০৩:৫৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

উন্নয়নের নামে চলছে গাছ কাটার মহোৎসব

⦿কুমারখালীতে তিন কিলোমিটার সড়কে গাছ কাটার প্রস্তুতি
⦿লক্ষ্মীপুরে কাটা হবে ১৫ হাজার ২৪২টি গাছ
⦿খরাপ্রবণ উত্তরাঞ্চলে বন সৃজনের কোনো উদ্যোগ নেই
⦿আছে বর্ষাকালে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি

সারা দেশে উন্নয়ন কাজের নামে গাছ কাটা চলছেই। বিশেষ করে সড়ক প্রশস্ত করার নামে পুরোনো গাছগুলো কেটে ফেলার খবর পাওয়া যাচ্ছে। লক্ষ্মীপুরে সড়কের ১৫ হাজার ২৪২টি গাছ কাটার প্রস্তুতি চলছে। একইভাবে কুমারখালীতে তিন কিলোমিটার সড়কের গাছ কাটার জন্য নম্বর বসানো হয়েছে। এর আগে রাজধানীতেও সড়কের গাছ কাটার ঘটনা ঘটেছে। এভাবে একের পর এক গাছ কাটার বিরুপ প্রভাব মারাত্নকভাবে পড়ছে প্রকৃতিতে। বাড়ছে খরাপ্রবণতা, নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। আর এরজন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলা। এই অবস্থা প্রতিরোধে অনেক বেশি পরিমাণ গাছ লাগানো ও বন সৃষ্টির প্রতি জোর দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন সৌন্দর্য্যবর্দ্ধনের নামে জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের সামনে থেকে আবাহনী খেলার মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোণ পর্যন্ত সড়কের বিভাজকে থাকা সব গাছ কেটে ফেলেছে। বগুড়ার গাবতলী উপজেলার পল্লিতে এক নেতার বাড়িতে যাওয়ার সড়কের পাশের ১০টি ফলজ গাছ কাটা হয়েছে। শুধু বাড়ির সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য এই গাছ গুলি কাটা হয়েছে এমন অভিযোগ স্থানীয়দের। কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে সম্প্রতি বাঁধবাজার থেকে মাদুলিয়া পর্যন্ত আরও তিন কিলোমিটার সড়কের কয়েক হাজার গাছ কাটার জন্য গাছের গায়ে নম্বর লিখে দরপত্র সম্পন্ন করেছেন বনবিভাগের কর্মকর্তারা। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা। নওগাঁর ঐতিহাসিক আলতাদিঘী সংস্কারের জন্য ৫৪৬টি ইউক্যালিপটাস ও ৪৫৬টি আকাশমনিসহ ১ হাজার ২টি গাছ কাটা হয়েছে।

লক্ষ্মীপুর-রামগতি আঞ্চলিক সড়কের পাশে ১৩ হাজার ৪৪৫টি, রামগতি উপজেলার ১ হাজার ৬৭২টি এবং রামগঞ্জ উপজেলার ১২৫টিসহ মোট ১৫ হাজার ২৪২টি গাছ কাটার জন্য জেলা পরিবেশ ও বন উন্নয়ন কমিটি অনুমোদন দেয়। ফলে নিলাম প্রক্রিয়ার জন্য ওই সব গাছে ‘নাম্বারিং’ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে খরাপ্রবণ অঞ্চল হচ্ছে উত্তরবঙ্গ। সারাবছরে এখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও অনেক কম। বনহীন এ অঞ্চলে নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে জলাভূমির পরিমাণ। নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। দেশের ১৬টি জেলা নিয়ে উত্তরবঙ্গ গঠিত হলেও এই অঞ্চলে সবুজ বনভূমি নেই। আছে মাত্র ৫টি জাতীয় উদ্যান। নতুনভাবে কোন বনসৃজনের উদ্যোগ বন বিভাগের পরিকল্পনায় নেই। আছে শুধু বৃক্ষরোপন কর্মসূচি। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও নগর উন্নয়ন ও সড়ক উন্নয়নের নামে দেদারসে গাছকাটা চলছে। অবিলম্বে এই অঞ্চলকে মরুভূমি হওয়া প্রতিরোধে ও খরাপ্রবণতা কমাতে বনসৃজনের উদ্যোগ গ্রহণ ও জলবায়ুবান্ধব উন্নয়ন কার্যক্রম নেবার দাবি জানাচ্ছেন এলাকার সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকেরা।

