০৪:১৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দুর্যোগের বড় ধাক্কা ফসল ও প্রাণিসম্পদে

 

◉সাম্প্রতিক বন্যায় ক্ষতি ২০ হাজার কোটি টাকা
◉ মৎস্য খাতে ক্ষতি ১ হাজার ৫৯০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা
◉ ঘূর্ণিঝড়ের পর বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা নিয়ে শঙ্কায় কৃষক
◉ ছয় লাখ কৃষককে ১৯৩ কোটি টাকার সহায়তা দেবে সরকার

╰┈➤গ্রামীণ অর্থনীতির কৃষি ও অকৃষিজ কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে পড়েছেÑ অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম, কৃষি অর্থনীতিবিদ
╰┈➤সহজ শর্তে খামারিদের ঋণ ও অবকাঠামোগত সহায়তা প্রদান করা হবে- ফরিদা আখতার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা

একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে চরম বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে দেশের কৃষি এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত। লাভের আশায় এসব খাতে শ্রম ও মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করেও বড় ক্ষতির মুখে পড়ছেন অনেকে। কয়েক মাস আগে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় ‘রেমালের’ আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যায় দেশের বহু কৃষকের স্বপ্ন। সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই নতুন করে লেগেছে সাম্প্রতিক বন্যার থাবা। দেশে হঠাৎ করে টানা ভারী বর্ষণের ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে দেশের ২৪টি জেলার কৃষি ব্যাপকভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছে। হঠাৎ ভারতের নদীর বাঁধ খুলে দেয়ায় এ বন্যার কারণ বলে অনেকের অভিমত। এতে আক্রান্ত হয়েছে দেশের ১১টি জেলার ৫৪১টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা। বেশ সংখ্যক মানুষের প্রাণহানিসহ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত। এসব অঞ্চলের বসতবাড়ি, অবকাঠামো ও ব্যবসা-বাণিজ্যেরও ক্ষতি হয়েছে। একদিকে পানি নামলেও, আবার অন্যদিকে বাড়ছে। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আকস্মিক এ বন্যায় মানুষের জনজীবনের পাশাপাশি বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত। হঠাৎ হঠাৎ সৃষ্ট এই পরিস্থিতির কারণে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা নিয়ে চরম শঙ্কায় রয়েছেন কৃষকরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জেলা পর্যায়ে কৃষিবহির্ভূত অন্য খাতে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়। বিশেষ করে ছোট ও ক্ষুদ্র ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, গ্রামীণ অর্থনীতির বিভিন্ন উপখাত এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোর আশপাশের জেলাগুলোও ক্ষতির শিকার হয়েছে। বসতবাড়ি ও অবকাঠামো মিলিয়ে এসব খাতে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। আর কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ক্ষতি ছাড়িয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত বন্যায় দেশের আর্থিক ক্ষতি অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যে বলা হয়েছে, গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা পর্যন্ত বন্যা আক্রান্ত জেলা ১১টি। সেগুলো হলো : ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার। এসব জেলার ৬৮টি উপজেলা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন ও পৌরসভার সংখ্যা ৪৯২। এসব জেলায় মোট ১০ লাখ ৭২ হাজার ৫৭৯টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এছাড়া বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৪ লাখ ৮০ হাজার ৪৬৩ জন। এ পর্যন্ত মারা গেছে ৫২ জন এবং নিখোঁজ রয়েছে ০১ জন (মৌলভীবাজার)। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা গেছে ফেনীতে ১৭ জন, কুমিল্লায় ১৪ জন, নোয়াখালীতে ৮ জন, চট্টগ্রামে ৬ জন, কক্সবাজারে ৩ জন, খাগড়াছড়ি ১ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১ জন, লক্ষ্মীপুর ১ জন এবং মৌলভীবাজারে ১ জন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যে জানা গেছে, গতকাল পর্যন্ত বন্যার্তদের মধ্যে চার কোটি ৫২ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া শুকনা ও অনান্য খাবার দেওয়া হয়েছে ১৫ হাজার প্যাকেট ও বস্তা। ৩৫ লাখ টাকার শিশুখাদ্য এবং ৩৫ লাখ টাকার গোখাদ্য দেওয়া হয়েছে। দুর্গত এলাকায় চালের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২০ হাজার ৬৫০ টন। এ ছাড়া ১১টি জেলায় ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসাসেবা দিতে ৫৯৫টি মেডিক্যাল টিম চালু রয়েছে। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সংগৃহীত মোট ১ লাখ ৪ হাজার ১০০ প্যাকেট খাবার, কাপড় ও পানি বন্যাকবলিত এলাকায় পাঠানো হয়েছে।

