◉ সাধারণ মানুষের নিবন্ধনে সাড়া নেই
◉ ১০ মাসে চার স্কিমে নিবন্ধন তিন লাখ
◉ সবচেয়ে কম নিবন্ধন প্রবাস স্কিমে
◉ ব্যাপক প্রচারের উদ্যোগ পেনশন কর্তৃপক্ষের
►সর্বজনীন পেনশন নিয়ে দেশের মানুষের মনে এখনও আস্থার সংকট রয়েছে➺অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
►সর্বজনীন পেনশনে সরকার হোঁচট খেয়ে বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যয় স্কিমে যুক্ত করছে ➺অধ্যাপক ড. মোহা. হাছানাত আলী
দেশের চলমান অর্থনৈতিক নানা সংকটের মধ্যেই গত বছর ১৭ আগস্ট চালু হয় সর্বজনীন পেনশন স্কিম। প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা এই স্কিমের উদ্বোধন করেন। এই পেনশনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছেÑ দেশের জনগণের গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে ক্রমবর্ধমান বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে টেকসই ও সুসংগঠিত সমাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতাভুক্ত করার লক্ষ্যে এবং ভবিষ্যতে কর্মক্ষম জনসংখ্যা হ্রাসের কারণে নির্ভরশীলতার হার বৃদ্ধির কারণে এটা চালু করা হয়েছে। এ বিষয়ে জাতীয় সংসদে “সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩” পাস এবং ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভের পর আইনটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। ওই আইনের আলোকে গঠিত ‘জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের’ মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা।
এরই মধ্যে ১০ বছর পার করেছে পেনশন কার্যক্রম। তবে যে সাধারণ মানুষের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা বলে এই পেনশন চালু করা হয়েছে, তাদের মাঝে খুব বেশি সাড়া ফেলতে পারেনি এই সিস্টেম। প্রথমে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা এবং সমতা নামে চারটি স্কিম নিয়ে চালু হলেও পরে এর আওতা বাড়াতে গত ১ জুলাই থেকে প্রত্যয় নামে আরেকটি স্কিম চালু হয়েছে। যদিও এই স্কিমে লাভ-ক্ষতির নানা হিসাব মিলিয়ে তা প্রত্যাহারের দাবিতে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষকরা। প্রত্যয় নিয়ে ব্যাপক নেতিবাচক প্রচারের প্রভাব অন্য স্কিমেও পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে ব্যাপক আয়োজনে আসা সর্বজনীন পেনশনের ভবিষ্যৎ সফলতা নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখছেন অনেকে। মূলত, সরকারিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কর্তাদের ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি এবং অর্থ লোপাটের খবরে মানুষের মাঝে এ বিষয়ে আস্থাহীনতা বিরাজ করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যদিও সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, দেশে এই ধারণাটি সম্পূর্ণ নতুন। ফলে স্কিমটি নিয়ে এখনও মানুষের স্পষ্ট ধারণা হয়নি। এ কারণে সারা দেশে একেবারে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত সর্বজনীন পেনশন নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। মানুষ যত জানবে, তত এতে অংশগ্রহণ বাড়বে। এ জন্য নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলেও প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে।
কার্যক্রম শুরুর ১০ মাসের মাথায় সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নিবন্ধন সংখ্যা ৩ লাখ ছাড়িয়েছে বলে জানায় পেনশন কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে সংযুক্ত অর্থমন্ত্রণালয়ের অর্থবিভাগের সিনিয়র সচিব মো. শরীফ উদ্দিন স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, উদ্বোধনের পর হতেই জনকল্যাণকর এ কর্মসূচিতে মানুষের উল্লেখযোগ্য আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে, সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নিবন্ধন সংখ্যা ১০ মাসে তিন লাখের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। বর্তমানে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা নামে চারটি স্কিমে নিবন্ধনের সুবিধা চালু রয়েছে। এ চারটি স্কিমে যথাক্রমে সমতা স্কিমে ২,২৪,১৬৪, প্রগতি স্কিমে ২১,২৯৪, সুরক্ষা স্কিমে ৫৬,৯১৯ এবং প্রবাস স্কিমে ৭৯৯ জন নিবন্ধিত হয়ে সর্বমোট ৩,০৩,১৭৬ জন মাসিক সাবস্ক্রিপশন প্রদান করছেন। এরই মধ্যে ৮৭টি এনজিও প্রগতি স্কিমে নিবন্ধিত হয়ে তাদের কর্মচারীদের অনুকূলে সাবস্ক্রিপশন প্রদান করছে। সাবস্ক্রিপশন বাবদ মোট ৮৬ কোটি ৬৮ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ টাকা জমা হয়েছে। এই অর্থ হতে সরকারি ট্রেজারি বন্ডে ৬২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। ৫ম স্কিম হিসেবে ‘প্রত্যয়’ নামে নতুন স্কিম চালুর কথা জানিয়ে এতে বলা হয়Ñ সকল স্ব-শাসিত, স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা ১ জুলাই ২০২৪ থেকে উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানে নতুন যোগদান করবেন তাদের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে কার্যকর হবে।
