❖ প্রশ্নফাঁস ও নকল প্রবণতা বাড়ছে ভয়াবহরূপে
❖ নিয়োগ, ভর্তি ও পাবলিক পরীক্ষার সঙ্গে স্কুলের মূল্যায়নেও চলছে অনৈতিক তৎপরতা
❖ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে ঘটছে এসব অপকর্ম
➢ সর্বত্র অনিয়ম-দুর্নীতির প্রভাব পড়ছে শিক্ষায়- ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম- অধ্যাপক, ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয় ও প্রেসিডেন্ট, ইউট্যাব
➢ সরকারের কঠোর মনিটরিংয়ের অভাবে শিক্ষায় দুর্নীতি-জিয়াউল কবির দুলু, সভাপতি অভিভাবক ঐক্য ফোরাম
দেশে প্রশ্নফাঁস, সনদ জালিয়াতি আর পরীক্ষায় নকলের ঘটনা এখন অন্যতম আলোচিত বিষয়। কয়েক মাস আগে কারিগরি বোর্ডের সনদ জালিয়াতি চক্র ধরা পড়ার পর এ নিয়ে বেশ হৈচৈ পড়ে যায়। তবে সেই রেশ না কাটতেই এবার নতুন করে আলোচনায় এসেছে পিএসসির প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি। শুধু কারিগরি বোর্ড বা পিএসসি নয় এখন বিভিন্ন একাডেমিক, পাবলিক, ভর্তি ও নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস, জাল সনদ তৈরির সঙ্গে পরীক্ষায় নকল প্রবণতা ভয়াবহরূপে বাড়ছে বলে জানা গেছে। এমনকি নতুন শিক্ষাক্রমের প্রভাবে সম্প্রতি কোমলমতি স্কুল শিক্ষার্থীদের ষান্মাসিক মূল্যায়ন পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস এবং নানাভাবে দেখে লেখা বা নকল করার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এতে দেশের সার্বিক শিক্ষাকার্যক্রমের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মেধাচর্চার আগ্রহ চরম হুমকির মুখে পড়ছে বলে শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাব)-এর প্রেসিডেন্ট ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম সবুজ বাংলাকে বলেন, দেশের সর্বত্রই এখন অনিয়ম-দুর্নীতি বিরাজ করছে। তারই প্রভাব পড়ছে শিক্ষাক্ষেত্রেও। যেভাবে প্রশ্নফাঁস, সনদ জালিয়াতি ও পরীক্ষায় নকলের ঘটনা ঘটছে, তাতে শিক্ষা খাতকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে বলে মনে হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারসহ সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
সূত্রমতে, সম্প্রতি পিএসসির অধীনে একটি নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের জের ধরে প্রতিষ্ঠানটির অধীনে অনুষ্ঠিত বিসিএসসহ বিভিন্ন পরীক্ষা ঘিরে বড় একটি দুর্নীতিবাজ চক্র ধরা পড়েছে। আর এই চক্রে পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যানের ড্রাইভার থেকে শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা বাহিনী। প্রশ্নফাঁসসহ নানা দুর্নীতির মাধ্যমে বহু প্রার্থীকে চাকরি দিয়ে ওই চক্রটি কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। এ নিয়ে বিএসএস ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত অন্যদের মাঝেও চরম অস্থিরতা, উদ্বেগ ও বিব্রতকর অবস্থা বিরাজ করছে। এর আগে কারিগরি বোর্ডের অধীনে সনদ জালিয়াতি চক্রের মাধ্যমে ৫ হাজারের বেশি সনদ বাণিজ্য হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। এ নিয়েও সংশ্লিষ্ট মহলে বেশ তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এছাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায়ও প্রশ্নফাঁসসহ নিয়োগ-বাণিজ্যে জড়িত একটি চক্রকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। বিষয়টি নিয়েও বেশ তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
এভাবে বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস ও পরীক্ষায় নানা জালিয়াতির পাশাপাশি পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষায়ও প্রশ্নফাঁসসহ নানা জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া যায়। প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ ওঠে এসএসসি-এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষাতেও। তবে সম্প্রতি শুরু হওয়া এবারের এইচএসসি পরীক্ষা ঘিরে শিক্ষার্থীদের নকল প্রবণতা বেড়েছে বলে জানা গেছে। প্রতিটি পরীক্ষায় বেশ সংখ্যক শিক্ষার্থী এমনকি শিক্ষক বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটছে। সর্বশেষ চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার নিন্দপুর ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে শতভাগ পাস নিশ্চিত করতে শিক্ষক কর্তৃক এইচএসসি পরীক্ষায় নকল সরবরাহের ঘটনা আলোচিত হয়ে পড়ে। এ ঘটনায় শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশনায় কচুয়া উপজেলার পালাখাল রুস্তম আলী কলেজ ও নিন্দপুর ড. মহিউদ্দিন খান স্কুল ও