কৃষির ক্ষতি কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এবারের বন্যায় ২৪টি জেলার কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব জেলার ১৭ লাখ ৭২ হাজার ৮৮০ হেক্টর জমিতে ফসল আবাদ করা হয়েছিল। এসব ফসলের মধ্যে তিন লাখ ৪৪ হাজার ৬৭৬ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে এসব জেলার অন্তত ২০ শতাংশ ফসলি জমি বন্যায় আক্রান্ত। ক্ষতির শিকার হওয়া আবাদি জমির মধ্যে রয়েছে : আউশ ৭০ হাজার ৬১৯ হেক্টর, আমন দুই লাখ ২০ হাজার ৬৩৪ হেক্টর, বোনা আমন চার হাজার ৩৫১ হেক্টর, রোপা আমন বীজতলা ১৯ হাজার ৭৭৫ হেক্টর। এ ছাড়া শাক-সবজি ১৫ হাজার ৫৬১ হেক্টর, আদা ১৬১ হেক্টর, হলুদ ২৪৬ হেক্টর, আখ ৬৫৭ হেক্টর, পান ৬৪৭ হেক্টর, ফলের বাগান ১১ হাজার ৮০০ হেক্টর, মরিচ ১২৭ হেক্টর, তরমুজ ৫৬ হেক্টর, পেঁপে ২৩ হেক্টর, ভুট্টা তিন হেক্টর, পেয়াঁজ এক হেক্টর ও গ্রীষ্মকালীন টমেটো ১৫ হেক্টর। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত কৃষি খাতে আর্থিক ক্ষতি ছাড়িয়েছে অন্তত তিন হাজার কোটি টাকা।

চলমান বন্যা পরিস্থিতে এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের পরিচালক অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোয় প্রায় সব ধরনের ব্যাবসায়িক এবং ক্ষুদ্র, মাঝারিসহ সব ধরনের উৎপাদনশীল কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে চলমান এই বন্যায় অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর অবস্থায় পড়েছে এসব জেলা। গ্রামীণ অর্থনীতির কৃষি ও অকৃষিজ কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে সরাসরি ক্ষতি ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি হলে প্রকৃত ক্ষতি আরো অনেক বেশি হবে। বন্যার পানি সরে গেলে সব মানুষের জন্য সরাসরি নগদ সহায়তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ওষুধ, কৃষিতে সার ও উপকরণ সহায়তা জোরদার করতে হবে। তাহলে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।

বন্যা পরবর্তী কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে কৃষিসচিব মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, এক সপ্তাহ ধরে চলমান বন্যায় দেশের বিভিন্ন জেলায় কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে মন্ত্রণালয় থেকে পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এরই মধ্যে ১৯৩ কোটি টাকার সহায়তা কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে। এর আওতায় দেশের ছয় লাখ কৃষক প্রণোদনা পাবেন। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় আমন আবাদ ফিরিয়ে আনতে ৩০ আগস্টের আগেই সম্ভাব্য বীজতলা তৈরির সব স্থান নির্বাচন করা হবে, যাতে আমন ধান পরিপূর্ণভাবে ঘরে তোলা যায়। এ ছাড়া আগামী বোরো মৌসুমে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার কৃষকদের সর্বোচ্চ সহযোগিতার মাধ্যমে বাড়তি শস্য ও বিকল্প সব ধরনের শস্য আবাদে জোর দেওয়া হবে, যাতে কোনো ধরনের খাদ্যঘাটতি না হয়।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ক্ষতি আকস্মিক বন্যায় মৎস্য খাতে ১২টি জেলার ৮৬টি উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় জান-মালের ক্ষতিসহ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এক লাখ ৮০ হাজার ৮৯৯টি পুকুর/দিঘি ও মৎস্য খামার। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত মাছ ও চিংড়ির পরিমাণ ৯০ হাজার ৭৬৮ টন। মাছের পোনা ও চিংড়ির পোস্ট লার্ভা ক্ষতির শিকার হয়েছে তিন হাজার ৭৪৬ লাখ। ফলে মৎস্য খাতে মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার ৫৯০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।

