০৬:২০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গ্রামের শিশু-কিশোররাও জড়িয়ে পড়ছে সাইবার অপরাধে

◉ নতুন ধরনের সাইবার অপরাধ বেড়েছে ২৮১.৭৬ শতাংশ
◉ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতারণার ফাঁদ
◉ ভুয়া আইডিতেই ডেকে আনছে বিপদ
◉ নারীরাই বেশি ভুক্তভোগী
◉ শহর থেকে গ্রামের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ
◉ শিশু-কিশোরদের ওপর পরিবারকে আরো সচেতন হওয়ার তাগিদ

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার। এর ফলে বাড়ছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির তৈরি বিভিন্ন ধরণের স্মার্ট ফোনের ব্যবহার। মা-বাবার হাতে থাকা এসব সেট দেখে কোমলমতি শিশু-কিশোররাও বায়না ধরছে, সেই স্মার্ট সেট কিনে দেওয়ার। এমন বাস্তবতায় অভিভাবকরাও তাদের সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছেন সেই স্মার্ট ফোন। আদরের সেই শিশু-কিশোররা অনেকটাই আবেগপ্রবণ হয়ে জেনে না জেনে বিভিন্ন অ্যাপসে প্রবেশ করছে। বিভিন্ন গেমছে বুদ হয়ে সময় পার করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া আইডি খুলে প্রতারণার ফাঁদ পেতে এক একটি পরিবারকে নিঃস্ব করছে সাইবার অপরাধীরা। এমন প্রতারণার ফাঁদে পড়ছেন বেশিরভাগই নারীরা। তবে এসব মাধ্যম ব্যবহারে শহর থেকে গ্রামের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। মান-লজ্জার ভয়ে অনেকেই মুখ খুলছে না। নীরবে সহ্য করছেন, অনেকে আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছেন। সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন (সিক্যাফ) বলছে, দেশে নতুন ধরনের সাইবার অপরাধ বেড়েছে ২৮১.৭৬ শতাংশ। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের বয়স কম এবং সবকিছুতেই আগ্রহ বেশি থাকে, তাই তারা সহজেই আকৃষ্ট হয়। অন্যদিকে সহপাঠীদের নিয়ে তাদের নিজস্ব একটি জগত থাকে, সেখানে তাদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে উঠতে পারে না। বেশিরভাগ শিশু-কিশোরই সহপাঠী কিংবা সাইবার অপরাধীদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে ভুক্তভোগী হচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা বলছেন, ভুক্তভোগী অনেকেই মান-লজ্জার ভয়ে অভিযোগ না করায় তা দমনও সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রে শিশু-কিশোরদের মোবাইল ব্যবহার থেকে বিরত রাখা ও তাদের দৈনিন্দিন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি আরো যত্নশীল ও সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। গতকাল শনিবার ভুক্তভোগীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢাকার শ্যামপুরের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী জান্নাতের (ছদ্দনাম) সঙ্গে পরিচয় হয় রায়হান উদ্দিন আহমেদের। একপর্যায়ে পরিচয় ভালোবাসায় গড়ায়। তারা নিজেদের অন্তরঙ্গ ছবি দেওয়া-নেওয়াও শুরু করে। কিছুদিন পর তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরে। এতে ক্ষুব্ধ রায়হান ফেসবুকে একটি ফেক আইডি খুলে জান্নাতকে ব¬্যাকমেইল করতে থাকে। নিজেদের কিছু অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখিয়ে ভাইরাল করার হুমকি দিতে থাকে। একপর্যায়ে বিকাশের মাধ্যমে কিছু টাকাও আদায় করে রায়হান। কিছুদিন পর আবার রায়হান তার দুই বন্ধুকে দিয়ে একই কাজ করায়। এসময় ভুক্তভোগীর বড় বোনকেও ছবি দেখিয়ে হুমকি দেয় তারা। পরে বাধ্য হয়ে তারা বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রায়হানসহ তিন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে। এভাবে প্রতিনিয়ত সাইবার অপরাধীদের শিকার হচ্ছে শিশু-কিশোররা। অনেক ক্ষেত্রে শিশুরা নিজেদের অজান্তেই কৌতুহলের বশে জড়িয়ে পড়ছে সাইবার অপরাধে। হাতে থাকা মোবাইল দিয়ে গোপনে তোলা হয় স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীদের ছবি। পরে বিভিন্ন নামে ফেসবুক পেইজ খুলে সেই ছবি ছড়িয়ে দেয়া হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। লাইক ফলোয়ার বাড়াতেই এমন অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে বলে জানায় কিশোররা। শুধু গোপনে ছবি নয়। ব্যক্তিগত আপত্তিকর ছবিও ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয় মেয়েদের। বাদ যায় না ছেলেরাও। যারা এ অপরাধে জড়াচ্ছে তারা এখনো মাধ্যমিকের গণ্ডিও পেরোয়নি। এসব কিশোর এখন আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কাছে। সাইবার অপরাধে জড়িত পেইজের নিয়ন্ত্রকরা জানায়, পেইজের ফলোয়ার বাড়াতে মেয়েদের আপত্তিকর ছবি প্রকাশ করে তারা। অনেক সময় এসবের জন্য টাকাও নেয় তারা। অশ্লীলতা ছড়ালে ফেসবুকে লাইক-ফলোয়ার বেশি হয় বলেও দাবি তাদের। ফেসবুক থেকে টাকা আয় করতেই এসব পথ বেছে নিয়েছে তারা। জানা যায়, বর্তমানে বরিশালে সাইবার অপরাধে জড়িত ফেসবুক পেইজ আছে ১৫টির বেশি। এরমধ্যে ত্রিশ গোডাউন, বরিশাল এন্টার, বিএম কলেজ ক্রাশ অ্যান্ড কনফেশন, বরিশাল অল স্কুল ক্রাশ অ্যান্ড কনফেশনসহ বেশকিছু পেইজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে প্রশাসন। বিশেষজ্ঞদের মতে, দিনে প্রায় ৪০০ শিশু-কিশোর সাইবার অপরাধের শিকার হয়। ভুক্তভোগীরা এ বিষয়ে পরিবারকে জানাতেও ভয় পায়। এমন অপরাধ ঢাকার চেয়েও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রাম পর্যায়ে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করছে। বিশেষ করে দেশের পশ্চিম-উত্তরাঞ্চলে এই অপরাধ প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ৮ থেকে ১৮ বছরের শিশুদের শতকরা ৩৫ দশমিক ৭ জনের নিজস্ব মোবাইল ফোন রয়েছে। এদের মধ্যে ৬৫ দশমিক ৯ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ১৮-এর মধ্যে। ২৫ দশমিক ২ শতাংশ শিশুর বয়স ১১ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। ৭ দশমিক ৯ শতাংশ শিশুর বয়স ৮ থেকে ১০-এর মধ্যে। জরিপে দেখা গেছে, ছেলেশিশুদের ৬১ দশমিক ৩ শতাংশ এবং মেয়েশিশুদের ১৬ দশমিক ৯ শতাংশের নিজস্ব মোবাইল ফোন রয়েছে। ছেলেশিশুদের ৬২ শতাংশ এবং মেয়েশিশুদের ২৯ দশমিক ৯ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ছেলেশিশুদের ৫২ শতাংশ এবং মেয়েশিশুদের ১৫ শতাংশের নিজস্ব ফেসবুক অ্যাকাউন্ট রয়েছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের আসক নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজ বলেন, অনলাইনে শিশু নির্যানতন বন্ধে সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সাইবার অপরাধ সম্পর্কে সবাইকে জানাতে হবে। এবিষয়ে সরকারের নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন। সাইবার অপরাধের বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। এতে শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ সাইটগুলো চিহ্নিত করে নিজেদের সুরক্ষার কৌশলগুলো জানতে পারবে। শিশু-কিশোররা যাতে সাইবার অপরাধে জড়িয়ে না পড়ে সে বিষয়ে পরিবারকে অতি গুরুত্বের সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আশেক মাহমুদ দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কমে যাওয়ায় শিশু-কিশোরদের মধ্যে সামাজিক স্বাধীনতা বেড়েছে। ফলে তাদের মুক্ত চলাফেরা, বা স্মার্টফোনের ব্যবহার সহজ হওয়ায় তাদের যে নিষিদ্ধ বিষয়ে কৌতুহল থেকে সহজেই নিষিদ্ধ বা অন্ধকার জগতে জড়িয়ে পড়ছে তারা। এটার দায়বদ্ধতা আমাদের পরিবার থেকে রাষ্ট্র সর্বপর্যায়েই রয়েছে। পরিবারে সন্তানকে সুশাসনের মধ্যে রাখতে হবে, সবচেয়ে ভালো হয় স্মার্ট ডিভাইস তাকে না দিলে বা দিলেও খেয়াল রাখা সে কি করছে। আমাদের যে সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা বিস্তার করতে সমাজের মুরব্বিদের যেমন সচেতন থাকতে হবে। তেমনই স্কুল শিক্ষকদেরও শিক্ষার্থীদের প্রতি নজর বাড়াতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহীনিকেও আরও সচেতন থাকতে হবে।
বেসরকারি এনজিও সংস্থা সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা প্রকৌশলী মো. মুশফিকুর রহমানের মতে, নতুন ধরনের সাইবার অপরাধ বেড়েছে ২৮১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। আর এটা ঘটছে অসচেতনতার কারণে। ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার এবং অনলাইনের বাসিন্দা হতে কিংবা ডিজিটাল জগতে কীভাবে চলতে হবে, সেই সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। এ কারণে নারী ও শিশুদের সবচেয়ে বেশি সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