দেশের উত্তরবঙ্গ বা উত্তরাঞ্চল মোট ১৬টি নিয়ে গঠিত। জেলাগুলো হচ্ছে রংপুর বিভাগ এর রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় জেলা নিয়ে এবং রাজশাহী বিভাগের রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, নাটোর, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট জেলা।

বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, নওগাঁর ধামুরহাট উপজেলায় আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যান অবস্থিত। এর আয়তন ২৬৪.১২ হেক্টর। দিনাজপুরে ২৭.৭৫ হেক্টর আয়তনের রামসাগর জাতীয় উদ্যান, ৩০৫.৬৯ হেক্টর আয়তনের সিংড়া জাতীয় উদ্যান, ৫১৭.৬১ হেক্টর আয়তনের নবাবগঞ্জ জাতীয় উদ্যান ও ১৬৮.৫৬ হেক্টর আয়তনের বিরগঞ্জ জাতীয় উদ্যান অবস্থিত। পাবনা জেলায় নগরবাড়ী মোহনগঞ্জ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, যার আয়তন ৪০৮.১১ ৩৬ হেক্টর, শিলন্দা-নাগডারমা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, আয়তন ২৪.১৭ ৩৭ হেক্টর, নাজিরগঞ্জ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ১৪৬.০০ হেক্টর। দিনাজপুর সামাজিক বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক নূরুন্নাহার বলেন, আমাদের অধীনের তিনটি জেলা দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় মিলে ২৭ হাজার ২শ ৭২ একর বনভূমি রয়েছে।

বাংলাদেশ ক্লাইমেট অ্যান্ড ডিজাস্টার রিস্ক অ্যাটলাস’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী দেশের খরাপ্রবণ জেলা হচ্ছে ২২টি। এগুলোর মোট জমির পরিমাণ প্রায় ৫৪ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর। খরাপ্রবণ এসব এলাকা মূলত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত। এর মধ্যে খরাপ্রবণ জেলা ১৩টি, খরা ও বন্যাপ্রবণ জেলা ছয়টি, খরা ও আকস্মিক বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে তিনটি জেলা। নওগাঁ, রাজশাহী, দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, ঠাকুরগাঁও এ ছয়টি জেলা খুবই উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে রয়েছে। ‘সাসটেইনিং গ্রাউন্ড ওয়াটার ইরিগেশন ফর ফুড সিকিউরিটি ইন দ্য নর্থইস্ট রিজিয়ন অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছে রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে পানির স্তর নামছে।

সামাজিক বন বিভাগ রাজশাহীর সহকারি বন সংরক্ষক মো. মেহেদীজ্জামান দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, রাজশাহী সামাজিক বনায়ন বিভাগ চারটি জেলা নিয়ে গঠিত। আমরা সামাজিক বনায়নের অংশ হিসেবে ২৬৫ সিবলিং কিলোমিটারে আমরা গাছ লাগাব। ১০০০ চারা রোপন করলে ১ কিলোমিটার হয়। প্রতিটি রাস্তা বা বাঁধের দুধারে ৫০০ করে ১০০০ চারা রোপণ করলে ১ সিবলিং কিলোমিটার হয়। এছাড়া আমাদের লক্ষ্যমাত্রা ব্রজপাত নিরোধক হিসেবে ১ লাখ ৪৮ হাজার ২শ ২৭টি তালগাছ রোপণ করা। জনসাধারণকে আমরা প্রতিবছরই বৃক্ষরোপণে উদ্বুদ্ধ করি। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন ক্লাব, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও তৃণমূলে আমরা বিনামূল্যে গাছের চারা বিতরণ করি। এর পরিমাণ ২ লাখ ৫০ হাজার চারা।

