০২:২৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শিক্ষার উন্নয়ন অনিশ্চত

➤ টাকার অঙ্কে বাড়লেও জিডিপির তুলনায় বরাদ্দ আরও কমেছে
➤ গবেষণা ও প্রশিক্ষণসহ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি বিশেষজ্ঞদের

◉বাজেটে অনেক স্বপ্নের সঙ্গে অর্থ বরাদ্দের মিল নেই -অধ্যাপক ড. মোহা. হাছানাত আলী, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
◉শিক্ষা খাতের বাজেট প্রত্যাশার প্রতিফলন হয়নি -অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু ইউসুফ, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে স্মার্ট নাগরিক গড়তে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষায় গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এজন্য নানা উদ্যোগ ও পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষাকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষা খাতে ৯৪ হাজার ৭১০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। টাকার অঙ্কে এই বরাদ্দ চলতি ২০২৩-২৪ বাজেটের চেয়ে ৬ হাজার ৫৪৭ কোটি বেশি হলেও জিডিপির তুলনায় তা কমেছে। ইউনেস্কোর পরামর্শ হলো- একটি দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। অথচ প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপির তুলনায় ১ দশমিক ৬৯ শতাংশের কথা বলা হয়েছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ ছিল জিডিপির এক দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল দুই দশমিক ০৮ শতাংশ।

 

তাছাড়া মোট বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দের জন্য সংশ্লিষ্টদের দীর্ঘদিনের দাবি থাকলেও প্রস্তাবিত বাজেটে তা ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ-গবেষণাতেও বরাদ্দের পরিমাণ কম বলে জানা গেছে। আর এই বাজেট দিয়ে সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও শিক্ষা খাতের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন করা অনিশ্চিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এজন্য সংশোধিত বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আরও বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন তারা।

 

গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী শিক্ষা খাতের গুরুত্ব ও নানা পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত, সমৃদ্ধ, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার মূল কারিগর হবে স্মার্ট নাগরিক। তাই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন সফল করতে হলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষায় উপযুক্তভাবে গড়ে তুলতে হবে। এ প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞানভিত্তিক, প্রযুক্তিনির্ভর, দক্ষতাবর্ধক ও সৃজনশীলতা বিকাশে সহায়ক শিক্ষার পরিবেশ তৈরি এবং কর্মোপযোগী শিক্ষা ও যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণকে আমাদের এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্যতম বিশেষ অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

 

সূত্রমতে, প্রস্তাবিত আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৮ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলমান ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। এই খাতে চার হাজার ৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় ৪৪ হাজার ১০৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা চলমান অর্থবছরে ছিল ৪২ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা। এই খাতে ১ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য আগামী অর্থবছরে ১১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা চলমান অর্থবছরে ছিল ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা। এই খাতে বৃদ্ধি পেয়েছে এক হাজার ১৮১ কোটি টাকা।

 

বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, এবারের বাজেট প্রণয়ন করতে গিয়ে মূল্যস্ফীতির চাপ, সবার জন্য উপযুক্ত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য নিরাপত্তা, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ, ব্যবসায় প্রক্রিয়া সহজীকরণ, বেসরকারি উদ্যোগ উৎসাহী করার মাধ্যমে বিনিয়োগ ও শিল্পের প্রসার, জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কর্মোপযোগী শিক্ষা প্রসারের মাধ্যমে যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা, সামাজিক নিরাপত্তার ঝুঁকিতে রয়েছে, এমন জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

 