ডিএমপির ডিসি (সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন) আ. ফ. ম আল কিবরিয়া দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, সাইবার অপরাধ দমনে সিটিটিসিসহ অন্যান্য সংস্থাও তৎপর রয়েছে। তিনি বলেন, এসব অপরাধ রোধে সর্ব প্রথমেই পরিবার বা অভিভাববকদের উদ্যোগ নিতে হবে। শিশু-কিশোররা কখন কোথায় কি করছে, মোবাইল ফোন বা কম্পিউটারে কি দেখছে তা খেয়াল রাখতে হবে। সন্তানদের প্রতি সচেতনা বৃদ্ধিসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদেরও ভুমিকা রাখতে হবে।

সাধারণ মানুষকে দূরে রেখে আখেরে কেউ লাভবান হয় না

গ্রামের শিশু-কিশোররাও জড়িয়ে পড়ছে সাইবার অপরাধে

আপডেট সময় : ০৭:০০:৫৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৫ মে ২০২৪

◉ নতুন ধরনের সাইবার অপরাধ বেড়েছে ২৮১.৭৬ শতাংশ
◉ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতারণার ফাঁদ
◉ ভুয়া আইডিতেই ডেকে আনছে বিপদ
◉ নারীরাই বেশি ভুক্তভোগী
◉ শহর থেকে গ্রামের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ
◉ শিশু-কিশোরদের ওপর পরিবারকে আরো সচেতন হওয়ার তাগিদ

