* সরাসরি নিয়োগে সব গ্রেডে সাধারণ ৯৩ ও ৭ শতাংশ কোটা কার্যকর
* মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানরা ৫ শতাংশ
* ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী এক শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ এক শতাংশ
* বাতিল হয়েছে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনি এবং নারী ও জেলা কোটা
* কোটায় যোগ্যপ্রার্থী না পাওয়া গেলে মেধায় নিয়োগ
* শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে
* আপিলের রায়ের আলোকে প্রজ্ঞাপন, এতে কোনো পরিবর্তনের সুযোগ নেই Ñআইনমন্ত্রী
* হতাহতের জন্য আক্রমণকারীরা দায়ী, সব ঘটনার বিচার হবে -তথ্য প্রতিমন্ত্রী
আপিল বিভাগের রায়ের আলোকে কোটা বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর গতকাল মঙ্গলবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এই প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। পরে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রজ্ঞাপনের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এসময় জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এবং তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত উপস্থিত ছিলেন। আইনমন্ত্রী জানান, সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত/আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্বশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষের এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে/কর্মে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সব গ্রেডে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানরা ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী এক শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ এক শতাংশ কোটা কার্যকর হবে। কোটায় যোগ্যপ্রার্থী না পাওয়া গেলে মেধা থেকে নিয়োগ দিতে হবে।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে কি না- এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, ‘পরিষ্কারভাবে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সব গ্রেডে। সর্বোচ্চ আদালত কিন্তু চারটি ক্যাটাগরি পরিষ্কারভাবে করে দিয়েছেন। সরকার এর বাইরে যেতে পারবে না, কারণ এটা আপিল বিভাগের রায়। এর বাইরে যাওয়া আমাদের কোনো অভিপ্রায়ও নেই।’
যেসব চাকরির আবেদনের শেষ তারিখ ২১ জুলাই, আজ ২৩ জুলাই জারি করা প্রজ্ঞাপন সেইসব চাকরিতে অনুসরণ করা হবে কিনা- এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, ‘এই প্রজ্ঞাপনে পরিষ্কার বলা আছে, এই প্রজ্ঞাপন অবিলম্বে কার্যকর করা হবে। আমার মনে হয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এই শেষ লাইনটি গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন। তার মানে, আগামী ৩১ জুলাই যে সব চাকরির পরীক্ষা হবে, সেটাও এই প্রজ্ঞাপনের আলোকে বিবেচনা করতে হবে।’
কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেন, কোটার বিরুদ্ধে যখন শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছিল, এর সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন মহল এই আন্দোলনকে অন্যদিকে প্রবাহিত করার জন্য সহিংসতার পথ অবলম্বন করেন। একপর্যায়ে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা বলেন, আন্দোলনের পাশাপাশি তারা আলোচনায় বসতে চান। আমি প্রধানমন্ত্রীর আদেশে বলি, তারা যখনই আলোচনায় বসতে চায় আমরা রাজি আছি। আমরা বলেছিলাম, কোটা নিয়ে যে মামলাটা আপিল বিভাগে ৭ আগস্ট শুনানির অপেক্ষায় আছে সেটা এগিয়ে আনার ব্যবস্থা করব। সেইদিনই অ্যাটর্নি জেনারেল এই মামলাটা এগিয়ে এনে ২১ জুলাই শুনানির জন্য দিন ধার্য করেন এবং শুনানি শেষে আপিল বিভাগ রায় দেন। সেখানে আপিল বিভাগ বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে তারা একটা নির্দেশনাও দেন। সেই নির্দেশনায় তারা বলেন, মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী এক শতাংশ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য এক শতাংশ। এছাড়া কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বৈঠকের পর প্রেস ব্রিফিংয়ে আমি বলেছিলামÑ কোটার বিষয়টি নিয়ে সুষ্ঠু সমাধানে আসা সম্ভব। এবং আমি ২১ জুলাই যখন আপিলের রায় দেওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলাম, প্রজ্ঞাপন মঙ্গলবার জারি হবে। আমরা কথা রেখেছি, প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি-১ শাখা থেকে ২৩ জুলাই জারি করা প্রজ্ঞাপন পাঠ করে আইনমন্ত্রী বলেন, প্রজ্ঞানের বিষয়-সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত/আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্বশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষের এবং বিভিন্ন কেেপারেশনের চাকরিতে/কর্মে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি সংশোধন।
সরকার এইমর্মে আদেশ জারি করছে যে, সমতার নীতি ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর প্রজাতন্ত্রের কর্মে প্রতিনিধিত্বলাভ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত/আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্বশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষের এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে/কর্মে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সকল গ্রেডে নিম্নরূপ কোটা নির্ধারণ করা হলোÑ ১. ক. মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ, খ. মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, গ. ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী এক শতাংশ এবং ঘ. শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য এক শতাংশ। ২. নির্ধারিত কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সংশ্লিষ্ট কোটার শূন্যপদসমূহ সাধারণ মেধাতালিকা হতে পূরণ করা হবে। ৩. জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিগত ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবরের পরিপত্র ও এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন/আদেশ/নির্দেশ/অনুশাসন রহিত করা হলো। তার মানে ২০১৮ সালে কোটা বাতিলের যে পরিপত্র দেওয়া হয়েছিল সেটাও বাতিল করা হলো। এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর করা হইল।