সড়ক বিভাগ রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য গাছ কেটে ফেলে। এখনও এই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যেখানেই রাস্তা সম্প্রসারণ সেখানেই গাছ কাটা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে মো. মেহেদীজ্জামান বলেন, সড়ক বিভাগ যেখানে রাস্তা সম্প্রসারণ করছে সেই প্রকল্পে তারা বনায়নের টাকা ধরে রাখছে। ওখানে পরবর্তীতে তারাই গাছ লাগাই।
ঝুঁকির মধ্যে থাকা অন্যতম জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার পৌরসভায় প্রবেশ করলে দেখা যায়, দ্বারিয়াপুর থেকে বিশ^রোড মোড় হয়ে অক্ট্রয় মোড় পর্যন্ত পুরো রাস্তার ধারে সরকারি ব্যবস্থাপনায় কোন ধরণের গাছ লাগানো হয়নি। ১৯৯৪ সালে এই রাস্তার দুধারে পুরনো বয়স্ক আমের গাছ থাকলেও সেগুলো রাস্তা সংস্করণের নামে কেটে ফেলা হয়। এরপর থেকে এই রাস্তায় নতুন কোন গাছ লাগানো হয়নি।

রাস্তার ধারে গাছ নেই পৌরসভার বিশ^রোড মোড় থেকে শুরু করে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতু পর্যন্ত। কোন গাছ নেই পৌরসভার হুজরাপুর থেকে সদরঘাট পর্যন্ত রাস্তায়। এ প্রসঙ্গে সামাজিক বন বিভাগ রাজশাহীর সহকারী বন সংরক্ষক মো. মেহেদীজ্জামান বলেন, বনবিভাগ গাছের চারা বরাদ্দ দেয় কিন্তু পৌরসভার মধ্যে যে রাস্তা থাকে সেগুলোতে গাছ লাগানোর দায়িত্ব পৌরসভার। এ প্রসঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার নগর পরিকল্পনাবিদ মো. ইমরান হোসাইন দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, আমরা গাছ লাগাব। কাউন্সিলরদের কাছ থেকে তালিকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। হাইওয়ের পাশে গাছ লাগানোটা আমাদের এখতিয়ার বহির্ভূত। এই রোডটি ডাবল লেন করার প্রস্তাব দেয়া আছে। এটা হওয়ার পর আমরা সেখানে গাছ লাগাব। তবে, এবারের বৃক্ষরোপন কার্যক্রম চলবে। সমগ্র পৌরসভা এলাকায় এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুর সঙ্গে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতুর সংযোগ সড়ক, ১ কিলোমিটার এটি সম্পূর্ণ নতুনভাবে তৈরি হচ্ছে। সেই রাস্তাটিসহ মোট ১৫টি ওয়ার্ডে সাড়ে সাত হাজার গাছের চারা লাগানোর পরিকল্পনা আছে।

বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কার্যনির্বাহী সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মো. শহীদুল ইসলাম সরকার দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, আমাদের উত্তরবঙ্গে যেহেতু খরাপ্রবন, পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। তাই এখানে আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে গাছ লাগাই। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ারোধে আমাদের উপরের পানির উপর নির্ভরতা বাড়াতে হবে। আমাদের মহানন্দা নদী, জলাশয়গুলো রক্ষা করতে হবে। নদীকে রক্ষা করে নদীর পানি ব্যবহার করতে হবে। বৃষ্টির পানিকে ব্যবহার করতে হবে। আমরা রাজশাহীতেও দেখেছি যত পুকুরগুলো ছিল সব বন্ধ করে সেগুলোর উপর ভবন নির্মাণ করছে। এক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা দরকার। তারা নদী, জলাশয় এগুলো রক্ষা করতে ভূমিকা রাখবে। খরা থেকে রক্ষায় কি করা দরকার সেটা তাদের দেখতে হবে। আমরা যারা সমাজকর্মী আছি তাদেরও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের চাঁপাইনবাবগঞ্জে পানির একমাত্র উৎস মহানন্দা।

এই নদীকে কিভাবে জীবিত রাখা যায় তা ভাবতে হবে। খরা প্রতিরোধে আমরা জেলায় গাছ লাগাই। এছাড়া পৌরসভা, বনবিভাগ সবাইকে জেলায় গাছ লাগানোর প্রতি নজর দিতে হবে। আমরা পার্টির পক্ষ থেকেও গাছ লাগাই। আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে সাড়ে আট হাজার তালগাছ লাগিয়েছি। এবারও তিন হাজার গাছ লাগাব এমন পরিকল্পনা আছে। এই গাছ আমার ক্লাসমেটরা দিচ্ছে। আসলে জেলার পরিবেশের উন্নয়নে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, স্থানীয় জনগণ, সমাজকর্মী সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। এছাড়া এই জেলার পরিবেশের উন্নয়ন সম্ভব না।

জনপ্রিয় সংবাদ

নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে সামান্তা শারমিনের নতুন বার্তা

