০২:৪৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে দ্রুত আইন প্রণয়নের তাগিদ চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের

➤স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে প্রায় ৪৫টি আইন জড়িত থাকলেও তার কোন সুফল মিলছে না

❖আইনটি দ্রুত পাস হলে সবার জন্যই ভালো-প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ
❖চিকিৎসা ব্যবস্থা আরো গতিশীল হবে-ডা. এমএ আজিজ, সাবেক মহাসচিব, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)
❖সমন্বিত একটি স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রনয়ন করা একটি জনদাবি- ডা. লেলিন চৌধুরী, নির্বাহী সভাপতি, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)
❖খসড়া আইনে স্বাস্থ্যসেবার দুই পক্ষকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি- অধ্যাপক ডা. ফিরোজ আহমেদ খান, সভাপতি, ডক্টরস ফর হেলথ এন্ড এনভায়রনমেন্ট
❖একটি যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করা জরুরি- এডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম

স্বাধীনতার পর থেকে ৫৩ বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। স্বাস্থ্যসেবা খাতে নানা প্রতিষ্ঠান ও পরিধি বৃদ্ধি পেলেও আইন, নীতিমালার সংস্কার ও উন্নয়ন সে অনুসারে হয়নি। আইনের দূর্বলতার কারণে মানসম্মত আর মানহীনদের চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে চিকিৎসা ব্যবস্থার মানহীনদের ভোগান্তির দায় সকলকে বহন করতে হচ্ছে। আইনের সীমাবদ্ধতা, নজরদারির অভাব, স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরস না থাকাসহ নানা কারণে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো মানুষের আস্থা হারাচ্ছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনটি প্রণয়নের কাজ দীর্ঘদিন ধরে চলমান থাকলেও এখনো তা সম্পন্ন হয়নি। খসড়া আইনটির ওপর এখনো মতামত গ্রহণ চলছে। তবে এ আইনকে দুর্বল ও বিলম্বিত করতে স্বার্থান্বেষীরা সক্রিয় রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। তাই স্বাস্থ্যখাতের সার্বিক উন্নয়নে সরকারকে সতর্কতার সাথে স্বাস্থ্য সেবার জন্য পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন করা জরুরি বলে মনে করেন চিকিৎসাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা।

 

আইনটি প্রসঙ্গে এডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, জনস্বাস্থ্য, সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সাথে প্রায় ৪৫টি আইন জড়িত। তবে হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ দি মেডিকেল প্র্যাকটিস এন্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস এন্ড ল্যাবোরাটোরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২’ আইনের আওতায় পরিচালিত হয়ে আসছিল, কিন্তু এখন এ আইনের কার্যকারিতা নেই। এছাড়া ভোক্তা অধিকার আইন, দন্ডবিধিতে কতিপয় ধারায় স্বাস্থ্য সুরক্ষার কিছু বিধান রয়েছে। এ আইনগুলোর কোনটিই পুর্ণাঙ্গ নয় এবং বর্তমানে বাংলাদেশের বিশাল স্বাস্থ্য খাত ব্যবস্থাপনার জন্য পর্যাপ্ত নয়। আর এ বাস্তবতায় স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্য সেবা গ্রহীতার সুরক্ষা প্রদান এবং প্রতিষ্ঠানসমূহের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করবার লক্ষ্যে একটি যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করা জরুরি।

 

আইনটি প্রসঙ্গে আরো বলা হয়, প্রস্তাবিত আইনের শুরুতে ‘অপরাধী’ সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যা নেতিবাচক ধারণার জন্ম দেয়। আইনের খসড়ায় ‘অবহেলা’ সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মেডিক্যাল নেগলিজ্যান্স বা চিকিৎসা অবহেলার বিষয়গুলো এ সংজ্ঞায় যুক্ত করা হয়নি। বরং, অবহেলা চিহ্নিত করতে হাসপাতাল বা চিকিৎসা সহায়তা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব, চিকিৎসক, নার্স, চিকিৎসা সহায়তাকারী, উপকরণ সরবরাহকারী, রোগী, রোগীর এটেনডেন্টদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সুনির্দিষ্ট করা উচিত। অন্যথায় চিকিৎসা অবহেলার দায় শুধু চিকিৎসদের উপর বর্তাবে। পাবলিক হাসপাতাল, দাতব্য হাসপাতালের মতো গুরুত্বপুর্ণ প্রতিষ্ঠানকে আলাদা করে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। এতে পাবলিক হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা আইনি চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়তে পারে। এছাড়া, টেলিমেডিসিন, ন্যানো টেকনোলজি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডিজিটাল, ডাটা সংরক্ষণ -ইত্যাদি বিষয়গুলো আইনে যুক্ত করা হয়নি।