সূত্রমতে, প্রাথমিকের শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২ লাখ ৩৮ হাজার ৫৭৯ জন শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে এবং সহকারী শিক্ষকের ২৬ হাজার ৩৬৬টি নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৫টি কোর ও ৩টি নন-কোর বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ইংরেজি ও গণিতসহ অন্যান্য বিষয়ে পাঁচ লাখ ৩৭ হাজার জন শিক্ষককে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য হইল চেয়ার, ক্র্যাচ, শ্রবণযন্ত্র ইত্যাদি ক্রয় ও বিতরণ করা হচ্ছে এবং প্রতিবন্ধকতা উত্তরণ সহায়ক উপকরণ ক্রয় ও বিতরণের জন্য প্রতিটি উপজেলায় চাহিদার ভিত্তিতে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শ্রেণিকক্ষে প্রবেশের সুবিধার্থে প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে র‌্যাম্প নির্মাণ করা হচ্ছে। শিশুদের শিক্ষার প্রাথমিক ধাপেই প্রযুক্তি ব্যবহারের সঙ্গে অভ্যস্ত করে তুলতে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাদানের ওপর অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে। বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক লাখের অধিক ল্যাপটপ, মালটিমিডিয়া প্রজেক্টর, ইন্টারনেটসহ সাউন্ড-সিস্টেম সরবরাহ করে মালটিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু করা হয়েছে।

 

প্রস্তাবিত শিক্ষা বাজেট প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু ইউসুফ বলেন, শিক্ষা খাতে যে বাজেট বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, তা গতানুগতিক। একই বৃত্তে ঘুরছে শিক্ষার বাজেট। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা-৪ পূরণ অর্থাৎ গুণগত শিক্ষার, দক্ষতা উন্নয়নের জন্য এই বাজেট যথেষ্ট নয়। টাকার অঙ্কে হয়তো বরাদ্দ কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দের দাবি থাকলেও সেটি পূরণ হয়নি। আবার উন্নয়ন ব্যয়ের বেশির ভাগই ব্যয় হয় অবকাঠামোতে। আর পরিচালন ব্যয়ের বেশির ভাগ খরচ হয় বেতন-ভাতা বাবদ। সব মিলিয়ে এবারের শিক্ষা খাতের বাজেট প্রত্যাশার প্রতিফলন হয়নি বলে মনে করেন তিনি।

 

সূত্রমতে, আগামী অর্থ বছরে ৫৬টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় ২শ কোটি টাকার মত বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এই বরাদ্দকে একেবারেই কম বলছেন গবেষকরা। এই টাকা দিয়ে ভালো কোনো গবেষণা করা সম্ভব না। ইউজিসি অবশ্য বলছে, এই অর্থের পুরো ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের যে বাজেট উপস্থাপন করেন। সেখানে ৫৬ টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য রাজস্ব বাজেট ৫ হাজার ৬ শত কোটি টাকা, উন্নয়ন বাজেট ৫ হাজার কোটি, গবেষণায় বরাদ্দ মাত্র ২০০ কোটি টাকা। একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে মাত্র সাড়ে ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে।

 

প্রস্তাবিত বাজেট প্রসঙ্গে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের আইবিএ অধ্যাপক ড. মোহা. হাছানাত আলী সবুজ বাংলাকে বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তার বেশিরভাগই বিশ^বিদ্যালয় ািশক্ষকদের বেতন, ভবন নিমার্ণ কাজে ব্যয় হবে। গ্রামীণ জনপদের শিক্ষার আধুনিকায়নের মতো কোনো নির্দেশনা এখানে নেই। অর্থমন্ত্রী তার বক্তব্যে অনেক স্বপ্নের কথা বললেও অর্থ বরাদ্দের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। তিনি বলেন, প্রাথমিকে ডিজিটাল ক্লাস রুম করার কথা বলা হলেও বিদ্যুতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। এতে ডিজিটাল ক্লাসরুম করা কীভাবে সম্ভব। তাছাড়া ডিজিটাল ল্যাব পরিচালনার যে দক্ষ শিক্ষক প্রয়োজন তার সক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য বরাদ্দ নেই। বিশেষ করে স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও আমাদের শিক্ষা পদ্ধতিই ঠিক হয়নি। সব মিলিয়ে শিক্ষার উন্নয়নে তেমন কোনো উদ্যোগ বাজেটে দেখা যাচ্ছে না।

