◆ আয় ৭৯৬৯০০ কোটি
◆ ব্যয় ৫৪০০০০ কোটি
◆ ঘাটতি ২৫৬৯০০ কোটি
◉ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই বাজেটে চ্যালেঞ্জ
◉ ঘাটতির এক-তৃতীয়াংশই দেশি-বিদেশি ঋণ
◉ শুধু বিদেশি ঋণ থাকছে ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা
◉ জিডিপি কমিয়েও ঘাটতির পরিমাণ বাড়ছে
➤ একসঙ্গে সবদিকে নজর দেওয়া সম্ভব নয়। তাই অগ্রাধিকারমূলক বাজেট তৈরি করতে হবে- ড. জাহিদ হোসেন, সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক, ঢাকা কার্যালয়
➤ বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য থাকলেও ব্যাংকঋণে ফের মূল্যস্ফীতি বাড়বে- ড. মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মানীয় ফেলো, সিডিপি
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলেও সংকটে দেশের অর্থনীতি। রাজস্ব ঘটতি, চওড়া মূল্যস্ফীতি ও রিজার্ভ ঘাটতিতে দেশের অর্থ খাতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। কমেছে সরকারের আয়। তাই ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সরকারে সংকোচন এমন নীতির মধ্যেই থাকছে দুই লাখ ৫৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকার ঘাটতি বাজেট। আগামী বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ঋণের বাজেট প্রস্তাব পেশ করবেন আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এবারের বাজেটের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে অঙ্গীকার। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাই হবে আগামী বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ। তাদের মতে, নতুন বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে মূল লক্ষ্য না করে সংকট মোকাবিলায় বেশি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবারের বাজেটে তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জ থাকবে। প্রথমত, করহার না বাড়িয়ে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির প্রবণতা ধরে রাখা। দ্বিতীয়ত, রাজস্ব ব্যয় সংকোচন করে উন্নয়নমুখী বিনিয়োগের সক্ষমতা বাড়ানো। তৃতীয়ত, বেসরকারি বিনিয়োগের ওপর চাপ না ফেলে বাজেটের ঘাটতি অর্থায়ন করা। বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট হবে ‘ব্যয় সংকোচনমূলক ও সতর্ক’ (টাইটেন অ্যান্ড কসাস)। এবার সম্প্রসারণমূলক বাজেটের দিকে যাচ্ছে না সরকার। এই প্রথমবারের মতো বাজেটের আকার আগের বছরের চেয়ে তুলনামূলক ছোট প্রাক্কলন করা হচ্ছে। প্রধানত মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় এই নীতি কৌশল নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিল- আইএমএফের প্রভাবও থাকবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে। বাজেটের আকার ছোট রাখা, ঘাটতি কমিয়ে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো, কর ছাড় প্রত্যাহার, ভর্তুকি কমানো, দরিদ্রদের ভাতা বাড়ানোসহ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী খাতে অনিয়ম রোধ, উপকারভোগী সঠিকভাবে নির্বাচন করার পাশাপাশি এ বিষয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের তাগিদ রয়েছে আইএমএফের। এসব বিষয় মাথায় রেখেই খসড়া বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। এদিকে সরকারের ব্যয় সংকোচন ও কৃচ্ছ্র নীতিতেও বাজেটের ব্যয় মেটাতে সরকারের ঋণনির্ভরতা আরও বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের মতো আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের জন্যও সরকার বিপুল পরিমাণ ঋণ করতে যাচ্ছে। আগামী বাজেট হতে পারে প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার। এর এক-তৃতীয়াংশ অর্থই আসবে দেশি-বিদেশি ঋণ হিসেবে। ঋণের পরিমাণ হতে পারে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো।
বাজেট তৈরির সময় সরকার ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা প্রায় প্রতি অর্থবছরেই মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশের কিছুটা বেশি রাখে। এবারই এ লক্ষ্যমাত্রা ৫ শতাংশের নিচে রাখা হচ্ছে। তারপরও ঘাটতির পরিমাণ বাড়ছে, যা মেটাতেই বিপুল ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করছে সরকার। ঋণের বেশির ভাগ অর্থই আসবে আবার দেশের ব্যাংকব্যবস্থা থেকে। বাজেট প্রণয়নের মূল দায়িত্বে থাকা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছরে মোট ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে নিট বিদেশি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি এবং দেশি বা অভ্যন্তরীণ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। বিদেশি ঋণের উৎস হচ্ছে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দেশ।
আগামী অর্থবছরে মোট ঋণের মধ্যে নিট বিদেশি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকার মতো। বাকি ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা হতে পারে দেশি ঋণ। দেশি ঋণের মধ্যে ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে। বাকি ২০ হাজার কোটি টাকা নেওয়া হবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও অন্যান্য উৎস থেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ এবং ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদেশি ঋণের স্থিতি প্রকাশ করেছে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ঋণের স্থিতি ছিল ৮ লাখ ৪৩ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকা। আর ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদেশি ঋণের স্থিতি ৭ হাজার ৯৭৯ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার। প্রতি ডলারকে ১১৭ টাকা ধরে হিসাব করলে তা ৯ লাখ ৩২ হাজার ৪০৮ কোটি টাকায় দাঁড়ায়।
ঋণের বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, দুই কারণে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের বেশি ঋণ নেওয়া খারাপ। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে যায়। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতি বাড়ে, যে চাপ শেষ পর্যন্ত বহন করতে হয় ভোক্তা অর্থাৎ জনগণকে। ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশ সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে মিটিয়ে থাকে। অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী টাকা ছাপালে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায়, যার পরিণতিতেই ঘটে মূল্যস্ফীতি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার গত এপ্রিলে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশে। ফলে টানা ১৪ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, মূল্যস্ফীতি যত বেশিই থাকুক না কেন, সরকারের হাতে আপাতত ব্যাংকঋণের কোনো বিকল্প নেই।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ বেশি নিলে বেসরকারি খাতকে ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে যায়, আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতি বাড়ে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নেওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন টাকা ছাপানো থেকে কিছুটা সরে এলেও ঋণের টাকার যথাযথ ও সাশ্রয়ী ব্যবহার হচ্ছে কি না এবং বেসরকারি খাত প্রণোদিত হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে আগামী অর্থবছরে সতর্ক থাকতে হবে। তা না হলে কর্মসংস্থান কমবে ও মূল্যস্ফীতি বাড়বে, যা জনগণের জন্য হবে নেতিবাচক।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দিনদিন দেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে। কিন্তু টার্গেট ঠিক আছে কি না কিংবা তা বাস্তবায়নযোগ্য কি না তা দেখা হচ্ছে না। ফলে ঠিকমতো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তিনি বলেন, বাস্তবায়নে সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য খরচের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারমূলক বাজেট তৈরি করতে হবে। যেহেতু একসঙ্গে সবদিকে নজর দেওয়া সম্ভব নয় তাই অগ্রাধিকারগুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত থাকতে হবে।


























