০৬:৩৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দেশজুড়ে ভুয়া এনজিও’র শক্তিশালী সিন্ডিকেট

 

◉ চটকদার বিজ্ঞাপনে লোভনীয় বেতনে চাকরির নামে প্রতারণার ফাঁদ
◉ কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে অফিসে ঝুলানো হচ্ছে তালা
◉ দেশে দেশি-বিদেশি এনজিও ব্যুরোর সংখ্যা ২৬২৩টি
◉ সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধিত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ৭০০৯৯টি
◉ সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধিত সমিতির সংখ্যা ১৮৮৮৮৬টি
◉ অর্থ লেনদেনে গ্রাহক এবং চাকরি প্রত্যাশীদের দায়িত্বশীল ও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞের

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে সমাজসেবামূলক কাজে ও ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়ার প্রকল্পের নামে ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে উঠেছে হাজার হাজার এনজিও সংস্থা এবং বেসরকারি সমবায় সমিতি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ঢাকা ও বিভাগীয় শহরগুলোর নজরকাড়া স্থানগুলো টার্গেট করে লোভনীয় বেতন-ভাতা ও পদ-পদবীর প্রস্তাব দিয়ে সাঁটানো হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। সোস্যাল মিডিয়া, গণপরিবহন এমনকি ব্যস্ত নগরীর বিভিন্ন দেওয়ালেও স্টীকারযুক্ত নিয়োগ বিজ্ঞাপন সাঁটিয়ে হতদরিদ্র শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা চালাচ্ছে সংঘবদ্ধ একটি প্রতারকচক্র। ইতোমধ্যেই তারা দেশজুড়ে ভুয়া এনজিও ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার নামে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। চক্রটি নানান কৌশলে চাকরি প্রত্যাশী বেকার তরুণ-তরুণীদের চাকরি ও ক্ষৃদ্র ঋণ দেওয়ার নামে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে প্রতিনিয়ত হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। চাকরি প্রত্যাশী বা ঋণ গ্রহীতারা বিষয়টি টের পাওয়ার আগেই বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়ে অফিসে তালা ঝুলিয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে প্রতারকরা। এতে প্রতিনিয়তই নিঃস্ব হচ্ছে হাজারো দরিদ্র জনগোষ্ঠী। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এনজিও ব্যুরোর তথ্য বলছে, সারা দেশে ২৬২৩টি দেশি-বিদেশি এনজিওকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিধি ভঙে ৭৩৮টি এনজিও’র কার্যক্রম বাতিল করা হয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশের ৬৪ জেলায় এ পর্যন্ত ৭০০৯৯টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। গঠণতন্ত্র প্রতিপালন না করায় ১১৫৩৪টি সংস্থার কার্যক্রম বিলুপ্ত করা হয়েছে। তবে বর্তমানে ৫৮৪৬৫টি সংস্থা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। অপরদিকে সমবায় অধিদপ্তরের তথ্য বলছে সারা দেশে ১৮৮৮৮৬টি সমবায় সমিতি নিবন্ধিত রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতারকরা সবসময়ই নানান কৌশলে প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করেন। ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহণ, সঞ্চয় বা চাকরির জন্য প্রত্যাশীদের অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে অবশ্যই আরো বেশি সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে। একই সঙ্গে এনজিও বা কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম সম্পর্কে আগেই খোঁজ-খবর নিতে হবে। অনিবন্ধিত ভুয়া এনজিও এবং কোম্পানিগুলোর সার্বিক কার্যক্রম তদারকির দায় সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরসমূহের।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ভুয়া এনজিও এবং চাকরি দেওয়ার নামে যত্রতত্র খুলে বসা কোম্পানিগুলোর নামে অভিযোগ পেলেই অভিযান চালানো হচ্ছে। অনেককেই আইনের আওতায় এনে আদালতে সোপর্দ করা হয়। কিন্তু আইনের ফাঁক গলিয়ে তারা বের হয়ে স্থান পরিবর্তন করে অন্য নামে একই পেশায় যুক্ত হচ্ছে। গত কয়েকদিন ভুক্তভোগীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার অনুমতিপ্রাপ্ত উল্লেখপূর্বক শহর-গ্রাম ও ব্যস্ততম নগরীর গুরুত্বপর্ণ পয়েন্টে এমনটি গণপরিবহন, গণমাধ্যমে লোভনীয় বেতন-ভাতা ও পদ-পদবী উল্লেখ্য করে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। ওইসব বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, প্রোগ্রাম অফিসার, এরিয়া ম্যানেজার, নিরাপত্তাকর্মী, কলসেন্টার কর্মী, বিপণন কর্মকর্তাসহ নানা পদে চাকরির সুযোগ রয়েছে। ওই বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে আগ্রহীরা যোগাযোগ করলে প্রথমে তাদের জীবনবৃত্তান্ত জমা নেওয়া হয়। এরপর ফোন করে বলা হয়, আপনি চাকরির জন্য মনোনীত হয়েছেন। পরের ধাপ নিবন্ধন, প্রশিক্ষণসহ নানা অজুহাত দেখিয়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। সেইসঙ্গে সপ্তাহব্যাপী প্রশিক্ষণে তাদের শেখানো হয় কীভাবে নতুন চাকরিপ্রত্যাশীদের ফাঁদে ফেলে টাকা হাতিয়ে নিতে হবে। আর সেই টাকার একটি অংশ তারাও বেতন হিসেবে পাবেন। দীর্ঘদিন ধরে চাকরি দেওয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নেওয়া চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে এসেছে প্রতারণার এমন কাহিনি। পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, ঢাকার অফিস ছাড়াও দেশের ৬৪ জেলায় রয়েছে তাদের মার্কেটিং অফিসার। তারা প্রতিদিন নতুন চাকরিপ্রার্থীদের ফাঁদে ফেলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে মাঝেমধ্যে চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়। তবে জামিনে বেরিয়ে তারা নিজেদের ও প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে আবারও একই ধরনের কর্মকাণ্ড শুরু করে। এ পর্যন্ত ৭০০ জনের বেশি প্রার্থী ফাঁদে পড়ে প্রতারিত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