উন্নয়নের নামে চলছে গাছ কাটার মহোৎসব

আপডেট সময় : ০৬:২৪:২৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ মে ২০২৪

⦿কুমারখালীতে তিন কিলোমিটার সড়কে গাছ কাটার প্রস্তুতি
⦿লক্ষ্মীপুরে কাটা হবে ১৫ হাজার ২৪২টি গাছ
⦿খরাপ্রবণ উত্তরাঞ্চলে বন সৃজনের কোনো উদ্যোগ নেই
⦿আছে বর্ষাকালে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি

সারা দেশে উন্নয়ন কাজের নামে গাছ কাটা চলছেই। বিশেষ করে সড়ক প্রশস্ত করার নামে পুরোনো গাছগুলো কেটে ফেলার খবর পাওয়া যাচ্ছে। লক্ষ্মীপুরে সড়কের ১৫ হাজার ২৪২টি গাছ কাটার প্রস্তুতি চলছে। একইভাবে কুমারখালীতে তিন কিলোমিটার সড়কের গাছ কাটার জন্য নম্বর বসানো হয়েছে। এর আগে রাজধানীতেও সড়কের গাছ কাটার ঘটনা ঘটেছে। এভাবে একের পর এক গাছ কাটার বিরুপ প্রভাব মারাত্নকভাবে পড়ছে প্রকৃতিতে। বাড়ছে খরাপ্রবণতা, নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। আর এরজন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলা। এই অবস্থা প্রতিরোধে অনেক বেশি পরিমাণ গাছ লাগানো ও বন সৃষ্টির প্রতি জোর দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন সৌন্দর্য্যবর্দ্ধনের নামে জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের সামনে থেকে আবাহনী খেলার মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোণ পর্যন্ত সড়কের বিভাজকে থাকা সব গাছ কেটে ফেলেছে। বগুড়ার গাবতলী উপজেলার পল্লিতে এক নেতার বাড়িতে যাওয়ার সড়কের পাশের ১০টি ফলজ গাছ কাটা হয়েছে। শুধু বাড়ির সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য এই গাছ গুলি কাটা হয়েছে এমন অভিযোগ স্থানীয়দের। কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে সম্প্রতি বাঁধবাজার থেকে মাদুলিয়া পর্যন্ত আরও তিন কিলোমিটার সড়কের কয়েক হাজার গাছ কাটার জন্য গাছের গায়ে নম্বর লিখে দরপত্র সম্পন্ন করেছেন বনবিভাগের কর্মকর্তারা। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা। নওগাঁর ঐতিহাসিক আলতাদিঘী সংস্কারের জন্য ৫৪৬টি ইউক্যালিপটাস ও ৪৫৬টি আকাশমনিসহ ১ হাজার ২টি গাছ কাটা হয়েছে।

লক্ষ্মীপুর-রামগতি আঞ্চলিক সড়কের পাশে ১৩ হাজার ৪৪৫টি, রামগতি উপজেলার ১ হাজার ৬৭২টি এবং রামগঞ্জ উপজেলার ১২৫টিসহ মোট ১৫ হাজার ২৪২টি গাছ কাটার জন্য জেলা পরিবেশ ও বন উন্নয়ন কমিটি অনুমোদন দেয়। ফলে নিলাম প্রক্রিয়ার জন্য ওই সব গাছে ‘নাম্বারিং’ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে খরাপ্রবণ অঞ্চল হচ্ছে উত্তরবঙ্গ। সারাবছরে এখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও অনেক কম। বনহীন এ অঞ্চলে নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে জলাভূমির পরিমাণ। নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। দেশের ১৬টি জেলা নিয়ে উত্তরবঙ্গ গঠিত হলেও এই অঞ্চলে সবুজ বনভূমি নেই। আছে মাত্র ৫টি জাতীয় উদ্যান। নতুনভাবে কোন বনসৃজনের উদ্যোগ বন বিভাগের পরিকল্পনায় নেই। আছে শুধু বৃক্ষরোপন কর্মসূচি। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও নগর উন্নয়ন ও সড়ক উন্নয়নের নামে দেদারসে গাছকাটা চলছে। অবিলম্বে এই অঞ্চলকে মরুভূমি হওয়া প্রতিরোধে ও খরাপ্রবণতা কমাতে বনসৃজনের উদ্যোগ গ্রহণ ও জলবায়ুবান্ধব উন্নয়ন কার্যক্রম নেবার দাবি জানাচ্ছেন এলাকার সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকেরা।