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার। এর ফলে বাড়ছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির তৈরি বিভিন্ন ধরণের স্মার্ট ফোনের ব্যবহার। মা-বাবার হাতে থাকা এসব সেট দেখে কোমলমতি শিশু-কিশোররাও বায়না ধরছে, সেই স্মার্ট সেট কিনে দেওয়ার। এমন বাস্তবতায় অভিভাবকরাও তাদের সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছেন সেই স্মার্ট ফোন। আদরের সেই শিশু-কিশোররা অনেকটাই আবেগপ্রবণ হয়ে জেনে না জেনে বিভিন্ন অ্যাপসে প্রবেশ করছে। বিভিন্ন গেমছে বুদ হয়ে সময় পার করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া আইডি খুলে প্রতারণার ফাঁদ পেতে এক একটি পরিবারকে নিঃস্ব করছে সাইবার অপরাধীরা। এমন প্রতারণার ফাঁদে পড়ছেন বেশিরভাগই নারীরা। তবে এসব মাধ্যম ব্যবহারে শহর থেকে গ্রামের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। মান-লজ্জার ভয়ে অনেকেই মুখ খুলছে না। নীরবে সহ্য করছেন, অনেকে আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছেন। সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন (সিক্যাফ) বলছে, দেশে নতুন ধরনের সাইবার অপরাধ বেড়েছে ২৮১.৭৬ শতাংশ। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের বয়স কম এবং সবকিছুতেই আগ্রহ বেশি থাকে, তাই তারা সহজেই আকৃষ্ট হয়। অন্যদিকে সহপাঠীদের নিয়ে তাদের নিজস্ব একটি জগত থাকে, সেখানে তাদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে উঠতে পারে না। বেশিরভাগ শিশু-কিশোরই সহপাঠী কিংবা সাইবার অপরাধীদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে ভুক্তভোগী হচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা বলছেন, ভুক্তভোগী অনেকেই মান-লজ্জার ভয়ে অভিযোগ না করায় তা দমনও সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রে শিশু-কিশোরদের মোবাইল ব্যবহার থেকে বিরত রাখা ও তাদের দৈনিন্দিন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি আরো যত্নশীল ও সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। গতকাল শনিবার ভুক্তভোগীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢাকার শ্যামপুরের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী জান্নাতের (ছদ্দনাম) সঙ্গে পরিচয় হয় রায়হান উদ্দিন আহমেদের। একপর্যায়ে পরিচয় ভালোবাসায় গড়ায়। তারা নিজেদের অন্তরঙ্গ ছবি দেওয়া-নেওয়াও শুরু করে। কিছুদিন পর তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরে। এতে ক্ষুব্ধ রায়হান ফেসবুকে একটি ফেক আইডি খুলে জান্নাতকে ব¬্যাকমেইল করতে থাকে। নিজেদের কিছু অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখিয়ে ভাইরাল করার হুমকি দিতে থাকে। একপর্যায়ে বিকাশের মাধ্যমে কিছু টাকাও আদায় করে রায়হান। কিছুদিন পর আবার রায়হান তার দুই বন্ধুকে দিয়ে একই কাজ করায়। এসময় ভুক্তভোগীর বড় বোনকেও ছবি দেখিয়ে হুমকি দেয় তারা। পরে বাধ্য হয়ে তারা বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রায়হানসহ তিন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে। এভাবে প্রতিনিয়ত সাইবার অপরাধীদের শিকার হচ্ছে শিশু-কিশোররা। অনেক ক্ষেত্রে শিশুরা নিজেদের অজান্তেই কৌতুহলের বশে জড়িয়ে পড়ছে সাইবার অপরাধে। হাতে থাকা মোবাইল দিয়ে গোপনে তোলা হয় স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীদের ছবি। পরে বিভিন্ন নামে ফেসবুক পেইজ খুলে সেই ছবি ছড়িয়ে দেয়া হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। লাইক ফলোয়ার বাড়াতেই এমন অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে বলে জানায় কিশোররা। শুধু গোপনে ছবি নয়। ব্যক্তিগত আপত্তিকর ছবিও ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয় মেয়েদের। বাদ যায় না ছেলেরাও। যারা এ অপরাধে জড়াচ্ছে তারা এখনো মাধ্যমিকের গণ্ডিও পেরোয়নি। এসব কিশোর এখন আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কাছে। সাইবার অপরাধে জড়িত পেইজের নিয়ন্ত্রকরা জানায়, পেইজের ফলোয়ার বাড়াতে মেয়েদের আপত্তিকর ছবি প্রকাশ করে তারা। অনেক সময় এসবের জন্য টাকাও নেয় তারা। অশ্লীলতা ছড়ালে ফেসবুকে লাইক-ফলোয়ার বেশি হয় বলেও দাবি তাদের। ফেসবুক থেকে টাকা আয় করতেই