◉ দেশে জ্বালানি নিরাপত্তার ঝুঁকি রয়েছে
◉ শীর্ষ গ্যাসক্ষেত্রের মজুত নিয়ে শঙ্কা
◉ জ্বালানি বিভাগের অবহেলা ও অদক্ষতাই দায়ী
◉ অনুসন্ধানে জোর তাগিদ বিশেষজ্ঞদের
◉ এখনও ৩২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট অনাবিষ্কৃত
◉ পাঁচ জেলার দুই ব্লকে গ্যাস খুঁজবে শেভরন
► দ্রুত গ্যাস পেতে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবেই শেভরনকে বেছে নেয়া হচ্ছে- নসরুল হামিদ, বিদ্যুৎ ওজ্বালানি প্রতিমন্ত্রী
► গ্যাস উত্তোলনে স্থানীয় কোম্পানিগুলোর আওতায় ক্ষেত্রগুলোর আন্ডার পারফর্মিং- অধ্যাপক ড. বদরূল ইমাম, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ
জ্বালনি সংকটে দেশের অর্থনীতিতে ছন্দপতন ঘটছে। যা ইতোমধ্যে দৃশ্যমান। চলমান সংকট কত দিন থাকবে তাও স্পষ্ট নয়। অন্যদিকে ফুরিয়ে আসছে গ্যাসের মজুত। এর মধ্যেই দেশে ৭০টি কূপের অধিকাংশেরই উৎপাদন কমছে। সংকটের আগে জ্বালানি খাতে উৎপাদনের চেয়ে আমাদানিতেই মনোযোগ বেশি ছিল। সিলেট গ্যাস ফিল্ড লিমিটেডের (এসজিএফএল) সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র কৈলাশটিলা থেকে ২০১৬ সালে দৈনিক প্রায় ৭০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হতো।
চলতি বছরে তা কমে অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। সত্তরের দশকে আবিষ্কৃত এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু হয় ১৯৮৩ সালে। মোট সাতটি কূপের অধিকাংশ কূপ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস উৎপাদন কমে যাওয়া দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগের বিষয়। তারা নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র ও কূপ অনুসন্ধানের তাগিদ দিয়েছেন। তারা অভিযোগ করে বলেন, সরকার সঠিকভাবে গ্যাস অনুসন্ধান করেনি। এখনো অনেক জায়গায় গ্যাসক্ষেত্র অনাবিষ্কৃত থাকতে পারে। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উৎপাদন কমে যাওয়া অবশ্য কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বর্তমানে দেশে গ্যাসক্ষেত্রের বেশির ভাগ থেকেই আগের তুলনায় কম গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে।
সূত্র মতে, দেশে দৈনিক গ্যাস উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি আসে হবিগঞ্জের বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে। চাহিদা মেটাতে কখনো কখনো সক্ষমতার চেয়ে বেশি উৎপাদন করেছে গ্যাসক্ষেত্রটি। ইতিমধ্যে এখানকার মোট মজুতের ৯৫ ভাগ শেষ হয়ে গেছে। বর্তমান উৎপাদনের ধারা ধরে রাখলে বাকি মজুত শেষ হয়ে যাবে খুব কম সময়ের মধ্যেই। এতে গ্যাস সরবরাহে বড় বিপর্যয় তৈরি হতে পারে। তবে নতুন মজুতের সম্ভাবনা দেখছে পেট্রোবাংলা।
এদিকে সরকারের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের হাইড্রোকার্বন ইউনিট থেকে পাওয়া তথ্য মতে, মাত্র চারটি গ্যাসক্ষেত্রে আগের চেয়ে বেশি উৎপাদন হচ্ছে। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি উৎপাদনকারী গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানায় প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে ২৬টি কূপের মধ্যে ছয়টির উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে দেশে গ্যাসের তীব্র সংকট দেখা দেয়। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তিনটি এবং দুটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের অধীন পরিচালিত গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে ২০২১ সালে প্রতিদিন দুই হাজার ৩৫২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হয়।
অথচ ২০১৬ সালে দেশে প্রতিদিন দুই হাজার ৬৬৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হতো এমন তথ্য পাওয়া যায় হাইড্রোকার্বন ইউনিট থেকে। তবে শঙ্কার কথা বলছেন ভূতত্ত্ববিদরা। তারা বরাবরই অনুসন্ধানের তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন।
এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) তথ্য বলছে, দেশে মাত্র ৯-১০ বছর ব্যবহারের জন্য গ্যাস মজুত আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলমান বৈশ্বিক সংকট না হলেও আমাদেরকে জ্বালানি সংকটের মুখোমুখি হতে হতো। ২০১৫ সাল থেকে স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন ও সরবরাহ কমে এসেছে এবং অদূর ভবিষ্যতে তা অব্যাহত থাকবে।
অন্যদিকে ভূ-বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুসারে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যতটুকু গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি প্রাকৃতিক গ্যাস অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। ফলে গ্যাস অনুসন্ধান দেশের জ্বালানি সংকট কাটিয়ে ওঠার সর্বোত্তম বিকল্প। দেশের গ্যাসে মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদন, সারসহ অন্যান্য শিল্প-কারখানার উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এবং বাসাবাড়িতে রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয়।