 

আইনটি প্রসঙ্গে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)’র সাবেক মহাসচিব ডা. এমএ আজিজ বলেন, এই আইনটা হলে খুব ভালো হয়। এটি হলে চিকিৎসক, রোগী, হাসপাতালের মালিক সবার উপকার হবে। যখন আইনটা নিয়ে কথা শুরু হয় তখন আমরা অনেক সেমিনার সিম্পোজিয়াম করেছি জেলা উপজেলার মানুষদের সঙ্গে। বিভিন্ন অনলাইনে দেওয়া হয়েছে। সবার মতামত নেয়া হয়েছে। তিনটি গ্রুপের স্বার্থ ছিল। চিকিৎসকরা যদি মনে করে, রোগীরা যদি মনে করে এবং প্রতিষ্ঠানের মালিক যদি মনে করে একই আইনের আশ্রয় নিতে পারবে। এটা একটা ভালো আইন। এটা যদি তাড়াতাড়ি পাস হয় তাহলে চিকিৎসকদের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি কমে যাবে। রোগীরাও সুন্দর সেবা পাবে এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা আরো গতিশীল হবে। চিকিৎসকদের জন্য ভালো হবে। বিভিন্ন জায়গার অপ্রীতিকর ঘটনাও কমে যাবে এবং রোগীর স্বজনরাও চাইলে আইনের আশ্রয় নিতে পারবে। কোন অদৃশ্য কারণে এই আইনটা হচ্ছে না আমরা জানি না।

 

তিনি বলেন, কিন্তু ডাক্তার সমাজ আমরা চাই দ্রুত আইনটা সংসদে পাস হোক। এটা শুধু চিকিৎসক সমাজের জন্য না রোগীদের জন্যও এটা উপহার হবে। এতে রোগী স্বার্থ সংরক্ষিত থাকবে। প্রতিষ্ঠানের মালিক সরকারি বেসরকারি যেই হোক তাদেরও স্বার্থ সুরক্ষা থাকবে এই আইনে। সুতরাং আমরা চাই যে, এই আইনটা দ্রুত পাস হোক। তিনি বলেন, ধরেন কোথাও ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হলে সঙ্গে সঙ্গে ফৌজদারি মামলায় চিকিৎসককে এরেস্ট করে। পরে দেখা গেল এটা প্রমাণিত হয়নি। এই যে ভীতিকর অবস্থায় থাকে চিকিৎসকরা। আমরা চাচ্ছিলাম এই সমস্ত কেসে যে অভিযোগ আসে সেটার তদন্ত হোক। এরেস্ট না করে স্পেসিফিক যে গাইডলাইন আছে তাদের অভিযোগ তদন্ত করা। তদন্তে যদি শাস্তির বিষয় আসে তখন সেটা দেয়া হবে। আইনের বিধানে যা শাস্তি হবে তা হোক আমাদের আপত্তি নেই কিন্তু একটা নিউজ হলেই ভুল চিকিৎসার অভিযোগে চিকিৎসককে এরেস্ট করলে এই জায়গাটা আমাদের চিকিৎসকদের জন্য কমফোর্টেবল না। এটার কারণে চিকিৎসকরাও জরুরি রোগীর চিকিৎসা দিতে অস্বস্তিতে ভোগে। এটা আল্টিমেটলি রোগীর জন্য, মানুষের জন্য ভালো হবে না।

 

আইনটি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, আইনটির বৈঠকে আমার সেভাবে থাকা হয়নি তাই এতে ঠিক কি কি আছে আমি সেভাবে এখন আর বলতে পারছিনা। তবে, আইনটি দ্রুত পাস হলে সবার জন্যই ভালো হবে। ভালোর জন্যই আইনটি করা হচ্ছে।

 

বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, চিকিৎসার ব্যর্থতার দায় নেয়ার পাশাপাশি আগামী দিনে সকল নাগরিকের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। আইনের উদ্দেশ্য শুধু এ খাতের মানুষকে সাজা প্রদান নয়, বরং স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত সকলকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সঠিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে।

 