জনপ্রিয় সংবাদ

সপরিবারে হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছেছেন তারেক রহমান

শিক্ষার উন্নয়ন অনিশ্চত

আপডেট সময় : ০৭:১৫:৩১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৯ জুন ২০২৪

➤ টাকার অঙ্কে বাড়লেও জিডিপির তুলনায় বরাদ্দ আরও কমেছে
➤ গবেষণা ও প্রশিক্ষণসহ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি বিশেষজ্ঞদের

◉বাজেটে অনেক স্বপ্নের সঙ্গে অর্থ বরাদ্দের মিল নেই -অধ্যাপক ড. মোহা. হাছানাত আলী, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
◉শিক্ষা খাতের বাজেট প্রত্যাশার প্রতিফলন হয়নি -অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু ইউসুফ, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে স্মার্ট নাগরিক গড়তে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষায় গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এজন্য নানা উদ্যোগ ও পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষাকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষা খাতে ৯৪ হাজার ৭১০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। টাকার অঙ্কে এই বরাদ্দ চলতি ২০২৩-২৪ বাজেটের চেয়ে ৬ হাজার ৫৪৭ কোটি বেশি হলেও জিডিপির তুলনায় তা কমেছে। ইউনেস্কোর পরামর্শ হলো- একটি দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। অথচ প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপির তুলনায় ১ দশমিক ৬৯ শতাংশের কথা বলা হয়েছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ ছিল জিডিপির এক দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল দুই দশমিক ০৮ শতাংশ।

 

তাছাড়া মোট বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দের জন্য সংশ্লিষ্টদের দীর্ঘদিনের দাবি থাকলেও প্রস্তাবিত বাজেটে তা ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ-গবেষণাতেও বরাদ্দের পরিমাণ কম বলে জানা গেছে। আর এই বাজেট দিয়ে সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও শিক্ষা খাতের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন করা অনিশ্চিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এজন্য সংশোধিত বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আরও বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন তারা।

 

গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী শিক্ষা খাতের গুরুত্ব ও নানা পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত, সমৃদ্ধ, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার মূল কারিগর হবে স্মার্ট নাগরিক। তাই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন সফল করতে হলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষায় উপযুক্তভাবে গড়ে তুলতে হবে। এ প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞানভিত্তিক, প্রযুক্তিনির্ভর, দক্ষতাবর্ধক ও সৃজনশীলতা বিকাশে সহায়ক শিক্ষার পরিবেশ তৈরি এবং কর্মোপযোগী শিক্ষা ও যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণকে আমাদের এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্যতম বিশেষ অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

 

সূত্রমতে, প্রস্তাবিত আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৮ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলমান ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। এই খাতে চার হাজার ৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় ৪৪ হাজার ১০৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা চলমান অর্থবছরে ছিল ৪২ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা। এই খাতে ১ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য আগামী অর্থবছরে ১১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা চলমান অর্থবছরে ছিল ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা। এই খাতে বৃদ্ধি পেয়েছে এক হাজার ১৮১ কোটি টাকা।

 

বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, এবারের বাজেট প্রণয়ন করতে গিয়ে মূল্যস্ফীতির চাপ, সবার জন্য উপযুক্ত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য নিরাপত্তা, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ, ব্যবসায় প্রক্রিয়া সহজীকরণ, বেসরকারি উদ্যোগ উৎসাহী করার মাধ্যমে বিনিয়োগ ও শিল্পের প্রসার, জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কর্মোপযোগী শিক্ষা প্রসারের মাধ্যমে যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা, সামাজিক নিরাপত্তার ঝুঁকিতে রয়েছে, এমন জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

 