এ আদেশের গেজেট নোটিফিকেশন প্রায় হয়ে গেছে। এর প্রেক্ষিতে সরকারের করণীয় বিভিন্ন কাজ তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেন, আমরা আপিল বিভাগের রায় প্রতিপালন করেছি। সহিংসতার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করেছি, তিনি কাজ শুরু করেছেন। অবস্থা একটু শান্ত হলেই তিনি স্পটগুলো ঘুরে দেখবেন। সহিংসতায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের যারা আহত হয়েছেন তাদের চিকিৎসার দেখভাল সরকার করবে। কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের ব্যাপারে কোনো মামলা হয়ে থাকলে সেগুলো আমরা অবশ্যই দেখব। শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এবং সব ছাত্রছাত্রীর সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে সরকার।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, সরকার সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগের রায় প্রতিপালন করেছে। রায়ের একটা দাড়ি, কমা, সেমিকোলন পরিবর্তনের ক্ষমতা আমাদের নেই। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা কোটা সংস্কার নয় মূলত এটা ছিল কোটাবিরোধী আন্দোলন, কোটা সংস্কার চেয়ে। ছাত্রছাত্রীরা কোটাবিরোধী আন্দোলন করছিল সংস্কার চেয়ে। আমরা সংস্কার করেছি।
এখন তাদেরও একটা কর্তব্য আছে, যেটা জনগণ মনে করে। সেটা হলো তাদের স্ব স্ব জায়গায় ফিরে গিয়ে পড়াশোনা করা উচিত। এটাই তাদের প্রতি আমার আহ্বান।
আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী কোটা বিষয়ে প্রজ্ঞাপনে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে। এর বাইরে সরকার একচুলও যেতে পারবে না।
আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী সরকার চাইলে কোটা বিষয়ে পরিবর্তন করতে পারবেÑ এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, এই প্রজ্ঞাপনে পরিষ্কার বলা আছে, এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে। রায় পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় আমি বলেছিলাম, সর্বোচ্চ আদালত অত্যন্ত বিচক্ষণ ও সুদূর প্রসারী একটা রায় দিয়েছেন। কারণ ভবিষ্যতে এ কোটা বদলাতে হলে আবার আদালতে রিভিউ করতে হতো। সেজন্য ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে তখন দেখা যাবে। এটা কোনোদিন কখনো আইন ছিল না। এটা সবসময় সরকারের পলিসি মেটার। এটা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমেই বলা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা যততাড়াতাড়ি শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা যায় সেটার ব্যাপারে সচেষ্ট। এবং সেজন্যই আপনারা আশা করতে পারেন তাড়াতাড়ি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে যাবে। তিনি বলেন, এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, এটা শুধু কোটাসংস্কার আন্দোলন ছিল না। বিএনপি জামায়াত, শিবির, ছাত্রদল ও জঙ্গিরা দেশকে নষ্ট করার চেষ্টা করছিল।
এ সময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, যেহেতু শিক্ষার্থীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ধ্বংসযজ্ঞ করা হয়েছে, আগেই তাদের পরিকল্পনা ছিল যে, ডেটা সেন্টার জালিয়ে দেবে। এতে আমরাও বিপদে পড়েছি। যেহেতু তারা আগে থেকেই জানত, সেহেতু তারা আন্তজার্তিক মিডিয়ায় ভুল তথ্য আগেই পাঠিয়ে দিয়েছে। আমরা খবর পাঠাতে পারিনি। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সমাধানের বিষয়টি নেই। সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান, আপনারা গ্লোবালি সঠিক খবর পাঠান। সরকার বলেছে, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ধৈর্য ধরেন সমাধান হয়ে যাবে। তাই হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, আমরা অবশ্যই ধৈর্য ধরেছি, কারণও আছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এখনো চাচ্ছি তারা বাড়িতে ফিরে যাক। তিনি বলেন, সুদূরপ্রসারী কথা বলেছেন আদালত, সরকার প্রয়োজনে এটা বাতিল বা পরিবর্তন, পরিমার্জন করতে পারবে। তিনি বলেন, কোটা আন্দোলনের মাধ্যমে যে সমস্যা তৈরি করা হয়েছিল, সেটার সমাধান করা হয়েছে। সহিংসতাকারীরা যে আইন লঙ্ঘন করেছে সেই আইনে তাদের বিচার হবে।
শিক্ষার্থীদের অন্য দাবিগুলোর কথাও আমি বলেছি। প্রধানমন্ত্রী একটা কথা বলে দিয়েছেন, যারা মৃত্যুবরণ করেছে তার ব্যবস্থা নেবেন। আমরা সেই অবস্থানেই আছি।
এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, এটা তথাকথিত আন্দোলন। কারণ পরে বোঝা গেছে যে, এই আন্দোলনে অন্যরা ঢুকে পড়েছে। শিক্ষার্থীদের কতটুকু অংশগ্রহণ ছিল তা সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হবে। তবে আইনমন্ত্রী বলেন, এ ব্যাপারে বিচারবিভাগীয় তদন্ত চলছে। সেই তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা কোনো কথা বলব না। তিনি বলেন, সমস্যা যেহেতু আদালত সমধান করে দিয়েছে, আমাদের বিশ^াস নতুন করে আর কোনো সমস্যা হবে না। পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে না। ঘটালে কঠোর ব্যবস্থা নেব। জনজীবনে যখন স্বস্তি আসবে অবশ্যই কারফিউ প্রত্যাহার করব। স্বস্তি ফিরছে। সেজন্য কারফিউ শিথিল করা হচ্ছে।
এ সময় তথ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, শিক্ষার্থীদের যে মুভমেন্টে জঙ্গি জামায়াত শিবির ঢুকেছে। আক্রমণ শুরু করেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আক্রান্ত ছিল। যখন আক্রান্ত হবেন, জীবন বিপন্ন, পুলিশ আক্রান্ত হয়েছে। তখন ফাইট করেছি, সংঘর্ষ হয়েছে। তখন হতাহত হয়েছে। আর এই হতাহতের জন্য আক্রমণকারীরা দায়ী। প্রতিটা হতাহতের নিন্দা জানাই, প্রতিটা ঘটনার বিচার হবে।























