০৭:১৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আবাসিক ভবনের বাণিজ্যিক ব্যবহার বাড়ছেই

 

⦿ ঝুঁকিপূর্ণ ভবনই এখন মৃত্যুফাঁদ
⦿ তৈরি হচ্ছে অননুমোদিত মার্কেট-রেস্তোরাঁ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ব্যাংক-বিমা
⦿ চিঠি চালাচালিতে থমকে আছে অবৈধ ভবনবিরোধী অভিযান
⦿ ৬৪ হাজার ভবনের মধ্যে অনুমোদন রয়েছে মাত্র ৩২শ’র
⦿ দুর্ঘটনা ঘটলে টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের, নিয়মিত অভিযানের তাগিদ বিশেষজ্ঞের

রাজধানীর মেগাসিটি ঢাকার বিস্তীর্ণ এলাকায় গড়ে ওঠা আবাসিক ভবনে ক্রমেই বাড়ছে বাণিজ্যিক ভবনের ব্যবহার। আর এসব দেখভালের দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উদাসীনতায় ভবনগুলোতে হরহামেশাই তৈরি করা হচ্ছে মার্কেট, শপিংমল, হোটেল-রেস্তোরাঁ, হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ব্যাংক-বিমাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় বলা হয়েছে, ইমারত আংশিক বা সম্পূর্ণ নির্মাণ শেষের পরে তা ব্যবহার বা বসবাসের জন্য সনদ নিতে হবে। এই সনদ পাওয়ার আগে ইমারত আংশিক বা সম্পূর্ণ কোনো অবস্থাতেই ব্যবহার করা যাবে না। পরবর্তীতে প্রতি পাঁচ বছর পরপর নবায়ন করা বাধ্যতামূলক। গত দেড় দশকে এই নগরীতে ৬৪ হাজারেরও বেশি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে; যা অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩২শ’ ভবনের অনুমোদন রয়েছে। বাকি অননুমোদিত ঝুঁকিপূর্ণ এসব ভবন এখন প্রতিনিয়তই মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে। বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই টনক নড়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। এরপর চলে বেশকিছু লোকদেখানো অভিযান। পরে চিঠি চালাচালি আর দেনদরবারেই মাঝপথে থমকে যাচ্ছে অবৈধ ভবনবিরোধী অভিযান। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, দুর্ঘটনা ঘটলে একটি সংস্থা অপর সংস্থাকে দায়ী করে নিজেদের দায় এড়িয়ে যায়। এর মূল দায়িত্বই রাজউকের। অনৈতিক সুবিধার কারণে ভবন নির্মাণ থেকে ব্যবহারের প্রতিটি ধাপে ভবন মালিকদের বাড়তি টাকা গুনতে এমন অনিয়ম বেড়েই চলছে। এক্ষেত্রে কেবল দুর্ঘটনাভিত্তিক অভিযান নয়, সারাবছরই অভিযান চালাতে হবে। তাহলে এমন অনিয়ম রোধ করা সম্ভব। রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো বলছে, দুর্ঘটনার পর অভিযান চলে বিষয়টি এমন নয়, বছরজুড়ে কাজ করে বিভিন্ন্ সংস্থা। তবে রাজউকের একার পক্ষে তা সব সম্ভব নয়। অনেকক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা ও লোকবলের অভাবে যথাসময়ে অভিযান চালানো সম্ভব হচ্ছে না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানী মেগাসিটি ঢাকার আয়তন ৩০৬ বর্গকিলোমিটার। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৩ হাজার লোকের বসবাস এ নগরে। বর্তমানে এই নগরীতে প্রায় ২০ কোটি মানুষ বাস করছেন। তাদের আবাসন ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে টার্গেট করেই প্রতিদিনই রাজধানীর বিস্তীর্ণ জনপদে বহুতল ভবন গড়ে উঠছে। প্রথমে রাজউক থেকে আবাসিকের অনুমোদন নিলেও চাহিদার বিবেচনায় ভবন মালিক বা ডেভেলপার কোম্পানিগুলো ইমারত নির্মাণ বিধিমাল উপেক্ষা করেই আবাসিক ভবনগুলোকে বাণিজ্যিক ভবনে রূপান্তরিত করছে। রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, উত্তরা, ধানমন্ডি, বনশ্রীসহ অনেক এলাকার আবাসিক চরিত্র ইতোমধ্যেই হারিয়ে গেছে। এসব এলাকার আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। কিছু ভবনের অর্ধেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অন্য অংশে আবাসিক। আবার কিছু ভবনে অর্ধেক শপিং মল, ওপরের অংশে আবাসন। আবার কিছু ভবনে রেস্টুরেন্ট, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বিমা প্রতিষ্ঠানসহ নানা বাণিজ্যিক স্থাপনা রয়েছে। অধিকাংশ ভবন মালিক অনুমোদনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান করে থাকেন। অনেক আবাসিক এলাকার সড়কের পাশে এখন আবাসিক কাম বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মিত হচ্ছে। আবার কিছু ভবনে মিশ্র ব্যবহারের অনুমোদন নিলেও পুরোটাই বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। ফলে এসব এলাকা এখন আবাসিক এলাকার রূপ পরিবর্তন হয়ে মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজধানী মেগাসিটি ঢাকায় বহুতল ভবনের সংখ্যা ৬৩টি। এর মধ্যে রয়েছে ১৪টি মিশ্র ভবনের ব্যবহার, ৩১টি বাণিজ্যিক ভবন, ১১টি আবাসিক ভবন, ৪টি হোটেল ও ৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ৮১ মিটার থেকে ১৭১ মিটার পর্যন্ত উঁচু ভবন নির্মাণ করা হয়েছে এই যান্ত্রিক নগরীতে।