বিইআরসির দেয়া তথ্য সূত্রে, প্রায় ১২৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে কমপক্ষে ৪০টি কূপের ধারণক্ষমতা বাড়ানো যায় এবং সেগুলো থেকে প্রতিদিন ৪০০-৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। কিন্তু সরকার তা করেনি। গ্যাস উৎপানের সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি নিয়েও কথা বলেন ভূতত্ত্ববিদরা। গ্যাস উত্তোলনের সার্বিক বিষয়ে কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম। তিনি বলেন, আমাদের দেশে বর্তমানে অধিকাংশ গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন কমে গেছে। তবে এটিও আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে এখনো সব গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়নি। প্রতিটি গ্যাসক্ষেত্র তার সর্বোচ্চ উৎপাদনের একটি সীমায় উঠার পর ধীরে ধীরে উৎপাদন কমতে শুরু করে।
তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গত ২০ বছরে মাত্র ২৮টি অনুসন্ধানী কূপ খনন করেছে। হাইড্রোকার্বন থাকার সমূহ সম্ভাবনা আছে, এমন একটি দেশের জন্য এই সংখ্যাটি খুবই কম।
এদিকে ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে এবং পেট্রোবাংলার দুই বছরের যৌথ সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ৩২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস অনাবিষ্কৃত। নরওয়ের পেট্রোলিয়াম ডিরেক্টরেট এবং হাইড্রোকার্বন ইউনিট আরেকটি যৌথ গবেষণার প্রস্তাব করেছে, বাংলাদেশের অনাবিষ্কৃত গ্যাস সম্পদের গড় সম্ভাবনা ৪২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের আয়তন এক লাখ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং এখন পর্যন্ত মোট ১০০টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে। অন্যদিকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আয়তন ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং সেখানে ১৫০টিরও বেশি অনুসন্ধানী কূপ খনন করা হয়েছে। এ ধরনের পরিসংখ্যান দেখায়, বাংলাদেশে অনুসন্ধানের হার আসলে কতটা কম।
চলমান গ্যাস-সংকটের মধ্যে দেশের সবচেয়ে বেশি মজুত থাকা তিনটি গ্যাসক্ষেত্র ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস, সিলেটের কৈলাসটিলা ও হবিগঞ্জের রশিদপুর থেকে কমছে উৎপাদন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ জন্য দায়ী জ্বালানি বিভাগের অবহেলা ও অদক্ষতা। কারিগরি পরিকল্পনা ও দক্ষ প্রযুক্তির অভাবে মজুত থাকার পরও উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। অথচ কম মজুত থাকা বিবিয়ানা থেকে কয়েক গুণ উৎপাদন বাড়িয়ে তা শেষ করা হয়েছে। দেশে বর্তমানে ২৮টি গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র তিতাস থেকে উৎপাদন করছে সরকারি কোম্পানি বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল)। কৈলাসটিলা ও রশিদপুর থেকে উৎপাদন করে আরেক সরকারি কোম্পানি সিলেট গ্যাস ফিল্ড লিমিটেড (এসজিএফএল)। আর বিবিয়ানা থেকে উৎপাদন করে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন। তিতাস গ্যাসক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি মজুত থাকলেও এটি উৎপাদনে পিছিয়ে আছে।
দেশে গত অর্থবছর মোট গ্যাস উত্তোলনের অর্ধেকের বেশি মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরনের। কোম্পানিটির আওতাধীন তিনটি ক্ষেত্রের মোট গ্যাস উত্তোলন ছিল ৪৮৬ বিসিএফ। এর মধ্যে বিবিয়ানা থেকেই এসেছে ৪১৬ বিসিএফ গ্যাস। পাঁচ জেলার দুই ব্লকে গ্যাস খুঁজবে শেভরন: পাঁচ জেলার দুটি ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানের দায়িত্ব পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের তেল ও গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান শেভরন। জ্বালানি বিভাগ এরই মধ্যে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে।
সম্প্রতি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, দ্রুত গ্যাস পেতে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবেই শেভরনকে বেছে নেয়া হচ্ছে। দ্রুত ও মানসম্মত কাজের জন্য শেভরনের আগ্রহকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছে মন্ত্রণালয়। শেভরন প্রায় ২৮/২৯ বছর ধরে আমাদের দেশে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ করছে। তাদের প্রোডাকশন গ্রেড অনেক ভালো। আমাদের দেশের মানুষকে কাজে লাগানো, গ্যাস ফিল্ডগুলোর দেখভাল করা ইত্যাদিতে শেভরন তাদের সামর্থ্য দেখিয়েছে।
এদিকে এই দুই ব্লকে শেভরনের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় তেল গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সকে অংশীদার রাখা জরুরি বলে জানান জ্বালানি বিশেষজ্ঞ মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বলেন, স্থানীয় গ্যাস উত্তোলন কোম্পানিগুলোর আওতায় গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর আন্ডার পারফর্মিং। এসব ক্ষেত্রের কূপগুলোর দক্ষতা বাড়াতে কারিগরি উদ্যোগ অনেক আগেই নেয়া উচিত ছিল। দেশের গ্যাসকূপগুলোর উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ২০১১ সালে স্লামবার্জারকে দিয়ে একটি সমীক্ষা করেছিল পেট্রোবাংলা। কিন্তু পেট্রোবাংলা সে বিষয়ে কারিগরি কোনো উদ্যোগ নেয়নি।





















