⦿ পণ্যের মান নিশ্চিতে বিএসটিআইয়ের তৎপরতা নিয়ে নানা প্রশ্ন
⦿ জরিমানা, সিলগালা ও অভিযানেও থামছে না ভেজাল পণ্য
⦿ জনবল সংকটে ব্যাহত বিএসটিআইয়ের পর্যাপ্ত তদারকি ও অভিযান
⦿ মানহীন পণ্য ব্যবহারে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ
⦿ ভেজাল খাবারে শিশুর ক্যান্সারের ঝুঁকি দেখছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা
➥মানুষ ভেজাল খাদ্য খেয়ে অসুস্থ হওয়া মানে এটি দেশের জন্য ক্ষতিকর ডা. লেলিন চৌধুরী, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
➥বিএসটিআই কর্মকর্তাদের সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার ঘাটতি আছে এস এম নাজের হোসেন, সহ-সভাপতি (ক্যাব)
➥আমাদের যে পরিমাণ কার্যপরিধি সে পরিমাণ লোকবল নেই রিয়াজুল হক, উপ-পরিচালক (সিএম), বিএসটিআই
যে কোনো পণ্য কিনতে গেলেই ক্রেতাদের মনে সন্দেহ জাগে যে, সেটি খাঁটি নাকি ভেজাল। কারণ দেশে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা-বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই) সনদের আড়ালে বা সনদ ছাড়াই বাজারে আসে ভেজাল ও নিম্নমানের নানা পণ্য। সারাদেশেই মানহীন পণ্যে এখন বাজার সয়লাব, দিনদিন এর পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্যতম হচ্ছে খাদ্য। অথচ সেই খাদ্য এখন জনজীবনে প্রধান আতঙ্কের কারণ হয়ে ওঠেছে। নিয়মিত অভিযান পরিচালনা, জরিমানা ও সিলগালা করার পরও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না ভেজাল ও মানহীন পণ্যের বাজার। পাশাপাশি জনবল সংকটের কারণে খাদ্য মনিটরিং করার দায়িত্ব যাদের তাদের অনেকটা গা-ছাড়া ভাব। বলতে গেলে ভেজাল প্রতিরোধে যে পরিমাণ তদারকির প্রয়োজন সেক্ষেত্রে তারা অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। সংস্থাটির (বিএসটিআই) দাবি, আমাদের যে পরিমাণ জনবল প্রয়োজন তার তুলনায় অনেক কম। সারাদেশে বাজারের অধিকাংশ খাদ্য ও প্রসাধন সামগ্রীসহ নিত্য ব্যবহার্য পণ্যে মানহীন। আর এসব মানহীন পণ্য ব্যবহার করে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে যেমন দেশে উৎপাদিত পণ্য রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিদেশ থেকে আমদানি পণ্যসামগ্রীও। একদিকে যেমন এসব পণ্য উৎপাদন হচ্ছে দূষিত পরিবেশে, মানহীনভাবে; তেমনি বিক্রি হচ্ছে কম ওজনে ও মেয়াদ উত্তীর্ণের পরও। এ থেকে বাদ যাচ্ছে না শিশুখাদ্য থেকে রোগীর খাবার পর্যন্ত। এতে ভোক্তারা শুধু ঠকছেই না, ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে জনস্বাস্থ্যে। পরিস্থিতি অনেকটা এমন, এসব পণ্যের মোড়ক দেখে কোনটা আসল, কোনটা নকল- তা বুঝে ওঠার উপায় নেই।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ভেজাল খাবারের কারণে শিশুর পেটের পীড়া, চর্মরোগ তো দেখাই যাচ্ছে। ঝুঁকি আছে শিশুর কিডনি ও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার। শিশুর ক্যান্সারেরও কারণ হতে পারে এসব খাদ্য।
বিএসটিআই কর্তৃক সার্টিফিকেশন মার্কস (সিএম) এর আওতায় বাধ্যতামূলক ২৭৩টি পণ্য। এর মধ্যে কৃষি ও খাদ্যপণ্য-১০০টি, কেমিক্যাল-৭৩টি, প্রকৌশল-২৯টি, পাট ও বস্ত্র-২৪টি, ইলেক্ট্রিক্যাল ও ইলেক্ট্রনিক্স-৪১টি এই তালিকায় প্যাকেটজাত অনেক পণ্য বিএসটিআইয়ের তালিকাভুক্ত নয় বলে অনুমোদন নেয়া বাধ্যতামূলক নয়। অথচ জনপ্রিয় কিছু পণ্য বিক্রি হচ্ছে অনায়াসে। কোনো কোনো উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নিজ উদ্যোগে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন নিয়েছে। বাকিদের বেশিরভাগই অনুমোদনহীন।
বিভিন্ন মৌসুমকে কেন্দ্র করে নিয়মিত সক্রিয় তাদের এই চক্র সারা বছর তাদের এই কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। বাজারে এমন অনেক জনপ্রিয় পণ্য রয়েছে যেগুলোর বিএসটিআইয়ের কোনো সনদ নেই। তেমনই একটি জনপ্রিয় পণ্য ঝালমুড়ি। বিএসটিআইয়ের অনুমোদিত পণ্যতালিকার মধ্যে চানাচুর ও মুড়ি আলাদাভাবে সনদ পেলেও একসঙ্গে প্যাকেটজাত চানাচুর ও মুড়ির নাম নেই। অভিযানে শিশুদের পছন্দের যেসব ব্র্যান্ডের নকল পণ্য পাওয়া যায় সেগুলোর মধ্যে আছে ভারতের ডেইরি মিল্ক, কিটক্যাট, কিন্ডার জয়, বাংলাদেশের প্রাণ ডেইরির জুস, আইস ললি, অরেঞ্জ ড্রিংকস, লিচি ড্রিংকস, মিল্ক ক্যান্ডি, ম্যাংগো ক্যান্ডিসহ বিভিন্ন ধরনের জুস, চিপস ও তেঁতুলের আচার। দেশের নামি প্রতিষ্ঠান এসব পণ্য বাজারজাত করলেও মান নিরূপণে বিএসটিআইয়ের নেই কোনো উদ্যোগ।