ডিএমপি’র ডেমরা অঞ্চলের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মধুসূদন দাস বলেন, ফেসবুকে চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে এক তরুণী তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাকে জানানো হয়, কলসেন্টারে চাকরি দেওয়া হবে, বেতন ১৮ হাজার ৫০০ টাকা। তবে এজন্য মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হবে। সরল বিশ্বাসে তিনি সেই টাকা দিয়ে দেন, তবে চাকরি পাননি। বরং টাকা ফেরত চাইলে তাকে হুমকি ধমকি দেওয়া হয়। ভুক্তভোগী এ ঘটনায় ডেমরা থানায় মামলা করেন। এর ভিত্তিতে অতি সম্প্রতি প্রতারক চক্রের ৬ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরা হলেন- ড্রিম লাইফ লজিস্টিক সার্ভিস কোম্পানির মালিক সজীব হোসেন, মালিক ও উপপরিচালক ফজলে রাব্বি, প্রশিক্ষক তামান্না ইসলাম, রিসিপশনিস্ট স্বপ্না খাতুন, মার্কেটিং অফিসার মোতাসিম বিল্লাহ ও নাজিম উদ্দিন নয়ন। প্রতিষ্ঠানের আরেক মালিক ও চেয়ারম্যান মারুফ হাওলাদার ওরফে মিজানুর রহমান ওরফে বাবু এখনও পলাতক।

মামলার বাদী লাবনী বেগম জানান, তিনি ফেসবুকে ড্রিম লাইফ লজিস্টিক নামক প্রতিষ্ঠানে চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে লাইক কমেন্ট করেন। এরপর প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাঁকে চাকরির জন্য মনোনীত করা হয়েছে জানিয়ে খরচ বাবদ ৪০ হাজার টাকা চায়। তিনি তা দিয়ে দেন। এরপর চাকরির নিবন্ধনের জন্য খিলগাঁওয়ের প্রভাতীবাগে প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে ডাকা হয়। সেখানে আরও ১০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। তবে টাকা নেওয়ার পর তারা যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।