এদিকে বন্যার কারণে অনেক গবাদি পশুর মৃত্যু, ভেসে যাওয়াসহ অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির খাদ্য এবং অন্যান্য পশুখাদ্য বিনষ্ট হয়েছে। ডিম, দুধ ও অনান্য খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ফলে পশুসম্পদ খাতে আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ ৪১১ কোটি টাকা। গত ২৫ আগস্ট পর্যন্ত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে মোট ক্ষতি ছাড়িয়েছে অন্তত দুই হাজার কোটি টাকা।

ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এরই মধ্যে কার্যকর নানা পদক্ষেপ ঘোষণা করেছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। সম্প্রতি তিনি জানিয়েছেন, জরুরি পশুখাদ্য সরবরাহ ও বিতরণ; গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির রোগপ্রতিরোধে টিকা প্রদান এবং ঘাসের কাটিং বিতরণ করা হবে। একইভাবে মৎস্য খাতেও চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনা বিভাগে ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্য চাষিদের জন্য পুনর্বাসন কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। সহজ শর্তে খামারিদের ঋণ দেওয়া হবে। মৎস্য খামারগুলো সুরক্ষিত করতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সহায়তা প্রদান করা হবে।

এর আগে গত ২৬ মে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় রিমাল আঘাত হানে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় বেশকিছু এলাকায় জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়। যার ফলে এসব এলাকা পানিতে নিমজ্জিত হয়। এছাড়াও ১৮ জনের প্রাণহানি ঘটে। বেশকিছু রাস্তাঘাট, বেড়িবাঁধ, ঘরবাড়ি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে ২০টি জেলার খসড়া হিসাবে ৬ হাজার ৮৮০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।

 

জনপ্রিয় সংবাদ

দুর্যোগের বড় ধাক্কা ফসল ও প্রাণিসম্পদে

আপডেট সময় : ০৭:১৫:৩০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৩০ অগাস্ট ২০২৪

 

◉সাম্প্রতিক বন্যায় ক্ষতি ২০ হাজার কোটি টাকা
◉ মৎস্য খাতে ক্ষতি ১ হাজার ৫৯০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা
◉ ঘূর্ণিঝড়ের পর বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা নিয়ে শঙ্কায় কৃষক
◉ ছয় লাখ কৃষককে ১৯৩ কোটি টাকার সহায়তা দেবে সরকার

╰┈➤গ্রামীণ অর্থনীতির কৃষি ও অকৃষিজ কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে পড়েছেÑ অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম, কৃষি অর্থনীতিবিদ
╰┈➤সহজ শর্তে খামারিদের ঋণ ও অবকাঠামোগত সহায়তা প্রদান করা হবে- ফরিদা আখতার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা

একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে চরম বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে দেশের কৃষি এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত। লাভের আশায় এসব খাতে শ্রম ও মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করেও বড় ক্ষতির মুখে পড়ছেন অনেকে। কয়েক মাস আগে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় ‘রেমালের’ আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যায় দেশের বহু কৃষকের স্বপ্ন। সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই নতুন করে লেগেছে সাম্প্রতিক বন্যার থাবা। দেশে হঠাৎ করে টানা ভারী বর্ষণের ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে দেশের ২৪টি জেলার কৃষি ব্যাপকভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছে। হঠাৎ ভারতের নদীর বাঁধ খুলে দেয়ায় এ বন্যার কারণ বলে অনেকের অভিমত। এতে আক্রান্ত হয়েছে দেশের ১১টি জেলার ৫৪১টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা। বেশ সংখ্যক মানুষের প্রাণহানিসহ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত। এসব অঞ্চলের বসতবাড়ি, অবকাঠামো ও ব্যবসা-বাণিজ্যেরও ক্ষতি হয়েছে। একদিকে পানি নামলেও, আবার অন্যদিকে বাড়ছে। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আকস্মিক এ বন্যায় মানুষের জনজীবনের পাশাপাশি বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত। হঠাৎ হঠাৎ সৃষ্ট এই পরিস্থিতির কারণে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা নিয়ে চরম শঙ্কায় রয়েছেন কৃষকরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জেলা পর্যায়ে কৃষিবহির্ভূত অন্য খাতে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়। বিশেষ করে ছোট ও ক্ষুদ্র ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, গ্রামীণ অর্থনীতির বিভিন্ন উপখাত এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোর আশপাশের জেলাগুলোও ক্ষতির শিকার হয়েছে। বসতবাড়ি ও অবকাঠামো মিলিয়ে এসব খাতে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। আর কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ক্ষতি ছাড়িয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত বন্যায় দেশের আর্থিক ক্ষতি অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যে বলা হয়েছে, গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা পর্যন্ত বন্যা আক্রান্ত জেলা ১১টি। সেগুলো হলো : ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার। এসব জেলার ৬৮টি উপজেলা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন ও পৌরসভার সংখ্যা ৪৯২। এসব জেলায় মোট ১০ লাখ ৭২ হাজার ৫৭৯টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এছাড়া বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৪ লাখ ৮০ হাজার ৪৬৩ জন। এ পর্যন্ত মারা গেছে ৫২ জন এবং নিখোঁজ রয়েছে ০১ জন (মৌলভীবাজার)। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা গেছে ফেনীতে ১৭ জন, কুমিল্লায় ১৪ জন, নোয়াখালীতে ৮ জন, চট্টগ্রামে ৬ জন, কক্সবাজারে ৩ জন, খাগড়াছড়ি ১ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১ জন, লক্ষ্মীপুর ১ জন এবং মৌলভীবাজারে ১ জন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যে জানা গেছে, গতকাল পর্যন্ত বন্যার্তদের মধ্যে চার কোটি ৫২ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া শুকনা ও অনান্য খাবার দেওয়া হয়েছে ১৫ হাজার প্যাকেট ও বস্তা। ৩৫ লাখ টাকার শিশুখাদ্য এবং ৩৫ লাখ টাকার গোখাদ্য দেওয়া হয়েছে। দুর্গত এলাকায় চালের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২০ হাজার ৬৫০ টন। এ ছাড়া ১১টি জেলায় ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসাসেবা দিতে ৫৯৫টি মেডিক্যাল টিম চালু রয়েছে। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সংগৃহীত মোট ১ লাখ ৪ হাজার ১০০ প্যাকেট খাবার, কাপড় ও পানি বন্যাকবলিত এলাকায় পাঠানো হয়েছে।

কৃষির ক্ষতি কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এবারের বন্যায় ২৪টি জেলার কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব জেলার ১৭ লাখ ৭২ হাজার ৮৮০ হেক্টর জমিতে ফসল আবাদ করা হয়েছিল। এসব ফসলের মধ্যে তিন লাখ ৪৪ হাজার ৬৭৬ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে এসব জেলার অন্তত ২০ শতাংশ ফসলি জমি বন্যায় আক্রান্ত। ক্ষতির শিকার হওয়া আবাদি জমির মধ্যে রয়েছে : আউশ ৭০ হাজার ৬১৯ হেক্টর, আমন দুই লাখ ২০ হাজার ৬৩৪ হেক্টর, বোনা আমন চার হাজার ৩৫১ হেক্টর, রোপা আমন বীজতলা ১৯ হাজার ৭৭৫ হেক্টর। এ ছাড়া শাক-সবজি ১৫ হাজার ৫৬১ হেক্টর, আদা ১৬১ হেক্টর, হলুদ ২৪৬ হেক্টর, আখ ৬৫৭ হেক্টর, পান ৬৪৭ হেক্টর, ফলের বাগান ১১ হাজার ৮০০ হেক্টর, মরিচ ১২৭ হেক্টর, তরমুজ ৫৬ হেক্টর, পেঁপে ২৩ হেক্টর, ভুট্টা তিন হেক্টর, পেয়াঁজ এক হেক্টর ও গ্রীষ্মকালীন টমেটো ১৫ হেক্টর। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত কৃষি খাতে আর্থিক ক্ষতি ছাড়িয়েছে অন্তত তিন হাজার কোটি টাকা।