ডক্টরস ফর হেলথ এন্ড এনভায়রনমেন্ট এর সভাপতি অধ্যাপক ডা. ফিরোজ আহমেদ খান বলেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা বলতে চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ও গ্রহণকারী দুটো পক্ষকে বুঝাবে। কিন্তু খসড়া আইনে উভয় পক্ষকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। বর্তমানে চিকিৎসকদের কর্মক্ষেত্র সুরক্ষিত নয়। অবহেলাজনিত কারণে ক্রিমিনাল কেস দাখিল করা হচ্ছে এবং অবহেলা বা অপরাধ প্রমাণের আগেই চিকিৎসকদের হাতকড়া পরানো হচ্ছে। পৃথিবীর কোন দেশে অবহেলা ক্রিমিনাল কেস হিসাবে গণ্য হয় না।

 

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)’র নির্বাহী সভাপতি ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্যসেবার সাথে চারটি পক্ষ যুক্ত। প্রথমে সরকার, সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও আইন প্রণয়ন করা। সে আইনের অধীনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্যসেবার মান সমুন্নত রাখা ও বিকাশের লক্ষ্যে কাজ করে যাবে। সরকার প্রণীত আইন দ্বারা তদারকি কর্তৃপক্ষের অধিকার, দায়িত্ব এবং দায়বদ্ধতা সুনির্দিষ্ট করা। দ্বিতীয়ত, হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সেবা গ্রহীতা হিসাবে যারা আসেন, তাদের অধিকার ও দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করা। তৃতীয়ত, সেবাদাতা ও তাঁর দলের প্রতিটি সদস্যের দায়িত্ব ও অধিকার সঠিকভাবে নির্দিষ্ট করা। একইসঙ্গে, সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ও অধিকার নির্দিষ্ট করা। সর্বশেষ, স্বাস্থ্যসেবার উপকরণ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর এ জাতীয় উপযুক্ততার মানদণ্ড নির্ধারণ, তাদের দায়িত্ব ও অধিকারের জায়গাটি পরিষ্কার করতে হবে।

 

তিনি বলেন, সমন্বিত একটি স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রনয়ন করা গুরুত্বপূর্ণ একটি জনদাবি। এ আইনে যেন সবার অধিকার রক্ষা করা হয়, একইসঙ্গে অধিকার লঙ্ঘনকারী ও দায়িত্ব অবহেলাকারীকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করার সুযোগ থাকে।

জনপ্রিয় সংবাদ

সপরিবারে হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছেছেন তারেক রহমান

স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে দ্রুত আইন প্রণয়নের তাগিদ চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের

আপডেট সময় : ০৭:৪৭:৩৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৭ মে ২০২৪

➤স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে প্রায় ৪৫টি আইন জড়িত থাকলেও তার কোন সুফল মিলছে না

❖আইনটি দ্রুত পাস হলে সবার জন্যই ভালো-প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ
❖চিকিৎসা ব্যবস্থা আরো গতিশীল হবে-ডা. এমএ আজিজ, সাবেক মহাসচিব, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)
❖সমন্বিত একটি স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রনয়ন করা একটি জনদাবি- ডা. লেলিন চৌধুরী, নির্বাহী সভাপতি, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)
❖খসড়া আইনে স্বাস্থ্যসেবার দুই পক্ষকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি- অধ্যাপক ডা. ফিরোজ আহমেদ খান, সভাপতি, ডক্টরস ফর হেলথ এন্ড এনভায়রনমেন্ট
❖একটি যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করা জরুরি- এডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম

স্বাধীনতার পর থেকে ৫৩ বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। স্বাস্থ্যসেবা খাতে নানা প্রতিষ্ঠান ও পরিধি বৃদ্ধি পেলেও আইন, নীতিমালার সংস্কার ও উন্নয়ন সে অনুসারে হয়নি। আইনের দূর্বলতার কারণে মানসম্মত আর মানহীনদের চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে চিকিৎসা ব্যবস্থার মানহীনদের ভোগান্তির দায় সকলকে বহন করতে হচ্ছে। আইনের সীমাবদ্ধতা, নজরদারির অভাব, স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরস না থাকাসহ নানা কারণে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো মানুষের আস্থা হারাচ্ছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনটি প্রণয়নের কাজ দীর্ঘদিন ধরে চলমান থাকলেও এখনো তা সম্পন্ন হয়নি। খসড়া আইনটির ওপর এখনো মতামত গ্রহণ চলছে। তবে এ আইনকে দুর্বল ও বিলম্বিত করতে স্বার্থান্বেষীরা সক্রিয় রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। তাই স্বাস্থ্যখাতের সার্বিক উন্নয়নে সরকারকে সতর্কতার সাথে স্বাস্থ্য সেবার জন্য পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন করা জরুরি বলে মনে করেন চিকিৎসাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা।

