◉ শিক্ষা ও গবেষণার মান নিয়ে বিশ্বেপ্রশ্ন বাড়ছে
◉ গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি ও মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগে জোর
◉ অভ্যন্তরীণ র্যাঙ্কিং ব্যবস্থা প্রবর্তনের চিন্তা ইউজিসির
◉ বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি চালুর আহ্বান
দেশে উচ্চশিক্ষার চাহিদার সঙ্গে বাড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বা ইউজিসির পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৩টি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১১৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এদের মধ্যে আছে শতবর্ষী বিশ্ববিদ্যালয়, বেশ কয়েকটি আবার ৫০ বছরের কোটা অতিক্রম করেছে। আর এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৪৮ লাখ। তবে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রমে বেশ এগিয়ে গেলেও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন র্যাঙ্কিংয়ে এখনো অনেক পিছিয়ে দেশেরবিশ্ববিদ্যালয়গুলো। আর এর পেছনে গবেষণা খাতের দুর্বলতাকেই সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ না হওয়া, বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম হওয়াসহ নানা কারণ রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত।
সম্প্রতি প্রকাশিত কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি সামগ্রিক র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের সেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। এমনকি টাইমস হায়ার এডুকেশনের এ বছরের আঞ্চলিক র্যাঙ্কিং অনুযায়ী এশিয়ার সেরা ৩০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও নেই বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। লন্ডনভিত্তিক শিক্ষাবিষয়ক সাময়িকী টাইমস হায়ার এডুকেশন ৫টি মানদণ্ড, যথা: শিক্ষা, গবেষণা, সাইটেশন, আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইন্ডাস্ট্রি ইনকাম অর্থাৎ শিল্পের সঙ্গে গবেষণাকর্মের বাণিজ্যিকীকরণের উপর ভিত্তি করে র্যাঙ্কিং প্রকাশ করে।
বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, তবে এদের মাঝে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এগিয়ে যাচ্ছে। কিউএস সূচকগুলোর গড় মান ১০০ এর মধ্যে ১০০ পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) তালিকার শীর্ষস্থান অর্জন করেছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ (৯৯.২) ও অক্সফোর্ড (৯৮.৯) বিশ্ববিদ্যালয় এবং পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড (৯৮.৩) ও স্ট্যাম্পফোর্ড (৯৮.১) বিশ্ববিদ্যালয়।
এশিয়া মহাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন- চীন, জাপান, কোরিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, প্রভৃতি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার মানের দিক থেকে উন্নত বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমান্তরালে প্রতিযোগিতা করে এগিয়ে চলেছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের এবং পাকিস্তানের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় জায়গা করে নিচ্ছে সামনের কাতারে। সেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় চীনের ২৯টি, জাপানের ১৫টি, ভারতের ১১টি এবং পাকিস্তানের ২টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।
যদিও কিউএস র্যাঙ্কিংয়ে সেরা ৭০০-১০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের ৩টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়)। তবে এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিছু সূচকে মান পেলেও সামগ্রিকভাবে গড় মান অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। প্রসঙ্গত বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান নিয়ে বিভিন্ন মহলে নেতিবাচক প্রশ্ন উঠছে। উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে খোদ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান ইউজিসিই উদ্বিগ্ন। বিষয়টিতে বিশেষ জোর দিয়ে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
গুণগত এবং মানসম্মত আন্তর্জাতিক মানের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের র্যাঙ্কিংয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনে করছে ইউজিসি। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিং ব্যবস্থার আদলে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের জন্য সরকার জাতীয় পর্যায়ে একটি অভ্যন্তরীণ র্যাঙ্কিং ব্যবস্থা প্রবর্তনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারকে সুপারিশ করেছে ইউজিসি। আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিং ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষা, গবেষণা, পেটেন্ট, সাইটেশন, রেপুটেশন ও বৈশ্বিক সহযোগিতা ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে উক্ত র্যাঙ্কিং পদ্ধতি প্রবর্তিত হতে পারে এবং এ বিষয়ে কার্যক্রম গ্রহণ করার জন্য সরকার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করতে পারে বলে মনে করছে ইউজিসি।
উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়ে ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার গুণগতমান কাক্সিক্ষত পর্যায়ে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আর্থিক জোগান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই লক্ষ্য অর্জনে কমিশন কর্তৃক প্রণীত ও সরকার কর্তৃক অনুমোদিত স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান ফর হায়ার এডুকেশন : ২০১৮-২০৩০ অনুযায়ী উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধিতে সরকার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।
বিশ^ র্যাঙ্কিংয়ে দেশের বিশ^বিদ্যালয়গুলো পিছিয়ে পড়ার কারণ জানতে চাইলে ইউজিসি চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলমগীর গতকাল কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে এ বিষয়ে তিনি ইউজিসির এক সভায় বলেছেন, ইউজিসি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে গবেষণা কর্মকাণ্ডের প্রসারে জোর দিয়েছে। কাজেই, এপিএ চুক্তি বাস্তবায়নে দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নের বিভিন্ন সূচকের অগ্রগতির ওপর জোর দিতে হবে।
সূত্রমতে, গবেষণামূলক কাজ করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যতম বড় একটি দায়িত্ব। কিন্তু দেশের অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় গুরুত্ব দিচ্ছে না। শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৫ শতাংশ ২০২২ সালে গবেষণা খাতে এক টাকাও বরাদ্দ রাখেনি। এর মধ্যে কয়েকটি পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে। এ ছাড়া নতুন কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও ওই বছর গবেষণায় বরাদ্দ ছিল না। অবশ্য পরিচিত ও সুনাম থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণায় তুলনামূলক বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়। তুলনামূলকভাবে ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার অবস্থাও ভালো।
ইউজিসি সূত্রমতে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ ছিল ১০০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে বরাদ্দ ধরা হয় ১২১ কোটি ৫ লাখ টাকা।
তবে এই বরাদ্দ আরও বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ অধ্যাপক ড. মোহা. হাছানাত আলী সবুজ বাংলাকে বলেন, বিশ^বিদ্যালয়গুলোর র্যাঙ্ক বাড়াতে রাজনৈতিক বিবেচনার পরিবর্তে মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। তিনি বলেন, দেশে আজও সর্বজনীন শিক্ষানীতি করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির পরিবর্তে শিক্ষিত বেকার তৈরির ভয়াবহ কার্যক্রম চলছে। ইউজিসির অতিমাত্রায় সরকারমুখিতা ও দলীয় বিবেচনায় তুলনামূলক অদক্ষ ভিসি নিয়োগের কারণে বিশ^ মানে বিশ^বিদ্যালয়গুলো পিছিয়ে যাচ্ছে বলে এই শিক্ষাবিদের অভিমত।
নর্থ সাউথ বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলামের মতে, অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান অনেক উন্নত। তবে এসব বিশ^বিদ্যালয়ে এখনো পিএইচডি ডিগ্রি চালু না হওয়ায় বিশ^ র্যাঙ্কিংয়ে তারা পিছিয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল হক বলেন, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতিতে সুসংহত কাঠামো ও যথাযথ মূল্যায়ন ব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষাদানের সময়কে প্রাধান্য দিয়ে গবেষণাকে গৌণ করে ফেলা হয়েছে। যার প্রমাণ গবেষণাহীন এবং পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া অধ্যাপকের সংখ্যা এখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নেহাত কম নয়, যা উদ্বেগজনক। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণার সংখ্যা ও মান আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় এগোতে পারছে না। ইউজিসির প্রতিবেদন সূত্রমতে, ২০২২ সালে পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে ১৬ হাজার ৩৯৯ জন শিক্ষকের মধ্যে পিএইচডি ডিগ্রিধারীর সংখ্যা ৬ হাজার ২৩৮ জন (৩৮ শতাংশ)। এমফিল/সমমান ডিগ্রিধারী ১২১৬ (৭ শতাংশ)। আর স্নাতক/স্নাতকোত্তর/অন্যান্য ডিগ্রিধারী ৮ হাজার ৯৪৫ জন (৫৫ শতাংশ)। এর আগের দুই বছরেও প্রায় একই রকম চিত্র ছিল
সংশ্লিষ্টরা জানান, মৌলিক ও গুণগত মানসম্পন্ন প্রকাশনার সংখ্যা এবং প্রকাশিত প্রবন্ধের যথাযথ সাইটেশন বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিংয়ে উন্নতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। গবেষণা যত সমসাময়িক ও মৌলিক হবে, প্রকাশনা তত ভালো জার্নালে হবে এবং সাইটেশন তত বেশি হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিংয়ে স্ব-স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক, র্যাঙ্কিংভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। ওয়েবসাইটে কিছু তথ্য থাকলেও বেশির ভাগই থাকে পুরোনো, নিয়মিত হালনাগাদ করা হয় না। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল হক বলেন, বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে জায়গা পেতে হলে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলে চলবে না, শিক্ষার মান বজায় রাখার পাশাপাশি শিক্ষকদের গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে।





