চলমান বন্যা পরিস্থিতে এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের পরিচালক অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোয় প্রায় সব ধরনের ব্যাবসায়িক এবং ক্ষুদ্র, মাঝারিসহ সব ধরনের উৎপাদনশীল কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে চলমান এই বন্যায় অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর অবস্থায় পড়েছে এসব জেলা। গ্রামীণ অর্থনীতির কৃষি ও অকৃষিজ কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে সরাসরি ক্ষতি ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি হলে প্রকৃত ক্ষতি আরো অনেক বেশি হবে। বন্যার পানি সরে গেলে সব মানুষের জন্য সরাসরি নগদ সহায়তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ওষুধ, কৃষিতে সার ও উপকরণ সহায়তা জোরদার করতে হবে। তাহলে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।

বন্যা পরবর্তী কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে কৃষিসচিব মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, এক সপ্তাহ ধরে চলমান বন্যায় দেশের বিভিন্ন জেলায় কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে মন্ত্রণালয় থেকে পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এরই মধ্যে ১৯৩ কোটি টাকার সহায়তা কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে। এর আওতায় দেশের ছয় লাখ কৃষক প্রণোদনা পাবেন। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় আমন আবাদ ফিরিয়ে আনতে ৩০ আগস্টের আগেই সম্ভাব্য বীজতলা তৈরির সব স্থান নির্বাচন করা হবে, যাতে আমন ধান পরিপূর্ণভাবে ঘরে তোলা যায়। এ ছাড়া আগামী বোরো মৌসুমে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার কৃষকদের সর্বোচ্চ সহযোগিতার মাধ্যমে বাড়তি শস্য ও বিকল্প সব ধরনের শস্য আবাদে জোর দেওয়া হবে, যাতে কোনো ধরনের খাদ্যঘাটতি না হয়।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ক্ষতি আকস্মিক বন্যায় মৎস্য খাতে ১২টি জেলার ৮৬টি উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় জান-মালের ক্ষতিসহ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এক লাখ ৮০ হাজার ৮৯৯টি পুকুর/দিঘি ও মৎস্য খামার। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত মাছ ও চিংড়ির পরিমাণ ৯০ হাজার ৭৬৮ টন। মাছের পোনা ও চিংড়ির পোস্ট লার্ভা ক্ষতির শিকার হয়েছে তিন হাজার ৭৪৬ লাখ। ফলে মৎস্য খাতে মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার ৫৯০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।

এদিকে বন্যার কারণে অনেক গবাদি পশুর মৃত্যু, ভেসে যাওয়াসহ অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির খাদ্য এবং অন্যান্য পশুখাদ্য বিনষ্ট হয়েছে। ডিম, দুধ ও অনান্য খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ফলে পশুসম্পদ খাতে আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ ৪১১ কোটি টাকা। গত ২৫ আগস্ট পর্যন্ত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে মোট ক্ষতি ছাড়িয়েছে অন্তত দুই হাজার কোটি টাকা।

ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এরই মধ্যে কার্যকর নানা পদক্ষেপ ঘোষণা করেছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। সম্প্রতি তিনি জানিয়েছেন, জরুরি পশুখাদ্য সরবরাহ ও বিতরণ; গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির রোগপ্রতিরোধে টিকা প্রদান এবং ঘাসের কাটিং বিতরণ করা হবে। একইভাবে মৎস্য খাতেও চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনা বিভাগে ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্য চাষিদের জন্য পুনর্বাসন কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। সহজ শর্তে খামারিদের ঋণ দেওয়া হবে। মৎস্য খামারগুলো সুরক্ষিত করতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সহায়তা প্রদান করা হবে।

এর আগে গত ২৬ মে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় রিমাল আঘাত হানে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় বেশকিছু এলাকায় জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়। যার ফলে এসব এলাকা পানিতে নিমজ্জিত হয়। এছাড়াও ১৮ জনের প্রাণহানি ঘটে। বেশকিছু রাস্তাঘাট, বেড়িবাঁধ, ঘরবাড়ি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে ২০টি জেলার খসড়া হিসাবে ৬ হাজার ৮৮০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।