বিএসটিআইয়ের বাধ্যতামূলক মান সনদের আওতাভুক্ত পণ্যের সংখ্যা ২৭৩টি। এর মধ্যে খাদ্য ও কৃষিজাত পণ্যের সংখ্যা ১০০টি। যেখানে স্থান পায়নি বাজারে প্রচলিত আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ পণ্য ও সেবা। সেসব পণ্যের মান নিয়ে বিএসটিআইয়ের যেমন মাথাব্যথা নেই, তেমনি অনুমোদনহীন লোগোর বিরুদ্ধেও নেই দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ।
বিএসটিআই কর্তৃক জুলাই-২৩ থেকে এপ্রিল-২৪ পর্যন্ত ১০ মাসে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে-১৪৮২টি, বিশেষ অভিযান-২১৮৪টি, মামলা দায়ের-১৯৫৬, মামলা নিষ্পত্তি-১৯৫৩, কারখানা/ পেট্রোল পাম্প সিলগালা-৫৫৫টি, বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড-৫টি, জরিমানা আদায়-৬৫৫.৬২ লাক টাকা।
নকল বা ভেজাল স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়ে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী সবুজ বাংলাকে বলেন, যে পণ্যগুলোর বাজার মানুষের ব্যবহারের জন্য আসে সেগুলো অবশ্যই জনস্বাস্থ্যের নিরিখে মানসম্পন্ন হতে হবে তা না হলে মানুষের স্বাস্থ্যকে বিকৃত করে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। শিশুরা বক্ষণশীল তাদের বেড়ে ওঠার প্রধানত শর্ত হচ্ছে সুষম পুষ্টিকর খাবার। খাবারটি অবশ্যই ভেজালমুক্ত হতে হবে। বাজারে ভেজাল খাবারে ফলে এটি শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য বাধাগ্রস্ত হবে, শারীরিক স্বাস্থ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে একদিকে যেমন শিশু পুষ্টিহীনতার শিকার হচ্ছে, তার শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে এবং অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। শিশুরা অসুস্থ হচ্ছে মানে আগামীতে একটি সুস্থ জাতি গড়ে তুলার পক্ষে অন্তরায়। প্রতিটা মানুষ ভেজাল খাদ্য খেয়ে অসুস্থ হওয়া মানে এটি দেশের জন্য ক্ষতিকর, এতে করে জাতির শ্রম ঘণ্টা নষ্ট হবে। পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিকভাবে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তিনি আরও বলেন, দেশের উন্নয়ন ধারা অব্যাহত রাখার জন্য মানুষের সুস্থতা জরুরি। সুস্থতার জন্য খাদ্য অত্যন্ত জরুরি। এজন্য শুধুমাত্র বিএসটিআই না পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য, ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর সকলে সম্মিলিতভাবে চিরনি অভিযানের মাধ্যমে বাজারে সকল পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করা। পাশাপাশি বাজারে যেগুলো ভেজাল, নকল, মানহীন সেগুলোকে আইনের আওতায় এনে সঠিক শাস্তি নিশ্চিত করা। কারণ সুস্থতার জন্য খাদ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলার কাউকে অধিকার দেওয়া হয় নাই।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন সবুজ বাংলাকে বলেন, বিএসটিআই সবসময় তাদের লোকবল সংকট, লজিস্টিক সংকট বলে আসতেছে। বর্তমানে যে পরিমাণ লোকবল আছে তাদের নিয়ে যতটুকু সম্ভব কার্যক্রম পরিচালনা করলে এই সমস্যা কিছুটা কম হতো। স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে সুশাসন জরুরি এটি বাদ দিয়ে স্মার্ট চিন্তা করা যায় না। বর্তমানে বিএসটিআই কর্মকর্তার কারও কাছে জবাবদিহি করতে চাই না। যার কারণে এই সমস্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। তাদের যে ধরনের সেবা দেওয়ার কথা তারা নিশ্চিত করতে পারছে না। তাদের সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার ঘাটতি। তারা যথাযথ পালন না করার কারণে এই সমস্যা হচ্ছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসটিআই সার্টিফিকেশন মার্কস উইংয়ের উপ-পরিচালক মো. রিয়াজুল হক সবুজ বাংলাকে বলেন, আমাদের নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, বিশেষ অভিযান চলমান আছে। আমাদের যে পরিমাণ কার্য পরিধি সে পরিমাণ লোকবল নেই। বর্তমানে যারা আছেন সবাই নিয়মিত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে করে বাজারে খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণ ও ভেজাল পণ্য চিহ্নিত করে খাদ্যের মান ঠিক রাখা যায়।


























