০১:৫৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পাঠ্যবই আসার আগেই সিন্ডিকেটের হাতে পাণ্ডুলিপি

#ছাপার সময়ই এনিসিটিবির বইয়ের পাণ্ডুলিপি চলে যায় গাইড সিন্ডিকেটের হাতে
#শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই হাতে পাওয়ার আগেই বাজারে আসছে গাইড বই
#আইনের তোয়াক্কা না করেই চলছে গাইড ব্যবসা
#চক্রে আছে এনসিটিবির কর্মকর্তাসহ অনেক সরকারি কর্মকর্তা

প্রতিবার নতুন বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন পাঠ্যবই তুলে দেওয়ার জন্য কাজ করে সরকার। সেজন্য আগেভাগেই বই ছাপানোর কাজও শুরু করে দেয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। শিক্ষার্থীদের হাতে বছরের প্রথম দিনে নতুন বই তুলে দিতে কাজও শুরু করেছিল এনসিটিবি। তবে সময় স্বল্পতার কারণে বই ছাপানোর কাজ শেষ না হওয়ায় এবার বই উৎসব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা। তবে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই হাতে পাওয়ার আগেই এনসিটিবির সরবরাহ করা পাণ্ডুলিপি ফাঁস হয়ে চলে গেছে নিষিদ্ধ নোট-গাইড সিন্ডিকেটের হাতে। নিষেধাজ্ঞা থাকলেও শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই হাতে পাওয়ার আগেই নিষিদ্ধ গাইড বই আসছে বাজারে। এই চক্রে আছেন এনসিটিবির বেশ কিছু কর্মকর্তাসহ পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ পাওয়া কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। আইনের তোয়াক্কা না করেই এই ব্যবসা চললেও তা দমনে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই এনসিটিবির।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি বছর পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর জন্য কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে পাঠ্যবইয়ের পাণ্ডুলিপির সিডির কপি সরবরাহ করে থাকে এনসিটিবি। পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ পাওয়া কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের গাইড বইয়ের ব্যবসা থাকায় তারা সরবরাহকৃত পাণ্ডুলিপি ব্যবহার করে ছাপাখানায় পাঠ্যবই ছাপানোর পাশাপাশি নিষিদ্ধ নোট গাইডও ছাপাচ্ছেন। এছাড়াও গত ১৩ বছর ধরে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সম্পাদনা শাখা থেকে পাঠ্যবইয়ের পাণ্ডুলিপি, নম্বর বণ্টন ও সিলেবাসের আগাম তথ্য নোট-গাইড প্রকাশকদের কাছে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে হস্তান্তর করা হচ্ছে। যারা পাঠ্যবই ছাপার ঠিকাদারি পায়, তাদের মধ্যে বড় ঠিকাদারদের নোট-গাইড কোম্পানি রয়েছে। আগাম তথ্য সংগ্রহ করে নোট-গাইড লিখে ও প্রকাশ এবং বাজারজাত করে প্রতি বছর হাজার কোটি টাকার বেশি বাণিজ্য করছে কয়েকটি কোম্পানি।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, যারা পাঠ্যবই ছাপার ঠিকাদারি পেয়েছেন, তাদের মধ্যে বেশ কিছু বড় বড় ঠিকাদারের নোট-গাইড কোম্পানিও রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কয়েকটি প্রেসে একই সঙ্গে বৈধ ও অবৈধ বই ছাপানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে মাধ্যমিকের বিভিন্ন ক্লাসের একাধিক গাইড ও নোট বই বাজারে চলেও এসেছে। বাকি ক্লাসের নোট-গাইড ছাপানোর কাজও পুরোদমে চলছে। বিগত তিন বছর নতুন কারিকুলামে তেমন নোট গাইডের ব্যবসা না হওয়ায় এবার বড় টার্গেট নিয়ে নেমেছে এই সিন্ডিকেট।