দেশের উত্তরবঙ্গ বা উত্তরাঞ্চল মোট ১৬টি নিয়ে গঠিত। জেলাগুলো হচ্ছে রংপুর বিভাগ এর রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় জেলা নিয়ে এবং রাজশাহী বিভাগের রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, নাটোর, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট জেলা।

বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, নওগাঁর ধামুরহাট উপজেলায় আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যান অবস্থিত। এর আয়তন ২৬৪.১২ হেক্টর। দিনাজপুরে ২৭.৭৫ হেক্টর আয়তনের রামসাগর জাতীয় উদ্যান, ৩০৫.৬৯ হেক্টর আয়তনের সিংড়া জাতীয় উদ্যান, ৫১৭.৬১ হেক্টর আয়তনের নবাবগঞ্জ জাতীয় উদ্যান ও ১৬৮.৫৬ হেক্টর আয়তনের বিরগঞ্জ জাতীয় উদ্যান অবস্থিত। পাবনা জেলায় নগরবাড়ী মোহনগঞ্জ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, যার আয়তন ৪০৮.১১ ৩৬ হেক্টর, শিলন্দা-নাগডারমা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, আয়তন ২৪.১৭ ৩৭ হেক্টর, নাজিরগঞ্জ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ১৪৬.০০ হেক্টর। দিনাজপুর সামাজিক বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক নূরুন্নাহার বলেন, আমাদের অধীনের তিনটি জেলা দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় মিলে ২৭ হাজার ২শ ৭২ একর বনভূমি রয়েছে।

বাংলাদেশ ক্লাইমেট অ্যান্ড ডিজাস্টার রিস্ক অ্যাটলাস’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী দেশের খরাপ্রবণ জেলা হচ্ছে ২২টি। এগুলোর মোট জমির পরিমাণ প্রায় ৫৪ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর। খরাপ্রবণ এসব এলাকা মূলত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত। এর মধ্যে খরাপ্রবণ জেলা ১৩টি, খরা ও বন্যাপ্রবণ জেলা ছয়টি, খরা ও আকস্মিক বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে তিনটি জেলা। নওগাঁ, রাজশাহী, দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, ঠাকুরগাঁও এ ছয়টি জেলা খুবই উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে রয়েছে। ‘সাসটেইনিং গ্রাউন্ড ওয়াটার ইরিগেশন ফর ফুড সিকিউরিটি ইন দ্য নর্থইস্ট রিজিয়ন অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছে রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে পানির স্তর নামছে।

সামাজিক বন বিভাগ রাজশাহীর সহকারি বন সংরক্ষক মো. মেহেদীজ্জামান দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, রাজশাহী সামাজিক বনায়ন বিভাগ চারটি জেলা নিয়ে গঠিত। আমরা সামাজিক বনায়নের অংশ হিসেবে ২৬৫ সিবলিং কিলোমিটারে আমরা গাছ লাগাব। ১০০০ চারা রোপন করলে ১ কিলোমিটার হয়। প্রতিটি রাস্তা বা বাঁধের দুধারে ৫০০ করে ১০০০ চারা রোপণ করলে ১ সিবলিং কিলোমিটার হয়। এছাড়া আমাদের লক্ষ্যমাত্রা ব্রজপাত নিরোধক হিসেবে ১ লাখ ৪৮ হাজার ২শ ২৭টি তালগাছ রোপণ করা। জনসাধারণকে আমরা প্রতিবছরই বৃক্ষরোপণে উদ্বুদ্ধ করি। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন ক্লাব, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও তৃণমূলে আমরা বিনামূল্যে গাছের চারা বিতরণ করি। এর পরিমাণ ২ লাখ ৫০ হাজার চারা।