এসব পথ বেছে নিয়েছে তারা। জানা যায়, বর্তমানে বরিশালে সাইবার অপরাধে জড়িত ফেসবুক পেইজ আছে ১৫টির বেশি। এরমধ্যে ত্রিশ গোডাউন, বরিশাল এন্টার, বিএম কলেজ ক্রাশ অ্যান্ড কনফেশন, বরিশাল অল স্কুল ক্রাশ অ্যান্ড কনফেশনসহ বেশকিছু পেইজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে প্রশাসন। বিশেষজ্ঞদের মতে, দিনে প্রায় ৪০০ শিশু-কিশোর সাইবার অপরাধের শিকার হয়। ভুক্তভোগীরা এ বিষয়ে পরিবারকে জানাতেও ভয় পায়। এমন অপরাধ ঢাকার চেয়েও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রাম পর্যায়ে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করছে। বিশেষ করে দেশের পশ্চিম-উত্তরাঞ্চলে এই অপরাধ প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ৮ থেকে ১৮ বছরের শিশুদের শতকরা ৩৫ দশমিক ৭ জনের নিজস্ব মোবাইল ফোন রয়েছে। এদের মধ্যে ৬৫ দশমিক ৯ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ১৮-এর মধ্যে। ২৫ দশমিক ২ শতাংশ শিশুর বয়স ১১ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। ৭ দশমিক ৯ শতাংশ শিশুর বয়স ৮ থেকে ১০-এর মধ্যে। জরিপে দেখা গেছে, ছেলেশিশুদের ৬১ দশমিক ৩ শতাংশ এবং মেয়েশিশুদের ১৬ দশমিক ৯ শতাংশের নিজস্ব মোবাইল ফোন রয়েছে। ছেলেশিশুদের ৬২ শতাংশ এবং মেয়েশিশুদের ২৯ দশমিক ৯ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ছেলেশিশুদের ৫২ শতাংশ এবং মেয়েশিশুদের ১৫ শতাংশের নিজস্ব ফেসবুক অ্যাকাউন্ট রয়েছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের আসক নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজ বলেন, অনলাইনে শিশু নির্যানতন বন্ধে সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সাইবার অপরাধ সম্পর্কে সবাইকে জানাতে হবে। এবিষয়ে সরকারের নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন। সাইবার অপরাধের বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। এতে শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ সাইটগুলো চিহ্নিত করে নিজেদের সুরক্ষার কৌশলগুলো জানতে পারবে। শিশু-কিশোররা যাতে সাইবার অপরাধে জড়িয়ে না পড়ে সে বিষয়ে পরিবারকে অতি গুরুত্বের সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আশেক মাহমুদ দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কমে যাওয়ায় শিশু-কিশোরদের মধ্যে সামাজিক স্বাধীনতা বেড়েছে। ফলে তাদের মুক্ত চলাফেরা, বা স্মার্টফোনের ব্যবহার সহজ হওয়ায় তাদের যে নিষিদ্ধ বিষয়ে কৌতুহল থেকে সহজেই নিষিদ্ধ বা অন্ধকার জগতে জড়িয়ে পড়ছে তারা। এটার দায়বদ্ধতা আমাদের পরিবার থেকে রাষ্ট্র সর্বপর্যায়েই রয়েছে। পরিবারে সন্তানকে সুশাসনের মধ্যে রাখতে হবে, সবচেয়ে ভালো হয় স্মার্ট ডিভাইস তাকে না দিলে বা দিলেও খেয়াল রাখা সে কি করছে। আমাদের যে সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা বিস্তার করতে সমাজের মুরব্বিদের যেমন সচেতন থাকতে হবে। তেমনই স্কুল শিক্ষকদেরও শিক্ষার্থীদের প্রতি নজর বাড়াতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহীনিকেও আরও সচেতন থাকতে হবে।
বেসরকারি এনজিও সংস্থা সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা প্রকৌশলী মো. মুশফিকুর রহমানের মতে, নতুন ধরনের সাইবার অপরাধ বেড়েছে ২৮১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। আর এটা ঘটছে অসচেতনতার কারণে। ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার এবং অনলাইনের বাসিন্দা হতে কিংবা ডিজিটাল জগতে কীভাবে চলতে হবে, সেই সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। এ কারণে নারী ও শিশুদের সবচেয়ে বেশি সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

ডিএমপির ডিসি (সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন) আ. ফ. ম আল কিবরিয়া দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, সাইবার অপরাধ দমনে সিটিটিসিসহ অন্যান্য সংস্থাও তৎপর রয়েছে। তিনি বলেন, এসব অপরাধ রোধে সর্ব প্রথমেই পরিবার বা অভিভাববকদের উদ্যোগ নিতে হবে। শিশু-কিশোররা কখন কোথায় কি করছে, মোবাইল ফোন বা কম্পিউটারে কি দেখছে তা খেয়াল রাখতে হবে। সন্তানদের প্রতি সচেতনা বৃদ্ধিসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদেরও ভুমিকা রাখতে হবে।