এদিকে মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নিয়েও পাঠ্যবইয়ের পাণ্ডুলিপি ফাঁস করে নোট-গাইড ছাপানোর সত্যতা মিলেছে। বিভিন্ন ছাপাখানার শ্রমিক এবং বই বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এনসিটিবি কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে পাণ্ডুলিপি সরবরাহের পরপরই তা ফাঁস হয়ে যায়। যেসব প্রতিষ্ঠানের নিজেদের নোট-গাইডের ব্যবসা আছে তারা নিজেরাই তা ব্যবহার করে নোট গাইড ছাপানোর কাজ করছেন। এর বাইরেও অনেক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন নোট গাইড প্রকাশ করা কোম্পানির কাছে পাণ্ডুলিপি তুলে দেয়। তা ব্যবহার করে আগেভাগেই নোট গাইড ছাপানোর কাজ করে তারা। তারা বলছেন, ইতোমধ্যেই অনেক শ্রেণির নোট-গাইড ছাপানোর কাজ চলছে। মাধ্যমিকের কয়েকটি গাইড বাজারেও এসেছে। বাকি ক্লাসের নোট গাইড জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই বাজারে আসবে বলে জানিয়েছেন তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ছাপাখানায় কাজ করা শ্রমিক বলেন, আমাদের ছাপাখানায় কয়েকদিন আগে থেকেই নোট গাইড ছাপানোর কাজ শুরু হয়েছে। অনেক ক্লাসের নোট-গাইডই প্রস্তুত হচ্ছে। খুব দ্রুতই এগুলো বাজারে আসবে। পাণ্ডুলিপি আগে না পেলে তো আর এতো দ্রুত কাজ শুরু করা যেতো না।
বাংলাবাজারের এক বই বিক্রেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কয়েকটি দোকানে ইতোমধ্যেই কিছু বই এসেছে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সকল ক্লাসের গাইড বই বাজারে আসবে বলে জানানো হয়েছে। আপনারা ৫ জানুয়ারির দিকে আসলেই দোকানে বই পাবেন।

এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি এনসিটিবির কর্মকর্তারা দুটি ছাপাখানা পরিদর্শনে গিয়ে নোট-গাইড বই ছাপানোর বিষয়টি হাতেনাতে ধরেছেন। এই কাজ না করতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সতর্কও করে দিয়েছে এনসিটিবি। দোষীদের দ্রুত চিহ্নিত করতে ইতোমধ্যে একাধিক কমিটিও গঠন করা হয়েছে বলে এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ বি এম রিয়াজুল হাসান সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, অসৎ কাজের জড়িতদের দ্রুত চিহ্নিত করতে ইতিমধ্যে একাধিক কমিটি গঠন করেছে এনসিটিবি। তারা তদন্ত করেে কটি রিপোর্ট আমাদের দিবেন।
এদিকে এনসিটিবি সূত্রে আরো জানা গেছে, এনসিটিবির বেশ কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে এই সিন্ডিকেট বছরের পর বছর ধরে এই অপকর্ম করে আছে। তাদের সহায়তায় এই সিন্ডিকেট এবার আরো বেশি সক্রিয় হয়েছে বলে জানিয়েছে এই সূত্র। প্রকাশ্যেই এই নিষিদ্ধ নোট গাইডের ব্যবসা চললেও তাদের প্রভাবে এর বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলেও দাবি করেছে এই সূত্র। নোট-গাইড কোম্পানিতে গোপনে মাসিক বেতনে বিসিএস সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাচাকরি করছেন বলেও জানা গেছে। এর বিনিময়ে তাদেরকে বিভিন্ন সুবিধাও দিয়ে থাকে এই সিন্ডিকেট। জানা গেছে, নোট-গাইড কোম্পানিগুলোর মালিকদের টার্গেট প্রেষণে অথবা বদলিভিত্তিক পদায়ন পাওয়া জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর এবং মাদ্রাসা ও ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তারা। এছাড়া শিক্ষা ক্যাডারদের শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে তদবির করে পদায়ন পাইয়ে দিতেও ভূমিকা রাখতে পারেন কোনো কোনো নোট-গাইড কোম্পানির মালিক। এসব সুবিধার লোভে পড়েই এই সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়ছেন তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনসিটিবির এক কর্মকর্তা বলেন, এনসিটিবির অনেক কর্মকর্তাসহ বড় একটা সিন্ডিকেট এখানে কাজ করছে, এনসিটিবির সহায়তা ছাড়া প্রকাশ্যে এসব করা সম্ভব হতো না। এই সিন্ডিকেটের প্রভাবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয় না।
এদিকে ছাপাখানার মালিক ও এনসিটিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে নভেম্বর ও ডিসেম্বর সহায়ক বইয়ের নামে বিক্রি হওয়া ‘নিষিদ্ধ নোট-গাইড’ বইয়ের মুদ্রণ ও বাজারজাতকরণ বন্ধ রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির কাছে অনুরোধ করা হয়েছিল। একই সঙ্গে খোলাবাজারে এই ধরনের নিষিদ্ধ বইয়ের বিক্রি ঠেকাতে জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপারদের চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেসবই ছিল লোক দেখানো। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সম্প্রতি পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানর আগ পর্যন্ত নোট গাইড ছাপাতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তবেও এতেও থেমে নেই এই চক্র। কঠোর নজরদারি না করা হলে তা থামানো যাবেনা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির এক সাবেক সহ সভাপতি বলেন, ডিসেম্বর মাসের জন্য নিষিদ্ধ নোট-গাইড বই ছাপা বন্ধে কঠোর নজরদারি করা উচিত। তা না হলে কোন কাজ হবেনা। এই চক্র আগেই পাণ্ডুলিপি পেয়ে গেছে। তারা থামবেনা। এতে অনেক সমস্যাও হচ্ছে। কারণ তারা চড়ামূল্যে কাগজ কিনে মিলগুলোকে ব্যস্ত রাখছেন। এজন্য ন্যায্যমূল্যে আমাদের কাগজ দিতে গড়িমসি করছে মিলগুলো। এতে সরকারি পাঠ্যপুস্তক ছাপাতে সমস্যায় পড়ছে কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো।
অন্যদিকে পাঠ্যবই ছাপানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সবাই নোট, গাইড বই তৈরিতে জড়িত নয় বলে দাবি করেছেন মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা। তাদের দাবি যাদের নোট গাইডের ব্যবসা রয়েছে তারা এই কাজ করে থাকতে পারে। কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো প্রিন্টিংয়ের কাজ করায় তারা নোট গাইড ছাপাচ্ছে না বলেও দাবি করেছেন তারা।
মুদ্রণ শিল্প সমিতির ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. আনোয়ার হোসাইন বলেন, যাদের নোট-গাইড ব্যবসা আছে তারা এমন কাজ করতে পারে, তবে যারা শুধু প্রিন্টিংয়ের কাজ করে তারা এমনটি করে না।

এবিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান এনসিটিবির শিক্ষাক্রম উইংয়ের সদস্য অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী বলেন, পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো হাতে পাওয়া পাণ্ডুলিপির সিডি ব্যবহার করে নোট-গাইড ছাপানোর কাজ শুরু করতে পারে। চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা সিডিতে বইয়ের সফট কপি দিচ্ছি। সেনাবাহিনীকেও সিডি দেওয়া হয়েছে। প্রিন্টার্সদের মধ্যে কেউ যদি তা ফাঁস করে দেন বা নিজেরাই নোট-গাইড ছাপানোর কাজ শুরু করেন সেক্ষেত্রে আমরা কী করব?

