০৯:৩১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ জামায়াত-শিবির

◉স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন জারি
◉জামায়াত-শিবিরসহ তাদের সব অঙ্গ সংগঠন এখন নিষিদ্ধ সত্ত্বা
◉নাশকতা মোকাবেলায় প্রস্তুত সরকার-স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী
◉রাজধানীতে নিরাপত্তা জোরদার আইনশৃংখলাবাহিনীর

অবশেষে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলো। সরকারের নির্বাহী আদেশে সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ এর ধারা ১৮(১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির ও তাদের অন্যান্য অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর আগে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে আইনি মতামত দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠায় আইন মন্ত্রণালয়। গতকাল দুপুরে আইনি মতামত দেওয়ার পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, এই দলগুলো নিষিদ্ধ হওয়ার পর তারা আর এই নামে রাজনীতি করতে পারবে না। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে জামায়াত তিন বার নিষিদ্ধ হয়েছিল বলে জানা গেছে।

এদিকে জামায়াত নিষিদ্ধ পরবর্তী যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় নিরাপত্তা জোরদার করেছে আইনশৃংখলাবাহিনী। এছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার ঘটনায় কেউ যদি নাশকতা চালায়, সেটা সরকার মোকাবিলা করবে। সেই সক্ষমতা সরকারের রয়েছে। গতকাল জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারির পর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।

সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় জামায়াত ও এর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের জড়িত থাকার অভিযোগ করে আসছিলেন সরকারের মন্ত্রীরা। এমন পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৯ জুলাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় সভায় জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে একমত হন ওই জোটের শীর্ষ নেতারা। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সেই বৈঠক হয়। জোটের বৈঠকে সিদ্ধান্তের পর এখন সরকারের নির্বাহী আদেশে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করা হলো।

বৃহস্পতিবার সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক শাখা-২ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়-‘যেহেতু, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত আইসিটি-বিডি কেস নম্বর-০৬, ২০১১, আইসিটি-বিডি কেস নম্বর-০২, ২০১২, আইসিটি-বিডি কেস নম্বর-০৩, ২০১২-সহ কয়েকটি মামলার রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (পূর্বনাম জামায়াত-ই- ইসলামী/জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ) এবং উহার অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির (পূর্বনাম ইসলামী ছাত্রসংঘ)-কে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধে দায়ী হিসাবে গণ্য করা হইয়াছে; এবং যেহেতু, বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ রিট পিটিশন নং-৬৩০/২০০৯-এ ০১/০৮/২০১৩ তারিখের প্রদত্ত রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এর রাজনৈতিক দল হিসাবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত/প্রাপ্ত নিবন্ধন বাতিল করিয়া দিয়াছে এবং বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ, হাইকোর্ট বিভাগের উক্ত রায়কে বহাল রাখিয়াছে; এবং যেহেতু, সরকারের নিকট যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ রহিয়াছে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং উহার অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সাম্প্রতিককালে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে সরাসরি এবং উসকানির মাধ্যমে জড়িত ছিল; এবংযেহেতু, সরকার বিশ্বাস করে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সকল অঙ্গ সংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সহিত জড়িত রহিয়াছে; সেহেতু, সরকার, সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯ এর ধারা ১৮(১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সকল অঙ্গ সংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করিল এবং উক্ত আইনের তফসিল-২ এ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সকল অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্ত্বা হিসাবে তালিকাভুক্ত করিল।’ ইহা অবিলম্বে কার্যকর হইবে। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে প্রজ্ঞাপনটিতে স্বাক্ষর করেন জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোঃ জাহাংগীর আলম।

