাবার খাওয়ার পরামর্শও দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। শিশু হাসপাতালে একজন চিকিৎসক বলেন, হাসপাতালের বেশিরভাগ সিট ভর্তি হয়ে গেছে। খুব ইমার্জেন্সি কিছু রোগী ভর্তি নিতেই হচ্ছে। যারা গরিব তাদের জন্য আমরা কিছু ব্যবস্থা করছি। অন্যদিকে আর্থিক অবস্থা যাদের ভালো তাদের অন্য কোনো হাসপাতালে রেফার করে দিচ্ছি।
এমন তীব্র গরমে শিশুদের যত্নের বিষয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম গণমাধ্যমকে বলেন, শিশুদের বাইরে রোদে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে হবে। ঠান্ডা ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে, পাতলা সাদা সুতি কাপড় বা খালি গায়ে রাখতে হবে। প্রচুর পরিমাণে পানি ও ফলের শরবত খাওয়ানো যেতে পারে।
তিনি বলেন, এ গরমে ঘরের দরজা জানালা খোলা রাখতে হবে। বেশিক্ষণ কোনো বাবা মা যেন খোলা জায়গায় খাবার না রাখে, ফ্রিজ থাকলে ফ্রিজে খাবার সংরক্ষণ করতে হবে। ফ্রিজ থেকে বের করে সেটা আবার গরম করে খাওয়াতে হবে। শিশুদের শরীরের ঘাম মুছে দিতে হবে। প্রয়োজনে দিনে কয়েকবার গোসল করানো যেতে পারে। ঠান্ডা ফ্রিজের পানি বা আইসক্রিম খাওয়া থেকে বাচ্চাদের এ সময় বিরত রাখতে হবে। বাচ্চারা বাইরে গেলে যেন সাদা সুতি ঢিলেঢালা পোশাক পরে যায়। পাশাপাশি সঙ্গে ছাতা এবং পানি রাখে। রাস্তার খোলা কোনো খাবার, শরবত বা পানি না খাওয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।
গরমে স্যালাইনের চাহিদা তুঙ্গে : এই গরমে অনেকের শরীরে দেখা দিচ্ছে পানিশূন্যতা। আর পানিশূন্যতা থেকে রক্ষা পেতে বেড়েছে স্যালাইনের চাহিদা। রাজধানীর মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, ধানমন্ডি এলাকার ফার্মেসি ঘুরে দেখা যায়, গরমের তীব্রতা বাড়ার কারণে ওরস্যালাইনের বিক্রি বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গরমের সময় স্বাভাবিকভাবেই স্যালাইনের চাহিদা বাড়ে। তবে এবারের অত্যধিক গরমে সে চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ।
কথা হয় শ্যামলী রোডে অবস্থিত বরিশাল ফার্মেসির কর্মচারী শাওন আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, গরম বাড়ার পর থেকে স্যালাইনের চাহিদা বাড়ছে, বিক্রিও বাড়ছে। স্যালাইন ছাড়াও গ্লুকোজ, নাপা, প্যারাসিটামল ইত্যাদি পণ্যেরও বিক্রি বেড়েছে। বেশি গরমে অনেকের শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়, অনেকের ডায়রিয়া হয়, তাই চাহিদাটাও বৃদ্ধি পায়।
টাউন হল মার্কেটের বিসমিল্লাহ ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী নাজমুল চৌধুরী বলেন, স্যালাইনের বিক্রি আগের চাইতে বেড়ে গেছে। অন্য সময় দিনে হয়তো ২ থেকে ৪ প্যাকেট স্যালাইন বিক্রি করতাম, এখন ১০ থেকে ২০ প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে। অনেকে আবার বক্সসহও কিনছেন। অধিকাংশ ফার্মেসিতে এসএমসির ওরস্যালাইন ছাড়া অন্য কোনো কোম্পানির স্যালাইন তেমন একটা দেখা যায়নি। এসএমসি স্যালাইনের চাহিদা বেশি হওয়ায় ফার্মেসিগুলো অন্য কোম্পানির স্যালাইন রাখছে না।
প্রতি প্যাকেট এসএমসি ওরস্যালাইন বিক্রি হচ্ছে ৬ টাকায় এবং একই কোম্পানির টেস্টি স্যালাইন বিক্রি হচ্ছে ৭ টাকায়। নাজমুল চৌধুরী আরো বলেন, এসিআই কোম্পানি স্যালাইন বিক্রি করলেও তার চাহিদা নেই, তাই ফার্মেসিতে রাখা হয় না। আর ইউনিভার্সাল কোম্পানির টেস্টি স্যালাইনের সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। তবে সব কোম্পানির স্যালাইনের দাম একই।
কথা হয় ফার্মেসিতে আসা ক্রেতা মামুনুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, বাসায় দুটো বাচ্চা, দুজনেই গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাই অন্যান্য ওষুধের সঙ্গে স্যালাইনও কিনে নিচ্ছি।
আদাবরের বাসিন্দা শেখ ফরিদ বলেন, গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম, তাই ওষুধ ও স্যালাইন কিনছি। ফলমূলও কিনেছি, আপাতত কিছুদিন বাসায় রেস্ট নেব।
এদিকে চিকিৎসকরা এই গরমে স্যালাইনের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে পানি, লেবুর শরবত, তরল ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। পাশাপাশি রাস্তার পাশের অস্বাস্থ্যকর ও উন্মুক্ত খাবার ও পানীয় না খাওয়ারও পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।





