নোট-গাইড বন্ধে এনসিটিবি কোনো উদ্যোগ নেবে কি না জানতে চাইলে এনসিটিবির শিক্ষাক্রম উইংয়ের এই সদস্য বলেন, কিছু নিষিদ্ধ হলে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে নির্বাহী বিভাগ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আমাদের এ বিষয়ে করার তেমন কিছু নেই।

জনপ্রিয় সংবাদ

পাঠ্যবই আসার আগেই সিন্ডিকেটের হাতে পাণ্ডুলিপি

আপডেট সময় : ০৭:৫৭:৩৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪

#ছাপার সময়ই এনিসিটিবির বইয়ের পাণ্ডুলিপি চলে যায় গাইড সিন্ডিকেটের হাতে
#শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই হাতে পাওয়ার আগেই বাজারে আসছে গাইড বই
#আইনের তোয়াক্কা না করেই চলছে গাইড ব্যবসা
#চক্রে আছে এনসিটিবির কর্মকর্তাসহ অনেক সরকারি কর্মকর্তা

প্রতিবার নতুন বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন পাঠ্যবই তুলে দেওয়ার জন্য কাজ করে সরকার। সেজন্য আগেভাগেই বই ছাপানোর কাজও শুরু করে দেয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। শিক্ষার্থীদের হাতে বছরের প্রথম দিনে নতুন বই তুলে দিতে কাজও শুরু করেছিল এনসিটিবি। তবে সময় স্বল্পতার কারণে বই ছাপানোর কাজ শেষ না হওয়ায় এবার বই উৎসব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা। তবে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই হাতে পাওয়ার আগেই এনসিটিবির সরবরাহ করা পাণ্ডুলিপি ফাঁস হয়ে চলে গেছে নিষিদ্ধ নোট-গাইড সিন্ডিকেটের হাতে। নিষেধাজ্ঞা থাকলেও শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই হাতে পাওয়ার আগেই নিষিদ্ধ গাইড বই আসছে বাজারে। এই চক্রে আছেন এনসিটিবির বেশ কিছু কর্মকর্তাসহ পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ পাওয়া কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। আইনের তোয়াক্কা না করেই এই ব্যবসা চললেও তা দমনে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই এনসিটিবির।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি বছর পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর জন্য কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে পাঠ্যবইয়ের পাণ্ডুলিপির সিডির কপি সরবরাহ করে থাকে এনসিটিবি। পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ পাওয়া কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের গাইড বইয়ের ব্যবসা থাকায় তারা সরবরাহকৃত পাণ্ডুলিপি ব্যবহার করে ছাপাখানায় পাঠ্যবই ছাপানোর পাশাপাশি নিষিদ্ধ নোট গাইডও ছাপাচ্ছেন। এছাড়াও গত ১৩ বছর ধরে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সম্পাদনা শাখা থেকে পাঠ্যবইয়ের পাণ্ডুলিপি, নম্বর বণ্টন ও সিলেবাসের আগাম তথ্য নোট-গাইড প্রকাশকদের কাছে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে হস্তান্তর করা হচ্ছে। যারা পাঠ্যবই ছাপার ঠিকাদারি পায়, তাদের মধ্যে বড় ঠিকাদারদের নোট-গাইড কোম্পানি রয়েছে। আগাম তথ্য সংগ্রহ করে নোট-গাইড লিখে ও প্রকাশ এবং বাজারজাত করে প্রতি বছর হাজার কোটি টাকার বেশি বাণিজ্য করছে কয়েকটি কোম্পানি।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, যারা পাঠ্যবই ছাপার ঠিকাদারি পেয়েছেন, তাদের মধ্যে বেশ কিছু বড় বড় ঠিকাদারের নোট-গাইড কোম্পানিও রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কয়েকটি প্রেসে একই সঙ্গে বৈধ ও অবৈধ বই ছাপানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে মাধ্যমিকের বিভিন্ন ক্লাসের একাধিক গাইড ও নোট বই বাজারে চলেও এসেছে। বাকি ক্লাসের নোট-গাইড ছাপানোর কাজও পুরোদমে চলছে। বিগত তিন বছর নতুন কারিকুলামে তেমন নোট গাইডের ব্যবসা না হওয়ায় এবার বড় টার্গেট নিয়ে নেমেছে এই সিন্ডিকেট।