সূত্রমতে, দেশের অন্যতম পুরানো একটি দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। সৈয়দ আবুল আলা মওদুদীর হাতে গড়া এ দলটির নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ। ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উসকানির অভিযোগে ১৯৫৯ সালে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান প্রণীত মুসলিম পরিবার আইনের বিরোধিতার কারণে ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর কর্মকাণ্ড আবারো নিষিদ্ধ হয়। দলের প্রধান মওদুদীসহ গ্রেপ্তার করা হয় ৬০ জামায়াত নেতাকে। এদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের যে ১৩ জন জামায়াত নেতা ছিলেন তাদের অন্যতম গোলাম আযম। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে জামায়াতে ইসলামী। দলটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি বাহিনী গড়ে তোলে। দেশ স্বাধীন হলে দলটির প্রধান গোলাম আযম পাকিস্তানে আশ্রয় নেন। অন্যদের কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালান ও বাকিদের দালাল আইনে গ্রেপ্তার হয়। পরবর্তীতে অবশ্য দেশে ফিরে আসেন গোলাম আযম।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৩৮ ধারা অনুযায়ী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়, সেই হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর কর্মকাণ্ডও নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমানের সরকারের সময় সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। রাজনীতি উন্মুক্ত করে রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ ঘোষণা করে সরকার। এ সময় ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (আইডিএল) নামের একটি দলের ছত্রছায়ায় জামায়াতে ইসলামী প্রকাশ্যে কর্মকাণ্ড পরিচালনা শুরু করে। জিয়ার সরকার এসময় গোলাম আযমকে পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরার অনুমতি দেন। ১৯৭৯ সালের মে মাসে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ দেশে পুনরায় আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করে। তবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করার কারণে ব্যাপক সমালোচিত হয় দলটি। তবে নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বসহ বিএনপির সঙ্গে জোট করে রাষ্ট্র ক্ষমতায়ও যায় দলটি। এসময়ে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে দলটির বেশ শক্ত অবস্থান গড়ে ওঠে। একইসঙ্গে প্রথমে ছাত্র সংঘ ও পরে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ চালানো হয়। দেশের বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে জামায়াত-শিবিরের ব্যাপক তৎপরতা দেখা যায়। বিভিন্ন সময়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবেও রাজপথে জামায়াতের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তবে দলটিকে নিষিদ্ধ করার জন্যও দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি তোলা হয়। বিশেষ করে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে এ দাবি জোরদার হয়। একপর্যাায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচারের মাধ্যমে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে। বাতিল হয়ে যায় নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন। ২০১৩ সালের ১ অগাস্ট হাইকোর্ট এক রায়ের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ বলে রায় দেয়। এরপর ২০১৮ সালের ৮ ডিসেম্বর দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেছিল জামায়াতে ইসলামী। ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর সেটি খারিজ করে দেন আদালত। নিবন্ধন বাতিলের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে চরম প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ে জামায়াত। বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জোটগতভাবে রাজনীতি করে আসলেও গত জাতীয় নির্বাচনের আগে সেই জোট ভেঙে যায়। তবে অঘোষিতভাবে বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ততা রেখেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছিল দলটি।

এদিকে বিভিন্ন মহল থেকে জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি চলমান থাকলেও সরকারের পক্ষ থেকে নানা যুক্তি দেখিয়ে এতদিন থেমে ছিল বিষয়টি। তবে সম্প্রতি কোটা সংস্কার ইস্যুতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সম্পৃক্ততা ও ব্যাপক নাশকতার অভিযোগ তুলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এবার দলটিকে নিষিদ্ধের বিষয়ে একমত হয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল। তারই প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্তটি কার্যকর করেছে সরকার।

তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে দলটিকে নিষিদ্ধের দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের পরবর্তী অবস্থান কেমন হবে তা নিয়ে কৌতুল রয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে। নিষিদ্ধের পর অন্য কোন ব্যানারে দলটির কার্যক্রম চালানো হতে পারে বলেও অনেকে মনে করছেন। এরই মধ্যে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে জামায়াত। নিষিদ্ধ হলেও দলটির মূল কার্যক্রম বন্ধ হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে দলটি। একই সঙ্গে বর্তমান ইস্যু থেকে জনগণকে ভিন্ন দিকে ফেরাতে সরকার এই নিষিদ্ধ করছে বলে মন্তব্য করে বিএনপি। তবে নিষিদ্ধের পর এখনও কোন মন্তব্য করেনি দলটি। অবশ্য বিভিন্ন দল থেকে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
অপরদিকে ১৯৭১ এর পূর্বে জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংস্থার নাম ছিল ইসলামী ছাত্রসংঘ। ১৯৭৭ সালে পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে তারা “বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির” নামে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭৭ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে শিবির প্রতিষ্ঠিত হয়।
জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধে ঢাকায় নিরাপত্তা জোরদার: জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের পরে যেকোনো ধরনের সন্ত্রাস-নাশকতা মোকাবিলা করতে প্রস্তুত রয়েছে ঢাকা মহানগর (ডিএমপি) পুলিশ। গতকাল বিকেলে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, যেকোনো ধরনের সন্ত্রাস-নাশকতা মোকাবিলা করতে প্রস্তুত রয়েছে ডিএমপি। ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় পুলিশ নিরাপত্তা জোরদার করেছে।