এদিকে সম্প্রতি দেশের আত্মনির্ভরশীল ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বেসরকারি বৃহৎ এনজিও সংস্থা আশা’তে কর্মী নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়, সংস্থাটি ট্রেইনি হিসাবরক্ষক পদে ৫৪৭ জন এবং ফিল্ড অফিসার পদে ৭৩৩ জন নিয়োগ দিবে। বিষয়টি নজরে আসে সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের। পরে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বেসরকারি সংস্থা আশা ট্রেইনি হিসাবরক্ষক এবং ফিল্ড অফিসার পদে নিয়োগের জন্য সম্প্রতি এমন কোনো বিজ্ঞপ্তি দেয়নি বরং এনজিওটির নাম ও লোগো ব্যবহার করে প্রচারিত এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটিকে সংস্থাটির পক্ষ থেকে ভুয়া বলে নিশ্চিত করা হয়েছে।

এদিকে বাগেরহাটের রামপালে সমাজ উন্নয়ন সংস্থা (এসইউএস) নামের একটি ভুয়া এনজিওর ফাঁদে পড়ে প্রায় দুই শতাধিক গ্রাহক সর্বস্বান্ত হয়েছেন। ভুক্তভোগীরা গত ২৩ জানুয়ারি রামপাল থানায় পৃথক দুটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
ভুক্তভোগী অনেকেই জানান, ঢাকার পল্টন, ফকিরেরপুল, মতিঝিল, কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ, হাজারীবাগ, কমলাপুর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, শান্তিনগর, মিরপুর, পল্লবী, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, উত্তরা ও সাভার ধামরাই এলাকায় কয়েকশ’ ভুয়া এনজিও সংস্থা সক্রিয় রয়েছে। তারা বিভিন্ন প্রকল্পে চাকরি দেওয়ার নামে দেশের হতদরিদ্র শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীদের টার্গেট করে প্রতিনিয়তই কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে ভাড়া করা অফিসের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি টের পাওয়ার পর ভুক্তভোগীদের অনেকেই থানায় আদালতে অভিযোগ করছেন। এরপর আদালত থেকে একেক জনের নামে এক থেকে ছয় লাখ টাকার চেক প্রতারণা মামলার কাগজ এলে জানতে পারেন তারা প্রতারণার শিকার হয়েছে।

র‌্যাব জানায়, রাজধানী ঢাকায় নয়, সারা দেশেই এসব প্রতারকচক্র ফাঁদ পেতে আছে। উত্তরণ ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি নামে একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় ২-৩ মাসের জন্য অফিস ভাড়া নেয়। এরপর তারা পত্রিকায় কর্মী নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেয়। কর্মী নিয়োগ করে গ্রাহক সংগ্রহ করার জন্য নিয়োগকৃত কর্মীদের তাদের নিজ বাড়ি এলাকায় পাঠিয়ে দেয়। প্রতারক চক্র প্রতারণার উদ্দেশ্যে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ দেওয়ার নামে ১০ শতাংশ হারে সিকিউরিটি হিসেবে গ্রাহকদের কাছ থেকে নিয়োগ করা কর্মীদের মাধ্যমে অর্থ আদায় করে। প্রতারণার কৌশল হিসেবে প্রথমে তারা সদস্য সংগ্রহ করে থাকে। এই প্রতারক চক্রের মাঠ পর্যায়ের কর্মী/সদস্যদের মাধ্যমে বিভিন্ন বস্তি এলাকার প্রতিবন্ধী, ভিক্ষুক, সেলুনের কর্মচারী, মনোহারী ও ফুটপাতের দোকানদার, গৃহকর্মী ও নিম্নআয়ের মানুষকে টার্গেট করে। ঋণের লোভ দেখিয়ে সঞ্চয়ের নামে তাদের কোম্পানিতে বিনিয়োগ/ডিপিএস করতে উদ্বুদ্ধ করে। তার পর সঞ্চয় সংগ্রহ করে অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রমে জড়িয়ে ফেলে। সাধারণ অশিক্ষিত মানুষ না বুঝে এসব প্রতারণার ফাঁদে পা দেয়। স্বল্প সময়ে ঋণ দেওয়ার প্রলোভন এমন কি ফ্ল্যাট/জমি দেওয়ার আশ্বাসও দিয়ে থাকে তারা। অনুমোদন ছাড়া সারা দেশে এ রকম অসংখ্য সমিতি ও মাইক্রোক্রেডিট প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এদের যথাযথ মনিটরিং না করায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করার তো কোনও অধিকার নেই তাদের। এ জন্য রেগুলেটরি বডি রয়েছে। তাদের উচিত এদের এখনই প্রতিরোধ করা।

সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, শিশু কল্যাণ, যুব কল্যাণ, নারী কল্যাণ, শারীরিক ও মানসিকভাবে অসমর্থ ব্যক্তিদের কল্যাণ, পরিবার পরিকল্পনা, সমাজবিরোধী কার্যকলাপ হতে জনগণকে বিরত রাখা, সামাজিক শিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষা, কারামুক্ত কয়েদীদের কল্যাণ ও পুনর্বাসন, কিশোর অপরাধীদের কল্যাণ, ভিক্ষুক ও দুস্থদের কল্যাণ, দরিদ্র রোগীদের কল্যাণ ও পুনর্বাসন, বৃদ্ধ ও দৈহিকভাবে অসমর্থ ব্যক্তিদের কল্যাণ, সমাজকল্যাণকার্যে প্রশিক্ষণ এবং সমাজকল্যাণ সংস্থাসমূহের সমন্বয় সাধন ও সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজের জন্য দেশের ৬৪ জেলায় ৭০ হাজার ৯৯টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে নিবন্ধন দেওয়া হয়। এর মধ্যে মহিলা সমবায় সমিতির সংখ্যা ২৭ হাজার ৫ ৯৯টি। গঠণতন্ত্র পরিপন্থী কাজের জন্য ১১ হাজার ৫৩৪টি সংস্থাকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ৩৭টি সংস্থাকে ফের সক্রিয় করা হয়। বর্তমানে ৫৮ হাজার ৪৬৫টি সংস্থা সক্রিয় রয়েছে। সমবায় অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সমবায় অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে বর্তমানে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৮৮৬টি সমবায় সমিতি রয়েছে, যার ব্যক্তি সদস্য সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২২ লক্ষ ৪১ হাজার ১৫৬ জন। সমবায় সমিতির বর্তমান কার্যকরি মূলধন প্রায় ২৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, মোট সম্পদ প্রায় ১১ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা। এসব সমবায় সমিতির মাধ্যমে প্রায় ১১ লক্ষ ১২ হাজার ৩৩ জন মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সমবায় সমিতিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সরকারের ভিশন ২০৪১ এবং জাতিসংঘ কর্তৃক টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ বাস্তবায়নে সমবায় অধিদপ্তর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করছেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

অপরদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনস্থ এনজিও ব্যুরো সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে এনজিও ব্যুরোর অধীনে নিবন্ধিত দেশি-বিদেশি এনজিওর সংখ্যা ২৬২৩টি। এর মধ্যে দেশিয় এনজিও রয়েছে ২৩৫২টি ও বিদেশি ২৭১টি এনজিও রয়েছে। বিধি ভঙের দায়ে এ পর্যন্ত ৭৩৮টি এনজিও’র নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- সোসাইটি ফর অরগানাইজেশন লার্ণিং ফর ভিলেজ ইকোনমি (সলভে), সমন্বীতা শিশু স্বাস্থ্য সংস্থা, অরগানাইজেশন ফর সোস্যাল জাস্টিজ অ্যান্ড সিকিউরিটি, অতিক্রম, জনউন্নয়ন ফাউন্ডেশন, আল মুনতাদা আল ইসলামি ইউকে, বাংলাদেশ ডেভলপমেন্ট অরগানাইজেশন, বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ইউনিভারসিটি ওমেন্স এসোসিয়েশন ফর ইউথ এডভান্সমেন্ট, চেষ্টা ও দাপুনিয়া পুনর্বাসন কল্যান সংস্থা।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর উপ-পরিচালক (প্রশাসন-উপসচিব) মো. মনির হোসেন দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, সারাদেশে এনজিওগুলোর নিবন্ধন দিচ্ছে সমাজসেবা, সমবায়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তর সরকারি বিভিন্ন সংস্থা। তবে আমাদের দপ্তর থেকে ২৬২৩টি সংস্থার নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। এর বাহিরে বেসরকারিভাবে এনজিও’র সংখ্যা ২৭ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনিবন্ধিত এনজিওগুলোই মূলত ভুয়া। এগুলো দেখভালের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর। অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রতারণা এড়াতে সাধারণ মানুষ ও চাকরি প্রত্যাশীদের আরো দায়িত্বশীল এবং সতর্ক হতে হবে। আমাদের দপ্তর থেকে নিবন্ধিত সংস্থার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পেলে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

 

 

জনপ্রিয় সংবাদ

নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে সামান্তা শারমিনের নতুন বার্তা