এদিকে সর্বজনীন পেনশনে জনগণকে আগ্রহী করতে প্রচারণায় জোর দেয়া প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ সর্বজনীন পেনশন স্কিম সম্পর্কে জনগণকে আগ্রহী করতে প্রচার-প্রচারণাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এ লক্ষ্যে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ, বেসরকারি সংস্থা, জনপ্রতিনিধি, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টদের সম্পৃক্ত করে কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। এরইমধ্যে মাঠ প্রশাসনকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ হতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবকে সভাপতি করে জাতীয় পর্যায়ে ‘সর্বজনীন পেনশন কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও সমন্বয় কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে সর্বজনীন পেনশন কার্যক্রমকে মনিটরিং ও সমন্বয়ের লক্ষ্যে বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও বাস্তবায়ন ও সমন্বয় কমিটি গঠন করে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রধান করা হয়েছে।
সর্বজনীন পেনশনে তেমন সাড়া নেই জানিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহা. হাছানাত আলী সবুজ বাংলাকে বলেন, সরকার সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর সময় বলেছিল, যারা কোনো পেনশনে যুক্ত নেই, তাদের সুবিধার্থে এই পেনশন চালু করা হয়েছে। কিন্তু এতে জনগণের আস্থা পায়নি সরকার। প্রথমেই হোঁচট খেয়ে এখন বিভিন্ন পেনশন সুবিধাভোগীদের বাধ্যতামূলকভাবে এর আওতায় আনছে। ব্যাংক ধস, পাচার, দুর্নীতিসহ ব্যাপক অর্থ লোপাটের কারণেই জনগণের মাঝে সরকারের এই পেনশন ব্যবস্থায় আস্থাহীনতা রয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।
একই ধরনের মন্তব্য করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, সর্বজনীন পেনশন নিয়ে দেশের মানুষের মনে এখনও আস্থার সংকট রয়েছে। মানুষ এখনও মনে করে এখানে টাকা জমা দিয়ে ফেরত পাওয়া যাবে কি না সেটি নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। এ ছাড়া জনগণের এই টাকা কোথায় বিনিয়োগ করা হবে, সে বিনিয়োগ লাভজনক হবে না লোকসান হবে, লোকসান হলে লভ্যাংশ পরের কথা মূল টাকা ফেরত পাওয়া যাবে কি নাÑ মানুষের মনে এমন নানা প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে। তিনি বলেন, আস্থা বাড়ানোর জন্য লাভজনক জায়গায় বিনিয়োগ করতে হবে, মানুষের কাছে যেতে হবে, তাদের বোঝাতে হবে, এখানে টাকা রাখলে নষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আসলে কথায় বলে বৃক্ষ তোমার নাম কী ফলে পরিচয়। আগামীতে ফলই বলে দেবে সর্বজনীন পেনশন নামের বৃক্ষটি কেমন হবে।
এ বিষয়ে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেছেন, সর্বজনীন পেনশন স্কিম আমরা চালু করেছি দেশের সব মানুষের জন্য। শ্রমিক, কর্মজীবী এমনকি রাজনৈতিক কর্মীসহ যাদের জন্য কখনোই অবসর জীবনে কোনো অর্থনৈতিক সুযোগই ছিল না। সেই বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সঙ্গে যখনই কথা হয়েছে, তারা বলেছেন, তাদের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিম খুব চমৎকার। যারা এর (প্রত্যয় স্কিম) আওতায় নেই তারা অনেক কথা বলছেন, বিভিন্ন মাধ্যমে। ‘প্রত্যয়’ স্কিম নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে ‘তথ্যের ঘাটতি’ রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তবে সর্বজনীন পেনশন নিয়ে ইতিবাচক আশা প্রকাশ করে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা বলেন, জাপান-কোরিয়ার মতো দেশ ৬০-এর দশকে চালু করে সর্বজনীন পেনশন। এত যুগ পাড়ি দেওয়ার পর এখন ওইসব দেশে সর্বজনীন পেনশন একটা পর্যায়ে এসেছে। আমাদের অত সময় লাগবে না। ওইসব দেশের চেয়েও অনেক আগেই আমরা সর্বজনীন পেনশনে সফলতা পাব বলে আমার বিশ্বাস।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ১৮ থেকে ৫০ বৎসর বয়সি একজন সুবিধাভোগী ৬০ বৎসর বয়স পর্যন্ত এবং ৫০ বৎসরের ঊর্ধ্ব বয়স্ক একজন সুবিধাভোগী ন্যূনতম ১০ বছর চাঁদা প্রদান সাপেক্ষে আজীবন পেনশন সুবিধা ভোগ করবেন। বিদেশে কর্মরত বা অবস্থানকারী যে কোনো বাংলাদেশি কর্মীও এই স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। পেনশনে থাকাকালীন ৭৫ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার পূর্বে মৃত্যুবরণ করলে পেনশনারের নমিনি ৭৫ বৎসর পূর্ণ হওয়ার অবশিষ্ট সময় পর্যন্ত পেনশন প্রাপ্য হবেন। চাঁদাদাতা কমপক্ষে ১০ বৎসর চাঁদা প্রদান করার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করলে জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেয়া হবে। চাঁদাদাতা তার জমাকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসাবে উত্তোলন করতে পারবে।