জনপ্রিয় সংবাদ

সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ জামায়াত-শিবির

আপডেট সময় : ০৭:৫৪:৪৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২ অগাস্ট ২০২৪

◉স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন জারি
◉জামায়াত-শিবিরসহ তাদের সব অঙ্গ সংগঠন এখন নিষিদ্ধ সত্ত্বা
◉নাশকতা মোকাবেলায় প্রস্তুত সরকার-স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী
◉রাজধানীতে নিরাপত্তা জোরদার আইনশৃংখলাবাহিনীর

অবশেষে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলো। সরকারের নির্বাহী আদেশে সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ এর ধারা ১৮(১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির ও তাদের অন্যান্য অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর আগে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে আইনি মতামত দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠায় আইন মন্ত্রণালয়। গতকাল দুপুরে আইনি মতামত দেওয়ার পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, এই দলগুলো নিষিদ্ধ হওয়ার পর তারা আর এই নামে রাজনীতি করতে পারবে না। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে জামায়াত তিন বার নিষিদ্ধ হয়েছিল বলে জানা গেছে।

এদিকে জামায়াত নিষিদ্ধ পরবর্তী যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় নিরাপত্তা জোরদার করেছে আইনশৃংখলাবাহিনী। এছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার ঘটনায় কেউ যদি নাশকতা চালায়, সেটা সরকার মোকাবিলা করবে। সেই সক্ষমতা সরকারের রয়েছে। গতকাল জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারির পর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।

সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় জামায়াত ও এর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের জড়িত থাকার অভিযোগ করে আসছিলেন সরকারের মন্ত্রীরা। এমন পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৯ জুলাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় সভায় জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে একমত হন ওই জোটের শীর্ষ নেতারা। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সেই বৈঠক হয়। জোটের বৈঠকে সিদ্ধান্তের পর এখন সরকারের নির্বাহী আদেশে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করা হলো।

বৃহস্পতিবার সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক শাখা-২ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়-‘যেহেতু, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত আইসিটি-বিডি কেস নম্বর-০৬, ২০১১, আইসিটি-বিডি কেস নম্বর-০২, ২০১২, আইসিটি-বিডি কেস নম্বর-০৩, ২০১২-সহ কয়েকটি মামলার রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (পূর্বনাম জামায়াত-ই- ইসলামী/জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ) এবং উহার অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির (পূর্বনাম ইসলামী ছাত্রসংঘ)-কে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধে দায়ী হিসাবে গণ্য করা হইয়াছে; এবং যেহেতু, বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ রিট পিটিশন নং-৬৩০/২০০৯-এ ০১/০৮/২০১৩ তারিখের প্রদত্ত রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এর রাজনৈতিক দল হিসাবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত/প্রাপ্ত নিবন্ধন বাতিল করিয়া দিয়াছে এবং বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ, হাইকোর্ট বিভাগের উক্ত রায়কে বহাল রাখিয়াছে; এবং যেহেতু, সরকারের নিকট যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ রহিয়াছে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং উহার অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সাম্প্রতিককালে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে সরাসরি এবং উসকানির মাধ্যমে জড়িত ছিল; এবংযেহেতু, সরকার বিশ্বাস করে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সকল অঙ্গ সংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সহিত জড়িত রহিয়াছে; সেহেতু, সরকার, সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯ এর ধারা ১৮(১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সকল অঙ্গ সংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করিল এবং উক্ত আইনের তফসিল-২ এ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সকল অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্ত্বা হিসাবে তালিকাভুক্ত করিল।’ ইহা অবিলম্বে কার্যকর হইবে। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে প্রজ্ঞাপনটিতে স্বাক্ষর করেন জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোঃ জাহাংগীর আলম।