দেশজুড়ে ভুয়া এনজিও’র শক্তিশালী সিন্ডিকেট

আপডেট সময় : ০৭:২৫:৩১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৩০ জুন ২০২৪

 

◉ চটকদার বিজ্ঞাপনে লোভনীয় বেতনে চাকরির নামে প্রতারণার ফাঁদ
◉ কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে অফিসে ঝুলানো হচ্ছে তালা
◉ দেশে দেশি-বিদেশি এনজিও ব্যুরোর সংখ্যা ২৬২৩টি
◉ সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধিত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ৭০০৯৯টি
◉ সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধিত সমিতির সংখ্যা ১৮৮৮৮৬টি
◉ অর্থ লেনদেনে গ্রাহক এবং চাকরি প্রত্যাশীদের দায়িত্বশীল ও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞের

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে সমাজসেবামূলক কাজে ও ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়ার প্রকল্পের নামে ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে উঠেছে হাজার হাজার এনজিও সংস্থা এবং বেসরকারি সমবায় সমিতি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ঢাকা ও বিভাগীয় শহরগুলোর নজরকাড়া স্থানগুলো টার্গেট করে লোভনীয় বেতন-ভাতা ও পদ-পদবীর প্রস্তাব দিয়ে সাঁটানো হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। সোস্যাল মিডিয়া, গণপরিবহন এমনকি ব্যস্ত নগরীর বিভিন্ন দেওয়ালেও স্টীকারযুক্ত নিয়োগ বিজ্ঞাপন সাঁটিয়ে হতদরিদ্র শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা চালাচ্ছে সংঘবদ্ধ একটি প্রতারকচক্র। ইতোমধ্যেই তারা দেশজুড়ে ভুয়া এনজিও ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার নামে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। চক্রটি নানান কৌশলে চাকরি প্রত্যাশী বেকার তরুণ-তরুণীদের চাকরি ও ক্ষৃদ্র ঋণ দেওয়ার নামে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে প্রতিনিয়ত হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। চাকরি প্রত্যাশী বা ঋণ গ্রহীতারা বিষয়টি টের পাওয়ার আগেই বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়ে অফিসে তালা ঝুলিয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে প্রতারকরা। এতে প্রতিনিয়তই নিঃস্ব হচ্ছে হাজারো দরিদ্র জনগোষ্ঠী। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এনজিও ব্যুরোর তথ্য বলছে, সারা দেশে ২৬২৩টি দেশি-বিদেশি এনজিওকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিধি ভঙে ৭৩৮টি এনজিও’র কার্যক্রম বাতিল করা হয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশের ৬৪ জেলায় এ পর্যন্ত ৭০০৯৯টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। গঠণতন্ত্র প্রতিপালন না করায় ১১৫৩৪টি সংস্থার কার্যক্রম বিলুপ্ত করা হয়েছে। তবে বর্তমানে ৫৮৪৬৫টি সংস্থা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। অপরদিকে সমবায় অধিদপ্তরের তথ্য বলছে সারা দেশে ১৮৮৮৮৬টি সমবায় সমিতি নিবন্ধিত রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতারকরা সবসময়ই নানান কৌশলে প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করেন। ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহণ, সঞ্চয় বা চাকরির জন্য প্রত্যাশীদের অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে অবশ্যই আরো বেশি সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে। একই সঙ্গে এনজিও বা কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম সম্পর্কে আগেই খোঁজ-খবর নিতে হবে। অনিবন্ধিত ভুয়া এনজিও এবং কোম্পানিগুলোর সার্বিক কার্যক্রম তদারকির দায় সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরসমূহের।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ভুয়া এনজিও এবং চাকরি দেওয়ার নামে যত্রতত্র খুলে বসা কোম্পানিগুলোর নামে অভিযোগ পেলেই অভিযান চালানো হচ্ছে। অনেককেই আইনের আওতায় এনে আদালতে সোপর্দ করা হয়। কিন্তু আইনের ফাঁক গলিয়ে তারা বের হয়ে স্থান পরিবর্তন করে অন্য নামে একই পেশায় যুক্ত হচ্ছে। গত কয়েকদিন ভুক্তভোগীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার অনুমতিপ্রাপ্ত উল্লেখপূর্বক শহর-গ্রাম ও ব্যস্ততম নগরীর গুরুত্বপর্ণ পয়েন্টে এমনটি গণপরিবহন, গণমাধ্যমে লোভনীয় বেতন-ভাতা ও পদ-পদবী উল্লেখ্য করে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। ওইসব বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, প্রোগ্রাম অফিসার, এরিয়া ম্যানেজার, নিরাপত্তাকর্মী, কলসেন্টার কর্মী, বিপণন কর্মকর্তাসহ নানা পদে চাকরির সুযোগ রয়েছে। ওই বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে আগ্রহীরা যোগাযোগ করলে প্রথমে তাদের জীবনবৃত্তান্ত জমা নেওয়া হয়। এরপর ফোন করে বলা হয়, আপনি চাকরির জন্য মনোনীত হয়েছেন। পরের ধাপ নিবন্ধন, প্রশিক্ষণসহ নানা অজুহাত দেখিয়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। সেইসঙ্গে সপ্তাহব্যাপী প্রশিক্ষণে তাদের শেখানো হয় কীভাবে নতুন চাকরিপ্রত্যাশীদের ফাঁদে ফেলে টাকা হাতিয়ে নিতে হবে। আর সেই টাকার একটি অংশ তারাও বেতন হিসেবে পাবেন। দীর্ঘদিন ধরে চাকরি দেওয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নেওয়া চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে এসেছে প্রতারণার এমন কাহিনি। পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, ঢাকার অফিস ছাড়াও দেশের ৬৪ জেলায় রয়েছে তাদের মার্কেটিং অফিসার। তারা প্রতিদিন নতুন চাকরিপ্রার্থীদের ফাঁদে ফেলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে মাঝেমধ্যে চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়। তবে জামিনে বেরিয়ে তারা নিজেদের ও প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে আবারও একই ধরনের কর্মকাণ্ড শুরু করে। এ পর্যন্ত ৭০০ জনের বেশি প্রার্থী ফাঁদে পড়ে প্রতারিত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