 

আইনটি প্রসঙ্গে এডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, জনস্বাস্থ্য, সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সাথে প্রায় ৪৫টি আইন জড়িত। তবে হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ দি মেডিকেল প্র্যাকটিস এন্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস এন্ড ল্যাবোরাটোরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২’ আইনের আওতায় পরিচালিত হয়ে আসছিল, কিন্তু এখন এ আইনের কার্যকারিতা নেই। এছাড়া ভোক্তা অধিকার আইন, দন্ডবিধিতে কতিপয় ধারায় স্বাস্থ্য সুরক্ষার কিছু বিধান রয়েছে। এ আইনগুলোর কোনটিই পুর্ণাঙ্গ নয় এবং বর্তমানে বাংলাদেশের বিশাল স্বাস্থ্য খাত ব্যবস্থাপনার জন্য পর্যাপ্ত নয়। আর এ বাস্তবতায় স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্য সেবা গ্রহীতার সুরক্ষা প্রদান এবং প্রতিষ্ঠানসমূহের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করবার লক্ষ্যে একটি যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করা জরুরি।

 

আইনটি প্রসঙ্গে আরো বলা হয়, প্রস্তাবিত আইনের শুরুতে ‘অপরাধী’ সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যা নেতিবাচক ধারণার জন্ম দেয়। আইনের খসড়ায় ‘অবহেলা’ সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মেডিক্যাল নেগলিজ্যান্স বা চিকিৎসা অবহেলার বিষয়গুলো এ সংজ্ঞায় যুক্ত করা হয়নি। বরং, অবহেলা চিহ্নিত করতে হাসপাতাল বা চিকিৎসা সহায়তা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব, চিকিৎসক, নার্স, চিকিৎসা সহায়তাকারী, উপকরণ সরবরাহকারী, রোগী, রোগীর এটেনডেন্টদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সুনির্দিষ্ট করা উচিত। অন্যথায় চিকিৎসা অবহেলার দায় শুধু চিকিৎসদের উপর বর্তাবে। পাবলিক হাসপাতাল, দাতব্য হাসপাতালের মতো গুরুত্বপুর্ণ প্রতিষ্ঠানকে আলাদা করে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। এতে পাবলিক হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা আইনি চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়তে পারে। এছাড়া, টেলিমেডিসিন, ন্যানো টেকনোলজি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডিজিটাল, ডাটা সংরক্ষণ -ইত্যাদি বিষয়গুলো আইনে যুক্ত করা হয়নি।

 

আইনটি প্রসঙ্গে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)’র সাবেক মহাসচিব ডা. এমএ আজিজ বলেন, এই আইনটা হলে খুব ভালো হয়। এটি হলে চিকিৎসক, রোগী, হাসপাতালের মালিক সবার উপকার হবে। যখন আইনটা নিয়ে কথা শুরু হয় তখন আমরা অনেক সেমিনার সিম্পোজিয়াম করেছি জেলা উপজেলার মানুষদের সঙ্গে। বিভিন্ন অনলাইনে দেওয়া হয়েছে। সবার মতামত নেয়া হয়েছে। তিনটি গ্রুপের স্বার্থ ছিল। চিকিৎসকরা যদি মনে করে, রোগীরা যদি মনে করে এবং প্রতিষ্ঠানের মালিক যদি মনে করে একই আইনের আশ্রয় নিতে পারবে। এটা একটা ভালো আইন। এটা যদি তাড়াতাড়ি পাস হয় তাহলে চিকিৎসকদের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি কমে যাবে। রোগীরাও সুন্দর সেবা পাবে এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা আরো গতিশীল হবে। চিকিৎসকদের জন্য ভালো হবে। বিভিন্ন জায়গার অপ্রীতিকর ঘটনাও কমে যাবে এবং রোগীর স্বজনরাও চাইলে আইনের আশ্রয় নিতে পারবে। কোন অদৃশ্য কারণে এই আইনটা হচ্ছে না আমরা জানি না।

 