সূত্রমতে, দেশের অন্যতম পুরানো একটি দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। সৈয়দ আবুল আলা মওদুদীর হাতে গড়া এ দলটির নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ। ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উসকানির অভিযোগে ১৯৫৯ সালে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান প্রণীত মুসলিম পরিবার আইনের বিরোধিতার কারণে ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর কর্মকাণ্ড আবারো নিষিদ্ধ হয়। দলের প্রধান মওদুদীসহ গ্রেপ্তার করা হয় ৬০ জামায়াত নেতাকে। এদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের যে ১৩ জন জামায়াত নেতা ছিলেন তাদের অন্যতম গোলাম আযম। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে জামায়াতে ইসলামী। দলটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি বাহিনী গড়ে তোলে। দেশ স্বাধীন হলে দলটির প্রধান গোলাম আযম পাকিস্তানে আশ্রয় নেন। অন্যদের কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালান ও বাকিদের দালাল আইনে গ্রেপ্তার হয়। পরবর্তীতে অবশ্য দেশে ফিরে আসেন গোলাম আযম।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৩৮ ধারা অনুযায়ী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়, সেই হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর কর্মকাণ্ডও নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমানের সরকারের সময় সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। রাজনীতি উন্মুক্ত করে রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ ঘোষণা করে সরকার। এ সময় ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (আইডিএল) নামের একটি দলের ছত্রছায়ায় জামায়াতে ইসলামী প্রকাশ্যে কর্মকাণ্ড পরিচালনা শুরু করে। জিয়ার সরকার এসময় গোলাম আযমকে পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরার অনুমতি দেন। ১৯৭৯ সালের মে মাসে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ দেশে পুনরায় আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করে। তবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করার কারণে ব্যাপক সমালোচিত হয় দলটি। তবে নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বসহ বিএনপির সঙ্গে জোট করে রাষ্ট্র ক্ষমতায়ও যায় দলটি। এসময়ে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে দলটির বেশ শক্ত অবস্থান গড়ে ওঠে। একইসঙ্গে প্রথমে ছাত্র সংঘ ও পরে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ চালানো হয়। দেশের বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে জামায়াত-শিবিরের ব্যাপক তৎপরতা দেখা যায়। বিভিন্ন সময়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবেও রাজপথে জামায়াতের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তবে দলটিকে নিষিদ্ধ করার জন্যও দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি তোলা হয়। বিশেষ করে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে এ দাবি জোরদার হয়। একপর্যাায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচারের মাধ্যমে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে। বাতিল হয়ে যায় নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন। ২০১৩ সালের ১ অগাস্ট হাইকোর্ট এক রায়ের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ বলে রায় দেয়। এরপর ২০১৮ সালের ৮ ডিসেম্বর দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেছিল জামায়াতে ইসলামী। ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর সেটি খারিজ করে দেন আদালত। নিবন্ধন বাতিলের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে চরম প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ে জামায়াত। বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জোটগতভাবে রাজনীতি করে আসলেও গত জাতীয় নির্বাচনের আগে সেই জোট ভেঙে যায়। তবে অঘোষিতভাবে বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ততা রেখেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছিল দলটি।

এদিকে বিভিন্ন মহল থেকে জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি চলমান থাকলেও সরকারের পক্ষ থেকে নানা যুক্তি দেখিয়ে এতদিন থেমে ছিল বিষয়টি। তবে সম্প্রতি কোটা সংস্কার ইস্যুতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সম্পৃক্ততা ও ব্যাপক নাশকতার অভিযোগ তুলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এবার দলটিকে নিষিদ্ধের বিষয়ে একমত হয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল। তারই প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্তটি কার্যকর করেছে সরকার।

তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে দলটিকে নিষিদ্ধের দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের পরবর্তী অবস্থান কেমন হবে তা নিয়ে কৌতুল রয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে। নিষিদ্ধের পর অন্য কোন ব্যানারে দলটির কার্যক্রম চালানো হতে পারে বলেও অনেকে মনে করছেন। এরই মধ্যে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে জামায়াত। নিষিদ্ধ হলেও দলটির মূল কার্যক্রম বন্ধ হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে দলটি। একই সঙ্গে বর্তমান ইস্যু থেকে জনগণকে ভিন্ন দিকে ফেরাতে সরকার এই নিষিদ্ধ করছে বলে মন্তব্য করে বিএনপি। তবে নিষিদ্ধের পর এখনও কোন মন্তব্য করেনি দলটি। অবশ্য বিভিন্ন দল থেকে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
অপরদিকে ১৯৭১ এর পূর্বে জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংস্থার নাম ছিল ইসলামী ছাত্রসংঘ। ১৯৭৭ সালে পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে তারা “বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির” নামে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭৭ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে শিবির প্রতিষ্ঠিত হয়।
জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধে ঢাকায় নিরাপত্তা জোরদার: জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের পরে যেকোনো ধরনের সন্ত্রাস-নাশকতা মোকাবিলা করতে প্রস্তুত রয়েছে ঢাকা মহানগর (ডিএমপি) পুলিশ। গতকাল বিকেলে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, যেকোনো ধরনের সন্ত্রাস-নাশকতা মোকাবিলা করতে প্রস্তুত রয়েছে ডিএমপি। ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় পুলিশ নিরাপত্তা জোরদার করেছে।