ডিএমপি’র ডেমরা অঞ্চলের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মধুসূদন দাস বলেন, ফেসবুকে চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে এক তরুণী তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাকে জানানো হয়, কলসেন্টারে চাকরি দেওয়া হবে, বেতন ১৮ হাজার ৫০০ টাকা। তবে এজন্য মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হবে। সরল বিশ্বাসে তিনি সেই টাকা দিয়ে দেন, তবে চাকরি পাননি। বরং টাকা ফেরত চাইলে তাকে হুমকি ধমকি দেওয়া হয়। ভুক্তভোগী এ ঘটনায় ডেমরা থানায় মামলা করেন। এর ভিত্তিতে অতি সম্প্রতি প্রতারক চক্রের ৬ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরা হলেন- ড্রিম লাইফ লজিস্টিক সার্ভিস কোম্পানির মালিক সজীব হোসেন, মালিক ও উপপরিচালক ফজলে রাব্বি, প্রশিক্ষক তামান্না ইসলাম, রিসিপশনিস্ট স্বপ্না খাতুন, মার্কেটিং অফিসার মোতাসিম বিল্লাহ ও নাজিম উদ্দিন নয়ন। প্রতিষ্ঠানের আরেক মালিক ও চেয়ারম্যান মারুফ হাওলাদার ওরফে মিজানুর রহমান ওরফে বাবু এখনও পলাতক।

মামলার বাদী লাবনী বেগম জানান, তিনি ফেসবুকে ড্রিম লাইফ লজিস্টিক নামক প্রতিষ্ঠানে চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে লাইক কমেন্ট করেন। এরপর প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাঁকে চাকরির জন্য মনোনীত করা হয়েছে জানিয়ে খরচ বাবদ ৪০ হাজার টাকা চায়। তিনি তা দিয়ে দেন। এরপর চাকরির নিবন্ধনের জন্য খিলগাঁওয়ের প্রভাতীবাগে প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে ডাকা হয়। সেখানে আরও ১০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। তবে টাকা নেওয়ার পর তারা যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।