এরমধ্যে ব্যস্ততম এই নগরীতে সবচেয়ে সুউচ্চ ভবন হচ্ছে ১৭১ মিটারের ‘সিটি সেন্টার’। গুলশান ও এর আশপাশে এখন বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক ভবনের ছড়াছড়ি। এর কোনোটি আবাসিক প্লটে রূপান্তর করে বাণিজ্যিক করা হয়েছে, আবার কোনো আবাসিক প্লটে অনুমতি ছাড়াই গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিক ভবন। আবাসিক হোটেল, বিভিন্ন এজেন্সির অফিসসহ সারি সারি সুউচ্চ ভবনে শপিং মল, রেস্টুরেন্ট মিলিয়ে এক সময়ের শান্ত-স্নিগ্ধ সবুজ অভিজাত আবাসিক এলাকা তার স্বকীয়তা হারিয়েছে। একই অবস্থা বনানী, ধানমন্ডি ও উত্তরা আবাসিক এলাকার। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের রসুলপুর ব্রিজ মার্কেটের দু’পাশে গড়ে তোলা আবাসিক ভবনগুলো এখন বাণিজ্যিক ভবনে রূপ ধারণ করেছে। রাজউকের অনুমোদন নিয়ে রনি মার্কেট সংলগ্ন একটি ভবন গড়ে তুলছে ভবন মালিকরা। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী চারপাশ থেকে অন্তত ৩ ফুট ছেড়ে ভবন নির্মাণ করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। এলহাম প্লাজার দেওয়াল ঘেঁষে তৈরি করা হচ্ছে ওই ভবনসহ আরো ৫টি বহুতল ভবন। ইতোমধ্যেই বর্ধিতাংশ ভেঙে ফেলার নোটিস দিয়ে পরিদর্শনে আসেন রাজউকের আঞ্চলিক কর্মকর্তারা। পরে কিছু বন্ধ থাকলেও রহস্যজনকভাবেই আবারো নির্মাণ কাজ শুরু করেছেন প্রভাবশালী ভবন মালিকরা। জানা যায়, চিঠি চালাচালিতে আর্থিক দেনদরবারেই মেলে এর সমাধান। দক্ষিণ বনশ্রীর ১০ তলা মার্কেটের ভবনটির নিচ থেকে চার তলা পর্যন্ত শপিংমল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর ওপরের ফ্ল্যাটগুলো আবাসিক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। একই সঙ্গে বনশ্রীর এইচ ব্লকে এক নম্বর রোডে একটি ভবনের অর্ধেকাংশে নার্সিং প্রতিষ্ঠান, অন্যাংশে আবাসিক ফ্ল্যাট। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ১০০ ফুট রাস্তা সংলগ্ন কিছু এলাকায় আবাসিক কাম বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে। যদিও রাজউকের এ-সংক্রান্ত আদেশ অনেক আবাসিক এলাকায় ব্যত্যয় রয়েছে। সংস্থাটির অনুমোদন ছাড়াই আবাসিক কাম বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নির্মিত হয়েছে।