সূত্রমতে, প্রাথমিকের শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২ লাখ ৩৮ হাজার ৫৭৯ জন শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে এবং সহকারী শিক্ষকের ২৬ হাজার ৩৬৬টি নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৫টি কোর ও ৩টি নন-কোর বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ইংরেজি ও গণিতসহ অন্যান্য বিষয়ে পাঁচ লাখ ৩৭ হাজার জন শিক্ষককে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য হইল চেয়ার, ক্র্যাচ, শ্রবণযন্ত্র ইত্যাদি ক্রয় ও বিতরণ করা হচ্ছে এবং প্রতিবন্ধকতা উত্তরণ সহায়ক উপকরণ ক্রয় ও বিতরণের জন্য প্রতিটি উপজেলায় চাহিদার ভিত্তিতে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শ্রেণিকক্ষে প্রবেশের সুবিধার্থে প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে র‌্যাম্প নির্মাণ করা হচ্ছে। শিশুদের শিক্ষার প্রাথমিক ধাপেই প্রযুক্তি ব্যবহারের সঙ্গে অভ্যস্ত করে তুলতে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাদানের ওপর অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে। বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক লাখের অধিক ল্যাপটপ, মালটিমিডিয়া প্রজেক্টর, ইন্টারনেটসহ সাউন্ড-সিস্টেম সরবরাহ করে মালটিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু করা হয়েছে।

 

প্রস্তাবিত শিক্ষা বাজেট প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু ইউসুফ বলেন, শিক্ষা খাতে যে বাজেট বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, তা গতানুগতিক। একই বৃত্তে ঘুরছে শিক্ষার বাজেট। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা-৪ পূরণ অর্থাৎ গুণগত শিক্ষার, দক্ষতা উন্নয়নের জন্য এই বাজেট যথেষ্ট নয়। টাকার অঙ্কে হয়তো বরাদ্দ কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দের দাবি থাকলেও সেটি পূরণ হয়নি। আবার উন্নয়ন ব্যয়ের বেশির ভাগই ব্যয় হয় অবকাঠামোতে। আর পরিচালন ব্যয়ের বেশির ভাগ খরচ হয় বেতন-ভাতা বাবদ। সব মিলিয়ে এবারের শিক্ষা খাতের বাজেট প্রত্যাশার প্রতিফলন হয়নি বলে মনে করেন তিনি।

 

সূত্রমতে, আগামী অর্থ বছরে ৫৬টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় ২শ কোটি টাকার মত বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এই বরাদ্দকে একেবারেই কম বলছেন গবেষকরা। এই টাকা দিয়ে ভালো কোনো গবেষণা করা সম্ভব না। ইউজিসি অবশ্য বলছে, এই অর্থের পুরো ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের যে বাজেট উপস্থাপন করেন। সেখানে ৫৬ টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য রাজস্ব বাজেট ৫ হাজার ৬ শত কোটি টাকা, উন্নয়ন বাজেট ৫ হাজার কোটি, গবেষণায় বরাদ্দ মাত্র ২০০ কোটি টাকা। একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে মাত্র সাড়ে ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে।

 

প্রস্তাবিত বাজেট প্রসঙ্গে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের আইবিএ অধ্যাপক ড. মোহা. হাছানাত আলী সবুজ বাংলাকে বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তার বেশিরভাগই বিশ^বিদ্যালয় ািশক্ষকদের বেতন, ভবন নিমার্ণ কাজে ব্যয় হবে। গ্রামীণ জনপদের শিক্ষার আধুনিকায়নের মতো কোনো নির্দেশনা এখানে নেই। অর্থমন্ত্রী তার বক্তব্যে অনেক স্বপ্নের কথা বললেও অর্থ বরাদ্দের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। তিনি বলেন, প্রাথমিকে ডিজিটাল ক্লাস রুম করার কথা বলা হলেও বিদ্যুতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। এতে ডিজিটাল ক্লাসরুম করা কীভাবে সম্ভব। তাছাড়া ডিজিটাল ল্যাব পরিচালনার যে দক্ষ শিক্ষক প্রয়োজন তার সক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য বরাদ্দ নেই। বিশেষ করে স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও আমাদের শিক্ষা পদ্ধতিই ঠিক হয়নি। সব মিলিয়ে শিক্ষার উন্নয়নে তেমন কোনো উদ্যোগ বাজেটে দেখা যাচ্ছে না।