এদিকে সম্প্রতি দেশের আত্মনির্ভরশীল ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বেসরকারি বৃহৎ এনজিও সংস্থা আশা’তে কর্মী নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়, সংস্থাটি ট্রেইনি হিসাবরক্ষক পদে ৫৪৭ জন এবং ফিল্ড অফিসার পদে ৭৩৩ জন নিয়োগ দিবে। বিষয়টি নজরে আসে সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের। পরে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বেসরকারি সংস্থা আশা ট্রেইনি হিসাবরক্ষক এবং ফিল্ড অফিসার পদে নিয়োগের জন্য সম্প্রতি এমন কোনো বিজ্ঞপ্তি দেয়নি বরং এনজিওটির নাম ও লোগো ব্যবহার করে প্রচারিত এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটিকে সংস্থাটির পক্ষ থেকে ভুয়া বলে নিশ্চিত করা হয়েছে।

এদিকে বাগেরহাটের রামপালে সমাজ উন্নয়ন সংস্থা (এসইউএস) নামের একটি ভুয়া এনজিওর ফাঁদে পড়ে প্রায় দুই শতাধিক গ্রাহক সর্বস্বান্ত হয়েছেন। ভুক্তভোগীরা গত ২৩ জানুয়ারি রামপাল থানায় পৃথক দুটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
ভুক্তভোগী অনেকেই জানান, ঢাকার পল্টন, ফকিরেরপুল, মতিঝিল, কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ, হাজারীবাগ, কমলাপুর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, শান্তিনগর, মিরপুর, পল্লবী, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, উত্তরা ও সাভার ধামরাই এলাকায় কয়েকশ’ ভুয়া এনজিও সংস্থা সক্রিয় রয়েছে। তারা বিভিন্ন প্রকল্পে চাকরি দেওয়ার নামে দেশের হতদরিদ্র শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীদের টার্গেট করে প্রতিনিয়তই কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে ভাড়া করা অফিসের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি টের পাওয়ার পর ভুক্তভোগীদের অনেকেই থানায় আদালতে অভিযোগ করছেন। এরপর আদালত থেকে একেক জনের নামে এক থেকে ছয় লাখ টাকার চেক প্রতারণা মামলার কাগজ এলে জানতে পারেন তারা প্রতারণার শিকার হয়েছে।

র‌্যাব জানায়, রাজধানী ঢাকায় নয়, সারা দেশেই এসব প্রতারকচক্র ফাঁদ পেতে আছে। উত্তরণ ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি নামে একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় ২-৩ মাসের জন্য অফিস ভাড়া নেয়। এরপর তারা পত্রিকায় কর্মী নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেয়। কর্মী নিয়োগ করে গ্রাহক সংগ্রহ করার জন্য নিয়োগকৃত কর্মীদের তাদের নিজ বাড়ি এলাকায় পাঠিয়ে দেয়। প্রতারক চক্র প্রতারণার উদ্দেশ্যে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ দেওয়ার নামে ১০ শতাংশ হারে সিকিউরিটি হিসেবে গ্রাহকদের কাছ থেকে নিয়োগ করা কর্মীদের মাধ্যমে অর্থ আদায় করে। প্রতারণার কৌশল হিসেবে প্রথমে তারা সদস্য সংগ্রহ করে থাকে। এই প্রতারক চক্রের মাঠ পর্যায়ের কর্মী/সদস্যদের মাধ্যমে বিভিন্ন বস্তি এলাকার প্রতিবন্ধী, ভিক্ষুক, সেলুনের কর্মচারী, মনোহারী ও ফুটপাতের দোকানদার, গৃহকর্মী ও নিম্নআয়ের মানুষকে টার্গেট করে। ঋণের লোভ দেখিয়ে সঞ্চয়ের নামে তাদের কোম্পানিতে বিনিয়োগ/ডিপিএস করতে উদ্বুদ্ধ করে। তার পর সঞ্চয় সংগ্রহ করে অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রমে জড়িয়ে ফেলে। সাধারণ অশিক্ষিত মানুষ না বুঝে এসব প্রতারণার ফাঁদে পা দেয়। স্বল্প সময়ে ঋণ দেওয়ার প্রলোভন এমন কি ফ্ল্যাট/জমি দেওয়ার আশ্বাসও দিয়ে থাকে তারা। অনুমোদন ছাড়া সারা দেশে এ রকম অসংখ্য সমিতি ও মাইক্রোক্রেডিট প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এদের যথাযথ মনিটরিং না করায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করার তো কোনও অধিকার নেই তাদের। এ জন্য রেগুলেটরি বডি রয়েছে। তাদের উচিত এদের এখনই প্রতিরোধ করা।

সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, শিশু কল্যাণ, যুব কল্যাণ, নারী কল্যাণ, শারীরিক ও মানসিকভাবে অসমর্থ ব্যক্তিদের কল্যাণ, পরিবার পরিকল্পনা, সমাজবিরোধী কার্যকলাপ হতে জনগণকে বিরত রাখা, সামাজিক শিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষা, কারামুক্ত কয়েদীদের কল্যাণ ও পুনর্বাসন, কিশোর অপরাধীদের কল্যাণ, ভিক্ষুক ও দুস্থদের কল্যাণ, দরিদ্র রোগীদের কল্যাণ ও পুনর্বাসন, বৃদ্ধ ও দৈহিকভাবে অসমর্থ ব্যক্তিদের কল্যাণ, সমাজকল্যাণকার্যে প্রশিক্ষণ এবং সমাজকল্যাণ সংস্থাসমূহের সমন্বয় সাধন ও সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজের জন্য দেশের ৬৪ জেলায় ৭০ হাজার ৯৯টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে নিবন্ধন দেওয়া হয়। এর মধ্যে মহিলা সমবায় সমিতির সংখ্যা ২৭ হাজার ৫ ৯৯টি। গঠণতন্ত্র পরিপন্থী কাজের জন্য ১১ হাজার ৫৩৪টি সংস্থাকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ৩৭টি সংস্থাকে ফের সক্রিয় করা হয়। বর্তমানে ৫৮ হাজার ৪৬৫টি সংস্থা সক্রিয় রয়েছে। সমবায় অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সমবায় অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে বর্তমানে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৮৮৬টি সমবায় সমিতি রয়েছে, যার ব্যক্তি সদস্য সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২২ লক্ষ ৪১ হাজার ১৫৬ জন। সমবায় সমিতির বর্তমান কার্যকরি মূলধন প্রায় ২৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, মোট সম্পদ প্রায় ১১ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা। এসব সমবায় সমিতির মাধ্যমে প্রায় ১১ লক্ষ ১২ হাজার ৩৩ জন মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সমবায় সমিতিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সরকারের ভিশন ২০৪১ এবং জাতিসংঘ কর্তৃক টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ বাস্তবায়নে সমবায় অধিদপ্তর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করছেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

অপরদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনস্থ এনজিও ব্যুরো সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে এনজিও ব্যুরোর অধীনে নিবন্ধিত দেশি-বিদেশি এনজিওর সংখ্যা ২৬২৩টি। এর মধ্যে দেশিয় এনজিও রয়েছে ২৩৫২টি ও বিদেশি ২৭১টি এনজিও রয়েছে। বিধি ভঙের দায়ে এ পর্যন্ত ৭৩৮টি এনজিও’র নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- সোসাইটি ফর অরগানাইজেশন লার্ণিং ফর ভিলেজ ইকোনমি (সলভে), সমন্বীতা শিশু স্বাস্থ্য সংস্থা, অরগানাইজেশন ফর সোস্যাল জাস্টিজ অ্যান্ড সিকিউরিটি, অতিক্রম, জনউন্নয়ন ফাউন্ডেশন, আল মুনতাদা আল ইসলামি ইউকে, বাংলাদেশ ডেভলপমেন্ট অরগানাইজেশন, বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ইউনিভারসিটি ওমেন্স এসোসিয়েশন ফর ইউথ এডভান্সমেন্ট, চেষ্টা ও দাপুনিয়া পুনর্বাসন কল্যান সংস্থা।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর উপ-পরিচালক (প্রশাসন-উপসচিব) মো. মনির হোসেন দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, সারাদেশে এনজিওগুলোর নিবন্ধন দিচ্ছে সমাজসেবা, সমবায়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তর সরকারি বিভিন্ন সংস্থা। তবে আমাদের দপ্তর থেকে ২৬২৩টি সংস্থার নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। এর বাহিরে বেসরকারিভাবে এনজিও’র সংখ্যা ২৭ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনিবন্ধিত এনজিওগুলোই মূলত ভুয়া। এগুলো দেখভালের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর। অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রতারণা এড়াতে সাধারণ মানুষ ও চাকরি প্রত্যাশীদের আরো দায়িত্বশীল এবং সতর্ক হতে হবে। আমাদের দপ্তর থেকে নিবন্ধিত সংস্থার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পেলে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।