মানুষ বাঁচে আশায় কিন্তু যার আশাই নেই তার বেঁচে থেকে লাভ কি? এরপরেও বেঁচে থাকতে হয় পরিবার পরিজনদের বাঁচাতে। এরকম এক নারী কোহিনূর বেগমের বেঁচে থাকার গল্প।
জামালপুর পৌরসভা বাংলাদেশের প্রচীন শহরগুলির একটি। বক্ষ্রপুত্র নদের তীরে গড়ে উঠা এই শহরে কাক ডাকা ভোরে অনেকেরই ঘুম ভাঙ্গে অনেক স্বপ্ন নিয়ে। কোহিনূর বেগম তেমনি একজন যে কাক ডাকা ভোরে শহরের ফৌজদারি মোড়ে আসে বেঁচে থাকার স্বপ্ন নিয়ে। বাসা কাছেই দেওয়ানপাড়ায়। জীবনের অনেক কষ্টের কথা জানালেন এই কোহিনূর বেগম।
ফৌজদারি মোড়ের বাজারের সাথে ফুটপাতে বসে বিক্রি করেন হাঁসের ডিম, দেশি মুরগির ডিম ও কলা। এগুলিই তার পণ্য। সর্বসাকুল্যে আট থেকে দশ হাজার টাকার মাল রয়েছে তার কাছে। এগুলি সে মহাজনের কাছ থেকে বাকী নিয়ে আসে এবং বিক্রি শেষে টাকা পরিশোধ করেন।
তিনি বলেন, সকাল ৬টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত হাঁসের ডিম, দেশি মুরগির ডিম ও কলা বিক্রি করে কামাই হয় চার থেকে পাঁচশ টাকা মাত্র। শহরে দেশি ডিম ও কলার খুব চাহিদা রয়েছে তাই এগুলিই তিনি পণ্য হিসেবে বেঁচেন। শহরের গেইটপাড়ের এক মহাজনের কাছ থেকে এগুলি বাকী নিয়ে আসেন তিনি। এভাবেই ফৌজদারি মোড়ের ফুটপাতে জমে উঠেছে কোহিনূর বেগমের ব্যবসা। দেশিয় পণ্য বিক্রির জন্য তার খ্যাতি রয়েছে এমনটাই তিনি জানান। হাঁসের বা দেশি মুরগির ডিমের জন্য মানুষজন তার কাছেই ছুটে আসে।
কোহিনূর জানান, এই ব্যবসার পূর্বে ফৌজদারি মোড়ে তার চা’য়ের দোকান ছিল। কিন্তু শরীর অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর তিনি আর ভারী কাজ এবং আগুনের তাপে থাকতে পারেন না। ডাক্তারও নিষেধ করেছেন। তাই চা বিক্রির ব্যবসা বাদ দিয়ে এই ব্যবসা শুরু করেছেন।
কি অসুখ হয়েছে জিঙ্গেস করতেই বলেন, ডাক্তার বলছে হার্ট ছিদ্র হইয়া গেছে। হার্টে রিং বসাতে হবে। কোন কিছু খাইতে ইচ্ছা করে না। শরীর খুব দুর্বল লাগে। বুকের ভিতরে কুটকুট কইরা কামড়ায়। শুধু সংসার এবং ছেলে মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে ক্ষুদ্রভাবে কিছু মাল নিয়ে ফুটপাতে বসে বিক্রি করে যা কামাই হয় এদিয়েই সংসার চলে। স্বামী কিছুই করে না, নেশা করে আর আমারে গালিগালাজ করে। দুই ছেলে এক মেয়ের সংসার কোহিনূরের। বড় ছেলে বিয়ে করে বউকে নিয়ে আলাদা হইয়া গেছে। আমাদের দেখে না, খোঁজখবরও নেয় না এবং সম্পর্কও খুব একটা ভাল না বড় ছেলের সাথে।
তিনি বলেন, ভোর সাড়ে পাঁচটায় ফৌজদারি মোড়ের ফুটপাতে এসে তার ব্যবসার পঁসরা সাজিয়ে বসেন। এত সকালে কেন আসেন জিজ্ঞেস করতেই বলেন ভোরে না আসলে জায়গাটি তার দখলে নেওয়া সম্ভব হবে না। এছাড়া ফৌজদারি মোড়ের এই বাজারটি খুব সকালে বসে। বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্ষুদ্র কৃষক বা ব্যবসায়ীরা তাদের ফলানো ফসল নিয়ে হাজির হয় এই বাজারে। সকাল দশটা থেকে এগারটার মধ্যে বাজার শেষ হয়ে যায়।
তারপরেও কোহিনূর বেগম রাত ১২টা পর্যন্ত তার পণ্য নিয়ে বসে থাকে বিক্রির আশায়। সকালে বিক্রি ভাল হলেও দুপুরে বিক্রির পরিমান কমে আসে। দুপুরে একটু বিশ্রামের জন্য বসায় যান না কারন হিসেবে বলেন বাসায় অশান্তি গিয়ে লাভ কি। ফুটপাতেই ভাল থাকি বিক্রি হয়, মানুষজনের সাথে কথা বলি মনটা হালকা হয়। শুধু সংসার আর ছেলে-মেয়েদের কথা চিন্তা করে আমি অসুস্থ শরীর নিয়ে এই ব্যবসা করি। এই ব্যবসা করা ছাড়া আমার আর কোন উপায় নাই।
এই ক্ষুদ্র ব্যবসা করেই কোহিনূর তার সংসার চালান, এনজিও থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করছেন। কত টাকা ঋণ নিয়েছেন জিজ্ঞেস কতেই বলেন ৪০ হাজার টাকার মতো হবে। প্রতিদিন কিস্তি দেই। আর কয়েকটা কিস্তি দিলেই ঋণ শেষ হইয়া যাইবো। শেষ হওয়ার পরে আবার ঋণ নিবেন বলেন জানান তিনি।
কোহিনূর বেগমকে ডাক্তার হার্টে রিং পড়ানোর কথা বলেছেন। এতে টাকা লাগবে তিন লাখ। তিনি বলেন এত টাকা পাবো কোথায়? রাত বারটা পর্যন্ত বিক্রি করে যা কামাই হয় তাই দিয়ে তো সংসারই চলে না। তার মধ্যে আবার প্রতিদিন এনজিও’র কিস্তি দিতে হয়। শরীরডা ভালো থাকলে আর চিন্তা করতাম না। কত পরিশ্রম করছি আমি। একসময় স্বামীকে নিয়ে ঢাকায় থাকতাম গার্মেন্টসে চাকরি করছি।
এত রোগবালাই ও দুঃখ-কষ্ট নিয়েও কোহিনূর বেগম জীবনযুদ্ধে হেরে যেতে চান না। এভাবেই চলছে তার জীবন। হয়তো চলেও যাবে। মানুষের কাছে হাত পাততে চান না তিনি। কষ্ট করে পরিশ্রম করেই চলেছে তার জীবন। এই জীবন সংসারে কোহিনূরা মরে না বেঁচে থাকে মানুষের মাঝে উদাহরণ হয়ে।


