সড়ক বিভাগ রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য গাছ কেটে ফেলে। এখনও এই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যেখানেই রাস্তা সম্প্রসারণ সেখানেই গাছ কাটা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে মো. মেহেদীজ্জামান বলেন, সড়ক বিভাগ যেখানে রাস্তা সম্প্রসারণ করছে সেই প্রকল্পে তারা বনায়নের টাকা ধরে রাখছে। ওখানে পরবর্তীতে তারাই গাছ লাগাই।
ঝুঁকির মধ্যে থাকা অন্যতম জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার পৌরসভায় প্রবেশ করলে দেখা যায়, দ্বারিয়াপুর থেকে বিশ^রোড মোড় হয়ে অক্ট্রয় মোড় পর্যন্ত পুরো রাস্তার ধারে সরকারি ব্যবস্থাপনায় কোন ধরণের গাছ লাগানো হয়নি। ১৯৯৪ সালে এই রাস্তার দুধারে পুরনো বয়স্ক আমের গাছ থাকলেও সেগুলো রাস্তা সংস্করণের নামে কেটে ফেলা হয়। এরপর থেকে এই রাস্তায় নতুন কোন গাছ লাগানো হয়নি।

রাস্তার ধারে গাছ নেই পৌরসভার বিশ^রোড মোড় থেকে শুরু করে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতু পর্যন্ত। কোন গাছ নেই পৌরসভার হুজরাপুর থেকে সদরঘাট পর্যন্ত রাস্তায়। এ প্রসঙ্গে সামাজিক বন বিভাগ রাজশাহীর সহকারী বন সংরক্ষক মো. মেহেদীজ্জামান বলেন, বনবিভাগ গাছের চারা বরাদ্দ দেয় কিন্তু পৌরসভার মধ্যে যে রাস্তা থাকে সেগুলোতে গাছ লাগানোর দায়িত্ব পৌরসভার। এ প্রসঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার নগর পরিকল্পনাবিদ মো. ইমরান হোসাইন দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, আমরা গাছ লাগাব। কাউন্সিলরদের কাছ থেকে তালিকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। হাইওয়ের পাশে গাছ লাগানোটা আমাদের এখতিয়ার বহির্ভূত। এই রোডটি ডাবল লেন করার প্রস্তাব দেয়া আছে। এটা হওয়ার পর আমরা সেখানে গাছ লাগাব। তবে, এবারের বৃক্ষরোপন কার্যক্রম চলবে। সমগ্র পৌরসভা এলাকায় এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুর সঙ্গে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতুর সংযোগ সড়ক, ১ কিলোমিটার এটি সম্পূর্ণ নতুনভাবে তৈরি হচ্ছে। সেই রাস্তাটিসহ মোট ১৫টি ওয়ার্ডে সাড়ে সাত হাজার গাছের চারা লাগানোর পরিকল্পনা আছে।

বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কার্যনির্বাহী সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মো. শহীদুল ইসলাম সরকার দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, আমাদের উত্তরবঙ্গে যেহেতু খরাপ্রবন, পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। তাই এখানে আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে গাছ লাগাই। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ারোধে আমাদের উপরের পানির উপর নির্ভরতা বাড়াতে হবে। আমাদের মহানন্দা নদী, জলাশয়গুলো রক্ষা করতে হবে। নদীকে রক্ষা করে নদীর পানি ব্যবহার করতে হবে। বৃষ্টির পানিকে ব্যবহার করতে হবে। আমরা রাজশাহীতেও দেখেছি যত পুকুরগুলো ছিল সব বন্ধ করে সেগুলোর উপর ভবন নির্মাণ করছে। এক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা দরকার। তারা নদী, জলাশয় এগুলো রক্ষা করতে ভূমিকা রাখবে। খরা থেকে রক্ষায় কি করা দরকার সেটা তাদের দেখতে হবে। আমরা যারা সমাজকর্মী আছি তাদেরও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের চাঁপাইনবাবগঞ্জে পানির একমাত্র উৎস মহানন্দা।

এই নদীকে কিভাবে জীবিত রাখা যায় তা ভাবতে হবে। খরা প্রতিরোধে আমরা জেলায় গাছ লাগাই। এছাড়া পৌরসভা, বনবিভাগ সবাইকে জেলায় গাছ লাগানোর প্রতি নজর দিতে হবে। আমরা পার্টির পক্ষ থেকেও গাছ লাগাই। আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে সাড়ে আট হাজার তালগাছ লাগিয়েছি। এবারও তিন হাজার গাছ লাগাব এমন পরিকল্পনা আছে। এই গাছ আমার ক্লাসমেটরা দিচ্ছে। আসলে জেলার পরিবেশের উন্নয়নে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, স্থানীয় জনগণ, সমাজকর্মী সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। এছাড়া এই জেলার পরিবেশের উন্নয়ন সম্ভব না।