কলেজ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অব্যাহতি প্রদান করেছে শিক্ষাবোর্ড। অন্যদিকে ‘ফোন দেখে লিখছেন পরীক্ষার্থীরা, পাশে দাঁড়িয়ে কক্ষ পরদির্শক’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক। এ ঘটনায় ১১ জনকে বহিষ্কার এবং একজনকে ৭ দিনের জেল দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হয়েছে। তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এদিকে নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় সম্প্রতি শুরু হওয়া মাধ্যমিকের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির মূল্যায়নের প্রশ্নফাঁসের ঘটনা বেশ আলোচিত হচ্ছে। এর সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান শিক্ষকরা জড়িত বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)-এর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান। তিনি বলেন, নৈপুণ্য অ্যাপকে কতভাবে কাজে লাগাতে পারি সেগুলো আমরা নিরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম। সেজন্য পরীক্ষার আগের দিন সন্ধ্যায় প্রধান শিক্ষকের আইডিতে মূল্যায়নের প্রশ্নগুলো পাঠাচ্ছি এবং প্রধান শিক্ষক ছাড়া কেউ আসলে প্রশ্নগুলো ডাউনলোড করতে পারবে না। কিন্তু আমরা দুর্ভাগ্যজনকভাবে লক্ষ করেছি যে, গত দুই তারিখে প্রধান শিক্ষকরা এগুলো ডাউনলোড করার সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে দিয়ে দিয়েছেন। সে কারণেই আমরা ৪ জুলাই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে নোটিস পাঠিয়েছি তারা যেন প্রশ্ন এভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে শেয়ার না করেন এবং সংরক্ষণ না করেন। তাছাড়া অধিদপ্তরগুলোকে অনুরোধ করেছি তারা যেন পরিবর্তে এমন কোনো ঘটনা ঘটলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর এরই মধ্যে অনেক শিক্ষককে শোকজ করেছেন।
সূত্রমতে, মূল্যায়ন পরীক্ষার আগের দিন এনসিটিবি থেকে স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের কাছে পাঠানো প্রশ্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। এমনকি ইউটিউব ও কোচিংগুলোতে পরীক্ষার আগেই উত্তরপত্রসহ সরবরাহ করা হচ্ছে। আর এসব শিট ফটোকপি বা লিখে নিয়ে মূল্যায়ন পরীক্ষায় নকল হিসেবে ব্যবহার করছে শিক্ষার্থীরা। রাজধানীর কয়েকটি স্কুলে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নকলের এ প্রবণতা দেখে শিক্ষক-অভিভাবকরা বেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্কুলে কোথাও বই দেখে, কোথাও নোট শিট দেখে আবার কোথাও মোবাইল ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা মূল্যায়নের লিখিত পরীক্ষা দিচ্ছে বলে জানা গেছে। এতে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা বা মেধাচর্চার আগ্রহ কমে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সরকারি একটি স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক জাকির হোসেন।
এদিকে মূল্যায়নের প্রশ্নফাঁস ও সমাধান ছড়ানোর অপরাধে পটুয়াখালীর দুই শিক্ষকের এমপিও (বেতন-ভাতা) স্থগিত করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। মঙ্গলবার মাউশির সূত্র এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে। এমপিও স্থগিত হওয়া দুই শিক্ষক হলেন, পটুয়াখালী সদরের ডোনাভান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লুৎফুন্নেসা ও ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার আমিনাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জামাল উদ্দিন।
যদিও এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ বলছে, নতুন কারিকুলামের পরীক্ষা বা মূল্যায়ন দক্ষতাভিত্তিক। ফলে কোনো শিক্ষার্থী পরীক্ষার আগে প্রশ্ন পেয়ে গেলেও তা মূল্যায়ন প্রভাব ফেলবে না।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, প্রশ্নফাঁস হলে কোনো সমস্যা নেইÑ এটা অত্যন্ত আপত্তিকর অবস্থান। তাহলে আমি কোন নৈতিকতা শিক্ষার্থীদের দিচ্ছি। আর যদি তাই হয়, তাহলে কেউ প্রশ্ন পাবে, কেউ পাবে না- এটা তো হতে পারে না। আবার কেউ পেলেও কোনো সমস্যা নেই। তাহলে তো সবাই পড়াশোনা বাদ দিয়ে প্রশ্নের পেছনে ছুটবে।
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু সবুজ বাংলাকে বলেন, সরকারের কঠোর মনিটরিংয়ের অভাবে এভাবে প্রশ্নফাঁস-নকলের ঘটনা ঘটছে। এতে মেধাবীরা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং লেখাপড়ায় তাদের অনীহা দেখা দেবে। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষা খাত ধ্বংস হবে। এ নিয়ে অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন।





