তিনি বলেন, কিন্তু ডাক্তার সমাজ আমরা চাই দ্রুত আইনটা সংসদে পাস হোক। এটা শুধু চিকিৎসক সমাজের জন্য না রোগীদের জন্যও এটা উপহার হবে। এতে রোগী স্বার্থ সংরক্ষিত থাকবে। প্রতিষ্ঠানের মালিক সরকারি বেসরকারি যেই হোক তাদেরও স্বার্থ সুরক্ষা থাকবে এই আইনে। সুতরাং আমরা চাই যে, এই আইনটা দ্রুত পাস হোক। তিনি বলেন, ধরেন কোথাও ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হলে সঙ্গে সঙ্গে ফৌজদারি মামলায় চিকিৎসককে এরেস্ট করে। পরে দেখা গেল এটা প্রমাণিত হয়নি। এই যে ভীতিকর অবস্থায় থাকে চিকিৎসকরা। আমরা চাচ্ছিলাম এই সমস্ত কেসে যে অভিযোগ আসে সেটার তদন্ত হোক। এরেস্ট না করে স্পেসিফিক যে গাইডলাইন আছে তাদের অভিযোগ তদন্ত করা। তদন্তে যদি শাস্তির বিষয় আসে তখন সেটা দেয়া হবে। আইনের বিধানে যা শাস্তি হবে তা হোক আমাদের আপত্তি নেই কিন্তু একটা নিউজ হলেই ভুল চিকিৎসার অভিযোগে চিকিৎসককে এরেস্ট করলে এই জায়গাটা আমাদের চিকিৎসকদের জন্য কমফোর্টেবল না। এটার কারণে চিকিৎসকরাও জরুরি রোগীর চিকিৎসা দিতে অস্বস্তিতে ভোগে। এটা আল্টিমেটলি রোগীর জন্য, মানুষের জন্য ভালো হবে না।

 

আইনটি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, আইনটির বৈঠকে আমার সেভাবে থাকা হয়নি তাই এতে ঠিক কি কি আছে আমি সেভাবে এখন আর বলতে পারছিনা। তবে, আইনটি দ্রুত পাস হলে সবার জন্যই ভালো হবে। ভালোর জন্যই আইনটি করা হচ্ছে।

 

বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, চিকিৎসার ব্যর্থতার দায় নেয়ার পাশাপাশি আগামী দিনে সকল নাগরিকের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। আইনের উদ্দেশ্য শুধু এ খাতের মানুষকে সাজা প্রদান নয়, বরং স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত সকলকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সঠিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে।

 

ডক্টরস ফর হেলথ এন্ড এনভায়রনমেন্ট এর সভাপতি অধ্যাপক ডা. ফিরোজ আহমেদ খান বলেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা বলতে চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ও গ্রহণকারী দুটো পক্ষকে বুঝাবে। কিন্তু খসড়া আইনে উভয় পক্ষকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। বর্তমানে চিকিৎসকদের কর্মক্ষেত্র সুরক্ষিত নয়। অবহেলাজনিত কারণে ক্রিমিনাল কেস দাখিল করা হচ্ছে এবং অবহেলা বা অপরাধ প্রমাণের আগেই চিকিৎসকদের হাতকড়া পরানো হচ্ছে। পৃথিবীর কোন দেশে অবহেলা ক্রিমিনাল কেস হিসাবে গণ্য হয় না।

 

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)’র নির্বাহী সভাপতি ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্যসেবার সাথে চারটি পক্ষ যুক্ত। প্রথমে সরকার, সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও আইন প্রণয়ন করা। সে আইনের অধীনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্যসেবার মান সমুন্নত রাখা ও বিকাশের লক্ষ্যে কাজ করে যাবে। সরকার প্রণীত আইন দ্বারা তদারকি কর্তৃপক্ষের অধিকার, দায়িত্ব এবং দায়বদ্ধতা সুনির্দিষ্ট করা। দ্বিতীয়ত, হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সেবা গ্রহীতা হিসাবে যারা আসেন, তাদের অধিকার ও দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করা। তৃতীয়ত, সেবাদাতা ও তাঁর দলের প্রতিটি সদস্যের দায়িত্ব ও অধিকার সঠিকভাবে নির্দিষ্ট করা। একইসঙ্গে, সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ও অধিকার নির্দিষ্ট করা। সর্বশেষ, স্বাস্থ্যসেবার উপকরণ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর এ জাতীয় উপযুক্ততার মানদণ্ড নির্ধারণ, তাদের দায়িত্ব ও অধিকারের জায়গাটি পরিষ্কার করতে হবে।

 

তিনি বলেন, সমন্বিত একটি স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রনয়ন করা গুরুত্বপূর্ণ একটি জনদাবি। এ আইনে যেন সবার অধিকার রক্ষা করা হয়, একইসঙ্গে অধিকার লঙ্ঘনকারী ও দায়িত্ব অবহেলাকারীকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করার সুযোগ থাকে।