২০০৮ সালের ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১৮ ধারায় বলা হয়েছে, ইমারত আংশিক বা সম্পূর্ণ নির্মাণ শেষের পরে তা ব্যবহার বা বসবাসের জন্য সনদ নিতে হবে। এই সনদ পাওয়ার আগে ইমারত আংশিক বা সম্পূর্ণ কোনো অবস্থাতেই ব্যবহার করা যাবে না। এই ব্যবহার বা বসবাস সনদের মেয়াদ পাঁচ বছর পরপর এটি নবায়নও বাধ্যতামূলক। এদিকে চলতি বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের একটি ভবনে অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মৃত্যুর পর রাজধানীজুড়ে শুরু হয় রাজউকসহ বিভিন্ন সংস্থার সাঁড়াশি অভিযান। তবে এক সপ্তাহ পার না হতেই সময়ের ব্যবধানে থমকে রয়েছে সেই অভিযান। আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিকের ব্যবহার বন্ধে গত ৩ মার্চ হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ রিট করেন বেইলি রোডের বাসিন্দা আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ। তিনি জানান, বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের হাইকোর্ট বেঞ্চে রিটটি শুনানি হয়।

নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ এবং নগর গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ভবন নির্মাণ ও ব্যবহার এর সবকিছুই দেখভালের দায়িত্ব রাজউক এড়াতে পারে না। ঘটনা ঘটলেই একটি সংস্থা অপর সংস্থাকে দায়ী করার সংস্কৃতি থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে। লোক দেখানো অভিযান না চালিয়ে, বছরজুড়ে নিয়মিত অভিযান চালালে এবং নজরদারি বাড়ালে অবৈধ ভবন নির্মাণ ও বাণিজ্যিক ব্যবহারে অনিয়ম রোধ করা সম্ভব হবে। নতুবা এটা চলতেই থাকবে।

রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, প্রতি বছর রাজউক থেকে গড়ে প্রায় ৭ হাজার ভবনের নকশা অনুমোদন দেওয়া হয়। অনেক আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। অনিয়ম রোধে সব সংস্থার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে অনেকক্ষেত্রে সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা এবং লোকবলের অভাবে যথাসময়ে অভিযান চালানো সম্ভব হয় না। তবে অবৈধ ভবনের বিরুদ্ধে নিয়মিত মনিটরিং করে নোটিস প্রদান করা হচ্ছে বলে জানান রাজউকের ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তা।

ভুয়া নথিপত্রে মিলছে ঋণ, সঠিকে জটিলতা

আবাসিক ভবনের বাণিজ্যিক ব্যবহার বাড়ছেই

আপডেট সময় : ০৭:০০:২৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৬ মে ২০২৪

 

⦿ ঝুঁকিপূর্ণ ভবনই এখন মৃত্যুফাঁদ
⦿ তৈরি হচ্ছে অননুমোদিত মার্কেট-রেস্তোরাঁ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ব্যাংক-বিমা
⦿ চিঠি চালাচালিতে থমকে আছে অবৈধ ভবনবিরোধী অভিযান
⦿ ৬৪ হাজার ভবনের মধ্যে অনুমোদন রয়েছে মাত্র ৩২শ’র
⦿ দুর্ঘটনা ঘটলে টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের, নিয়মিত অভিযানের তাগিদ বিশেষজ্ঞের