এদিকে মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নিয়েও পাঠ্যবইয়ের পাণ্ডুলিপি ফাঁস করে নোট-গাইড ছাপানোর সত্যতা মিলেছে। বিভিন্ন ছাপাখানার শ্রমিক এবং বই বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এনসিটিবি কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে পাণ্ডুলিপি সরবরাহের পরপরই তা ফাঁস হয়ে যায়। যেসব প্রতিষ্ঠানের নিজেদের নোট-গাইডের ব্যবসা আছে তারা নিজেরাই তা ব্যবহার করে নোট গাইড ছাপানোর কাজ করছেন। এর বাইরেও অনেক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন নোট গাইড প্রকাশ করা কোম্পানির কাছে পাণ্ডুলিপি তুলে দেয়। তা ব্যবহার করে আগেভাগেই নোট গাইড ছাপানোর কাজ করে তারা। তারা বলছেন, ইতোমধ্যেই অনেক শ্রেণির নোট-গাইড ছাপানোর কাজ চলছে। মাধ্যমিকের কয়েকটি গাইড বাজারেও এসেছে। বাকি ক্লাসের নোট গাইড জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই বাজারে আসবে বলে জানিয়েছেন তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ছাপাখানায় কাজ করা শ্রমিক বলেন, আমাদের ছাপাখানায় কয়েকদিন আগে থেকেই নোট গাইড ছাপানোর কাজ শুরু হয়েছে। অনেক ক্লাসের নোট-গাইডই প্রস্তুত হচ্ছে। খুব দ্রুতই এগুলো বাজারে আসবে। পাণ্ডুলিপি আগে না পেলে তো আর এতো দ্রুত কাজ শুরু করা যেতো না।
বাংলাবাজারের এক বই বিক্রেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কয়েকটি দোকানে ইতোমধ্যেই কিছু বই এসেছে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সকল ক্লাসের গাইড বই বাজারে আসবে বলে জানানো হয়েছে। আপনারা ৫ জানুয়ারির দিকে আসলেই দোকানে বই পাবেন।

এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি এনসিটিবির কর্মকর্তারা দুটি ছাপাখানা পরিদর্শনে গিয়ে নোট-গাইড বই ছাপানোর বিষয়টি হাতেনাতে ধরেছেন। এই কাজ না করতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সতর্কও করে দিয়েছে এনসিটিবি। দোষীদের দ্রুত চিহ্নিত করতে ইতোমধ্যে একাধিক কমিটিও গঠন করা হয়েছে বলে এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ বি এম রিয়াজুল হাসান সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, অসৎ কাজের জড়িতদের দ্রুত চিহ্নিত করতে ইতিমধ্যে একাধিক কমিটি গঠন করেছে এনসিটিবি। তারা তদন্ত করেে কটি রিপোর্ট আমাদের দিবেন।
এদিকে এনসিটিবি সূত্রে আরো জানা গেছে, এনসিটিবির বেশ কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে এই সিন্ডিকেট বছরের পর বছর ধরে এই অপকর্ম করে আছে। তাদের সহায়তায় এই সিন্ডিকেট এবার আরো বেশি সক্রিয় হয়েছে বলে জানিয়েছে এই সূত্র। প্রকাশ্যেই এই নিষিদ্ধ নোট গাইডের ব্যবসা চললেও তাদের প্রভাবে এর বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলেও দাবি করেছে এই সূত্র। নোট-গাইড কোম্পানিতে গোপনে মাসিক বেতনে বিসিএস সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাচাকরি করছেন বলেও জানা গেছে। এর বিনিময়ে তাদেরকে বিভিন্ন সুবিধাও দিয়ে থাকে এই সিন্ডিকেট। জানা গেছে, নোট-গাইড কোম্পানিগুলোর মালিকদের টার্গেট প্রেষণে অথবা বদলিভিত্তিক পদায়ন পাওয়া জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর এবং মাদ্রাসা ও ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তারা। এছাড়া শিক্ষা ক্যাডারদের শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে তদবির করে পদায়ন পাইয়ে দিতেও ভূমিকা রাখতে পারেন কোনো কোনো নোট-গাইড কোম্পানির মালিক। এসব সুবিধার লোভে পড়েই এই সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়ছেন তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনসিটিবির এক কর্মকর্তা বলেন, এনসিটিবির অনেক কর্মকর্তাসহ বড় একটা সিন্ডিকেট এখানে কাজ করছে, এনসিটিবির সহায়তা ছাড়া প্রকাশ্যে এসব করা সম্ভব হতো না। এই সিন্ডিকেটের প্রভাবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয় না।
এদিকে ছাপাখানার মালিক ও এনসিটিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে নভেম্বর ও ডিসেম্বর সহায়ক বইয়ের নামে বিক্রি হওয়া ‘নিষিদ্ধ নোট-গাইড’ বইয়ের মুদ্রণ ও বাজারজাতকরণ বন্ধ রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির কাছে অনুরোধ করা হয়েছিল। একই সঙ্গে খোলাবাজারে এই ধরনের নিষিদ্ধ বইয়ের বিক্রি ঠেকাতে জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপারদের চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেসবই ছিল লোক দেখানো। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সম্প্রতি পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানর আগ পর্যন্ত নোট গাইড ছাপাতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তবেও এতেও থেমে নেই এই চক্র। কঠোর নজরদারি না করা হলে তা থামানো যাবেনা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির এক সাবেক সহ সভাপতি বলেন, ডিসেম্বর মাসের জন্য নিষিদ্ধ নোট-গাইড বই ছাপা বন্ধে কঠোর নজরদারি করা উচিত। তা না হলে কোন কাজ হবেনা। এই চক্র আগেই পাণ্ডুলিপি পেয়ে গেছে। তারা থামবেনা। এতে অনেক সমস্যাও হচ্ছে। কারণ তারা চড়ামূল্যে কাগজ কিনে মিলগুলোকে ব্যস্ত রাখছেন। এজন্য ন্যায্যমূল্যে আমাদের কাগজ দিতে গড়িমসি করছে মিলগুলো। এতে সরকারি পাঠ্যপুস্তক ছাপাতে সমস্যায় পড়ছে কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো।
অন্যদিকে পাঠ্যবই ছাপানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সবাই নোট, গাইড বই তৈরিতে জড়িত নয় বলে দাবি করেছেন মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা। তাদের দাবি যাদের নোট গাইডের ব্যবসা রয়েছে তারা এই কাজ করে থাকতে পারে। কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো প্রিন্টিংয়ের কাজ করায় তারা নোট গাইড ছাপাচ্ছে না বলেও দাবি করেছেন তারা।
মুদ্রণ শিল্প সমিতির ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. আনোয়ার হোসাইন বলেন, যাদের নোট-গাইড ব্যবসা আছে তারা এমন কাজ করতে পারে, তবে যারা শুধু প্রিন্টিংয়ের কাজ করে তারা এমনটি করে না।

এবিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান এনসিটিবির শিক্ষাক্রম উইংয়ের সদস্য অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী বলেন, পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো হাতে পাওয়া পাণ্ডুলিপির সিডি ব্যবহার করে নোট-গাইড ছাপানোর কাজ শুরু করতে পারে। চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা সিডিতে বইয়ের সফট কপি দিচ্ছি। সেনাবাহিনীকেও সিডি দেওয়া হয়েছে। প্রিন্টার্সদের মধ্যে কেউ যদি তা ফাঁস করে দেন বা নিজেরাই নোট-গাইড ছাপানোর কাজ শুরু করেন সেক্ষেত্রে আমরা কী করব?

নোট-গাইড বন্ধে এনসিটিবি কোনো উদ্যোগ নেবে কি না জানতে চাইলে এনসিটিবির শিক্ষাক্রম উইংয়ের এই সদস্য বলেন, কিছু নিষিদ্ধ হলে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে নির্বাহী বিভাগ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আমাদের এ বিষয়ে করার তেমন কিছু নেই।