বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রতিবছর নামছে পানির স্তর। সেই সাথে বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে তাপমাত্রা। প্রতি বছর তাপপ্রবাহ শুরু পর রাজশাহী অ লে পানির সঙ্কট দেখা দেয়। চলমান তাপপ্রবাহ ও তীব্র খরায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক নিচে নেমে গেছে। এতে সুপেয় পানির জন্য হাহাকার করছ্রে বরেন্দ্র অ লের সিংহভাগ এলাকায়। টানা দাবদাহের কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে কৃষি। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এই অ লের অর্থনীতি। বরেন্দ্র অ লের পানির সঙ্কট বেশি তানোর উপজেলায়। তবে বেশ কয়েক বছর থেকে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ-নওগাঁ ও নাটোরের প্রায় সব উপজেলাতে খরা মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানি নিয়ে সঙ্কট দেখা দিতে শুরু করেছে।
তানোর উপজেলার মুণ্ডুমালা পৌরসভার একটি বড় এলাকাজুড়েই পানির সঙ্কট দীর্ঘদিনের। এখানে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। পাঁচন্দর মাহালীপড়া গ্রামের মাহালী সম্প্রদায়ের বসবাস। প্রায় এক কিলোমিটার দূর থেকে তাদের গৃহস্থালি কাজ ও খাওয়ার জন্য পানি আনতে হয়। একই চিত্র বাঘা উপজেলার শিমুলিয়া এবং পাটিয়াকন্দি গ্রামে। টিউবওয়েল ও ডিপ টিউবওয়েল দিয়ে গত প্রায় এম মাস থেকে পানি উঠছেনা। এসব গ্রামের মানুষকেও পানি সংগ্রহের জন্য দূর-দূরান্তে ছুটতে হচ্ছে। গ্রামগুলোর প্রতিটি পরিবারের দুঃখ ও কষ্টের নাম ‘পানি’। এসব গ্রামের বিভিন্ন স্থানে গভীর নলকূপ থাকলেও সেগুলো থেকে এখন পানি আর মিলছে না। এ অবস্থায় অনেকে গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমিয়েছেন। শুধু তানোর ও বাঘা নয় রাজশাহী মহানগরীতে পানির এখন এমন সমস্যা হচ্ছে। নগরীর শিরোইল এলাকায় বেশ কয়েকটি টিউবওয়েল থেকে পানি ঠিক ভাবে উঠছে না।
বাঘা উপজেলা জনস্বাস্থ্য অধিদফতরের সহকারী প্রকৌশলী মিঠন কুমার রবিদাস জানান, উপজেলায় দুই হাজার ৯৫১টি টিউবওয়েল বসানো আছে। এরমধ্যে ৫২৭টি টিউবওয়েলে বর্তমানে পানি উঠছে না। সেগুলো অকেজো হয়ে পড়ে আছে। গেল শীতেও এই টিউবওয়েল থেকে পানির সংগ্রহ করেছিল গ্রামের মানুষ।
রাজশাহী জনস্বাস্থ্য বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর সমীক্ষা সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৫ সালে বরেন্দ্র বহুমুখী প্রকল্প চালু হওয়ার পর অনেক সংখ্যক গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। পানির স্তর সংকটে রাজশাহী বিভাগের প্রায় ৪০টি ইউনিয়ন সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। রাজশাহীর তানোর ও গোদাগাড়ী উপজেলার ৭টি করে মোট ১৪টি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার ২টি ও নাচোল উপজেলার ৪টি, ভোলাহাটের ১টি, গোমস্তপুর উপজেলার ৫টি, নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর, পোরশা, সাপাহার, মহাদেবপুর উপজেলার ১০টি, নাটোরের ৩টি, জয়পুরহাটের ৪টি ইউনিয়ন রয়েছে। এ ছাড়া অল্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ২৭টি ইউনিয়ন। ওই সকল ইউনিয়ন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬৫ সেন্টিমিটার উঁচুতে থাকায় পানির স্তর নিচে রয়েছে।
রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলাজুড়ে ‘উঁচু বরেন্দ্র অ লে ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ পানি পরিস্থিতির হাইড্রোলজিক্যাল অনুসন্ধান ও মডেলিং’ শীর্ষক গবেষণাটি ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ২৫টি উপজেলায় এই সমীক্ষা চালানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বরেন্দ্র অ লে পরিস্থিতি আগের চেয়ে দিন দিন খারাপ হচ্ছে। বাড়ছে পানির সঙ্কটাপন্ন এলাকা। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সালে বরেন্দ্র অ লে গড় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল ২৬ ফুট নিচে। সে সময় সর্বোচ্চ তানোরে পানির স্তর নেমেছিল ৬৮ ফুটে। খাবার পানি, সেচ, মাছ চাষের মতো বিভিন্ন কাজে অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি তোলায় ২০১০ সালে পানির গড় ছিল ৫০ ফুট। ভূগর্ভস্থ পানির গড় ২০২১ সালে আরও নিচে নেমে দাঁড়ায় ৬০ ফুটে। একই বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরের একটি স্থানে ভূপৃষ্ঠ হতে মাটির নিচে পানি নামে ১৫৩ ফুট।
গত বছর ১৬০ ফুট নিচে এই পানির স্তর নেমেছে। এ অ লের ২১৪ টি ইউনিয়নের মধ্য ৮৭ টি ইউনিয়ন অতি উচ্চ ও উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকা। পানির স্তর সবচেয়ে বেশি নেমেছে পোরশার ৬ ও নাচোলের ৪ ইউনিয়নে। অতি উচ্চ পানি সংকটে গোদাগাড়ি, তানোর, গোমস্তাপুর, নিয়ামতপুর ও সাপাহারসহ ৯ উপজেলার ৩৭টি ইউনিয়ন। গবেষণায় ৪০টি ইউনিয়নকে ‘উচ্চ পানি সংকটাপন্ন’ও ৬৫টি ইউনিয়নকে ‘মাঝারি পানি সংকটাপন্ন’ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেন গবেষকরা।
রাজশাহী জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদফতরের তথ্য বলছে, রাজশাহীর নয়টি উপজেলার পানির স্তর আরও নেমে যাচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নেমেছে তানোর ও গোদাগাড়ীতে। এই দুই উপজেলায় ৯২ ফুট পানির স্তর নেমেছে। এরপর আছে মোহনপুর ও পবা। এই দুই উপজেলাতে ৮২ ফুট পানির স্তর নেমেছে। বাগমারা উপজেলায় পানির স্তর নেমেছে ৬০ ফুট, বাঘা ও দুর্গাপুর উপজেলায় ৪৩ ফুট। পুঠিয়ায় নেমেছে ৩৮ ফুট ও চারঘাটে ৩৭ ফুট।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান সজল এই অ লের পানির ভবিষ্যৎ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে গবেষণা করে আসছেন। তিনি বলেন, গত বছর বৃষ্টিপাত এমনিতেই কম হয়েছে। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বাড়েনি। গত বছরের সঙ্কট কাটেনি। গত বছর বলা হয়েছিল আগামী বছর কৃষকরা পানি পাবে না। এখন প্রলম্বিত তাপপ্রবাহ চলছে। এ বছর তাই প্রচণ্ড খরা হবে। গ্রাউন্ড ওয়াটার বা ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামছে ২গুণ হারে। খরা মৌসুমে এৎড়ঁহফ ডধঃবৎ লেবেলে পানিই থাকছে না। এ বছর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আরো ৪ ফুট পর্যন্ত নেমে গেছে। বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) যে সংখ্যক ডিপ স্থাপন করেছে তার দ্বিগুণ ডিপ এই অ লে স্থাপন করা হয়েছে ব্যক্তি উদ্যোগে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্য এই অ লে পানি থাকবে না মাটির নিচে।


