রাজধানীর মেগাসিটি ঢাকার বিস্তীর্ণ এলাকায় গড়ে ওঠা আবাসিক ভবনে ক্রমেই বাড়ছে বাণিজ্যিক ভবনের ব্যবহার। আর এসব দেখভালের দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উদাসীনতায় ভবনগুলোতে হরহামেশাই তৈরি করা হচ্ছে মার্কেট, শপিংমল, হোটেল-রেস্তোরাঁ, হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ব্যাংক-বিমাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় বলা হয়েছে, ইমারত আংশিক বা সম্পূর্ণ নির্মাণ শেষের পরে তা ব্যবহার বা বসবাসের জন্য সনদ নিতে হবে। এই সনদ পাওয়ার আগে ইমারত আংশিক বা সম্পূর্ণ কোনো অবস্থাতেই ব্যবহার করা যাবে না। পরবর্তীতে প্রতি পাঁচ বছর পরপর নবায়ন করা বাধ্যতামূলক। গত দেড় দশকে এই নগরীতে ৬৪ হাজারেরও বেশি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে; যা অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩২শ’ ভবনের অনুমোদন রয়েছে। বাকি অননুমোদিত ঝুঁকিপূর্ণ এসব ভবন এখন প্রতিনিয়তই মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে। বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই টনক নড়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। এরপর চলে বেশকিছু লোকদেখানো অভিযান। পরে চিঠি চালাচালি আর দেনদরবারেই মাঝপথে থমকে যাচ্ছে অবৈধ ভবনবিরোধী অভিযান। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, দুর্ঘটনা ঘটলে একটি সংস্থা অপর সংস্থাকে দায়ী করে নিজেদের দায় এড়িয়ে যায়। এর মূল দায়িত্বই রাজউকের। অনৈতিক সুবিধার কারণে ভবন নির্মাণ থেকে ব্যবহারের প্রতিটি ধাপে ভবন মালিকদের বাড়তি টাকা গুনতে এমন অনিয়ম বেড়েই চলছে। এক্ষেত্রে কেবল দুর্ঘটনাভিত্তিক অভিযান নয়, সারাবছরই অভিযান চালাতে হবে। তাহলে এমন অনিয়ম রোধ করা সম্ভব। রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো বলছে, দুর্ঘটনার পর অভিযান চলে বিষয়টি এমন নয়, বছরজুড়ে কাজ করে বিভিন্ন্ সংস্থা। তবে রাজউকের একার পক্ষে তা সব সম্ভব নয়। অনেকক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা ও লোকবলের অভাবে যথাসময়ে অভিযান চালানো সম্ভব হচ্ছে না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানী মেগাসিটি ঢাকার আয়তন ৩০৬ বর্গকিলোমিটার। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৩ হাজার লোকের বসবাস এ নগরে। বর্তমানে এই নগরীতে প্রায় ২০ কোটি মানুষ বাস করছেন। তাদের আবাসন ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে টার্গেট করেই প্রতিদিনই রাজধানীর বিস্তীর্ণ জনপদে বহুতল ভবন গড়ে উঠছে। প্রথমে রাজউক থেকে আবাসিকের অনুমোদন নিলেও চাহিদার বিবেচনায় ভবন মালিক বা ডেভেলপার কোম্পানিগুলো ইমারত নির্মাণ বিধিমাল উপেক্ষা করেই আবাসিক ভবনগুলোকে বাণিজ্যিক ভবনে রূপান্তরিত করছে। রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, উত্তরা, ধানমন্ডি, বনশ্রীসহ অনেক এলাকার আবাসিক চরিত্র ইতোমধ্যেই হারিয়ে গেছে। এসব এলাকার আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। কিছু ভবনের অর্ধেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অন্য অংশে আবাসিক। আবার কিছু ভবনে অর্ধেক শপিং মল, ওপরের অংশে আবাসন। আবার কিছু ভবনে রেস্টুরেন্ট, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বিমা প্রতিষ্ঠানসহ নানা বাণিজ্যিক স্থাপনা রয়েছে। অধিকাংশ ভবন মালিক অনুমোদনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান করে থাকেন। অনেক আবাসিক এলাকার সড়কের পাশে এখন আবাসিক কাম বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মিত হচ্ছে। আবার কিছু ভবনে মিশ্র ব্যবহারের অনুমোদন নিলেও পুরোটাই বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। ফলে এসব এলাকা এখন আবাসিক এলাকার রূপ পরিবর্তন হয়ে মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজধানী মেগাসিটি ঢাকায় বহুতল ভবনের সংখ্যা ৬৩টি। এর মধ্যে রয়েছে ১৪টি মিশ্র ভবনের ব্যবহার, ৩১টি বাণিজ্যিক ভবন, ১১টি আবাসিক ভবন, ৪টি হোটেল ও ৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ৮১ মিটার থেকে ১৭১ মিটার পর্যন্ত উঁচু ভবন নির্মাণ করা হয়েছে এই যান্ত্রিক নগরীতে।

এরমধ্যে ব্যস্ততম এই নগরীতে সবচেয়ে সুউচ্চ ভবন হচ্ছে ১৭১ মিটারের ‘সিটি সেন্টার’। গুলশান ও এর আশপাশে এখন বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক ভবনের ছড়াছড়ি। এর কোনোটি আবাসিক প্লটে রূপান্তর করে বাণিজ্যিক করা হয়েছে, আবার কোনো আবাসিক প্লটে অনুমতি ছাড়াই গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিক ভবন। আবাসিক হোটেল, বিভিন্ন এজেন্সির অফিসসহ সারি সারি সুউচ্চ ভবনে শপিং মল, রেস্টুরেন্ট মিলিয়ে এক সময়ের শান্ত-স্নিগ্ধ সবুজ অভিজাত আবাসিক এলাকা তার স্বকীয়তা হারিয়েছে। একই অবস্থা বনানী, ধানমন্ডি ও উত্তরা আবাসিক এলাকার। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের রসুলপুর ব্রিজ মার্কেটের দু’পাশে গড়ে তোলা আবাসিক ভবনগুলো এখন বাণিজ্যিক ভবনে রূপ ধারণ করেছে। রাজউকের অনুমোদন নিয়ে রনি মার্কেট সংলগ্ন একটি ভবন গড়ে তুলছে ভবন মালিকরা। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী চারপাশ থেকে অন্তত ৩ ফুট ছেড়ে ভবন নির্মাণ করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। এলহাম প্লাজার দেওয়াল ঘেঁষে তৈরি করা হচ্ছে ওই ভবনসহ আরো ৫টি বহুতল ভবন। ইতোমধ্যেই বর্ধিতাংশ ভেঙে ফেলার নোটিস দিয়ে পরিদর্শনে আসেন রাজউকের আঞ্চলিক কর্মকর্তারা। পরে কিছু বন্ধ থাকলেও রহস্যজনকভাবেই আবারো নির্মাণ কাজ শুরু করেছেন প্রভাবশালী ভবন মালিকরা। জানা যায়, চিঠি চালাচালিতে আর্থিক দেনদরবারেই মেলে এর সমাধান। দক্ষিণ বনশ্রীর ১০ তলা মার্কেটের ভবনটির নিচ থেকে চার তলা পর্যন্ত শপিংমল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর ওপরের ফ্ল্যাটগুলো আবাসিক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। একই সঙ্গে বনশ্রীর এইচ ব্লকে এক নম্বর রোডে একটি ভবনের অর্ধেকাংশে নার্সিং প্রতিষ্ঠান, অন্যাংশে আবাসিক ফ্ল্যাট। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ১০০ ফুট রাস্তা সংলগ্ন কিছু এলাকায় আবাসিক কাম বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে। যদিও রাজউকের এ-সংক্রান্ত আদেশ অনেক আবাসিক এলাকায় ব্যত্যয় রয়েছে। সংস্থাটির অনুমোদন ছাড়াই আবাসিক কাম বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নির্মিত হয়েছে।

২০০৮ সালের ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১৮ ধারায় বলা হয়েছে, ইমারত আংশিক বা সম্পূর্ণ নির্মাণ শেষের পরে তা ব্যবহার বা বসবাসের জন্য সনদ নিতে হবে। এই সনদ পাওয়ার আগে ইমারত আংশিক বা সম্পূর্ণ কোনো অবস্থাতেই ব্যবহার করা যাবে না। এই ব্যবহার বা বসবাস সনদের মেয়াদ পাঁচ বছর পরপর এটি নবায়নও বাধ্যতামূলক। এদিকে চলতি বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের একটি ভবনে অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মৃত্যুর পর রাজধানীজুড়ে শুরু হয় রাজউকসহ বিভিন্ন সংস্থার সাঁড়াশি অভিযান। তবে এক সপ্তাহ পার না হতেই সময়ের ব্যবধানে থমকে রয়েছে সেই অভিযান। আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিকের ব্যবহার বন্ধে গত ৩ মার্চ হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ রিট করেন বেইলি রোডের বাসিন্দা আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ। তিনি জানান, বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের হাইকোর্ট বেঞ্চে রিটটি শুনানি হয়।

নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ এবং নগর গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ভবন নির্মাণ ও ব্যবহার এর সবকিছুই দেখভালের দায়িত্ব রাজউক এড়াতে পারে না। ঘটনা ঘটলেই একটি সংস্থা অপর সংস্থাকে দায়ী করার সংস্কৃতি থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে। লোক দেখানো অভিযান না চালিয়ে, বছরজুড়ে নিয়মিত অভিযান চালালে এবং নজরদারি বাড়ালে অবৈধ ভবন নির্মাণ ও বাণিজ্যিক ব্যবহারে অনিয়ম রোধ করা সম্ভব হবে। নতুবা এটা চলতেই থাকবে।

রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, প্রতি বছর রাজউক থেকে গড়ে প্রায় ৭ হাজার ভবনের নকশা অনুমোদন দেওয়া হয়। অনেক আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। অনিয়ম রোধে সব সংস্থার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে অনেকক্ষেত্রে সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা এবং লোকবলের অভাবে যথাসময়ে অভিযান চালানো সম্ভব হয় না। তবে অবৈধ ভবনের বিরুদ্ধে নিয়মিত মনিটরিং করে নোটিস প্রদান করা হচ্ছে বলে জানান রাজউকের ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তা।