তীব্র রোদ আর প্রখর তাপদাহে যখন প্রকৃতি হাঁসফাঁস করছে, তখন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) যেন এক ভিন্ন রূপে সেজেছে। চৈত্রের কাঠফাটা রোদকে হার মানিয়ে ক্যাম্পাসের বিস্তীর্ণ প্রান্তর ছেয়ে গেছে উলুফুলের শুভ্রতায়। উত্তরের এই আলোকবর্তিকার সবুজ চাদরে এখন সাদার ক্যানভাস, যেখানে চোখ জুড়িয়ে যায় প্রকৃতির স্নিগ্ধতায়।
গ্রাম ও শহরের মিশেলে গড়ে ওঠা বেরোবির ৭৫ একরের সবুজ ক্যাম্পাস এখন শুভ্রতায় ঝলমল করছে। মনে হচ্ছে, গ্রীষ্মের দাবদাহে ক্লান্ত প্রকৃতি যেন শান্তির পরশ খুঁজে পেয়েছে এই সাদা ফুলের আবরণে। ক্যাম্পাসের আনাচে-কানাচে কৃষ্ণচূড়া, জারুল, সোনালুর বর্ণিল সৌন্দর্য থাকলেও, উলুফুল বা ঘাসফুলের মন মাতানো রূপ বিশেষভাবে আকৃষ্ট করছে শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীদের।
বেরোবির শিক্ষার্থীদের প্রাণে উলুফুলের সৌন্দর্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ক্যাম্পাসের সবুজ প্রান্তরে যেন মুক্তো ঝরে পড়েছে, আর সেই মুক্তো মুঠোফোনের ক্যামেরায় বন্দী করে নিচ্ছে তারা। প্রকৃতির এই সাদা মায়ায় ক্যাম্পাসের প্রতিটি স্পন্দনে 느껴 যাচ্ছে পবিত্রতার ছোঁয়া। বাতাসে যখন উলুফুলগুলো মৃদু ঢেউ তোলে, তখন মনে হয় যেন হাসছে পুরো ক্যাম্পাস, হাসছে প্রকৃতি, আর সেই হাসির রেশ পৌঁছে যাচ্ছে হৃদয়ের গভীরে। শুভ্র হাসির এই মুক্তো যেন আকাশ, বাতাস আর প্রাণের ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে এক অনাবিল আনন্দ।
বছরের ছয়টি ঋতুতেই নানান রঙে সেজে ওঠে উত্তরের এই বিদ্যাপীঠ। প্রকৃতির পালাবদলে এখানে প্রতিদিনই ফোটে নতুন ফুল, ছড়ায় নিজস্ব দ্যুতি। অ্যাকাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, খেলার মাঠ, কিংবা বিভিন্ন চত্বর – সবখানেই হৃদয়কাড়া সৌন্দর্যের মুগ্ধতা। গ্রীষ্মের শুরুতে উষ্ণ অভ্যর্থনা যেন এই ফুলের মাধ্যমেই শুরু হয়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোর আশেপাশে লাগানো বাহারি ফুল মনকে রাঙিয়ে তোলে। তবে এই সময়ে ক্যাম্পাসের ২ নং খেলার মাঠের পশ্চিম প্রান্তের উলুফুলের শুভ্রতা যেন সব সৌন্দর্যকে ছাড়িয়ে যায়। অযত্নে বেড়ে ওঠা এই ফুলগুলো আপন মনে তৈরি করেছে এক বিশাল সাম্রাজ্য। দিনের বিভিন্ন সময়ে, মৃদু অথবা ঝড়ো হাওয়ায় যখন এই ফুলগুলো দোলে, তখন মনে হয় যেন এক সাদা সমুদ্রের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। প্রায় শতভাগ আয়তনের এই মাঠটি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। শিক্ষার্থীরা এখানে মেতে ওঠে ফুল নিয়ে খুনসুটিতে, কেউ বসে আড্ডা দেয়, কেউবা শুয়ে ছবি তোলে, আবার কেউ সারি বেঁধে বসে প্রকৃতির এই মনোরম দৃশ্য উপভোগ করে। তবে আশ্চর্য্যের বিষয় হলো, কেউই ফুল মাড়িয়ে নষ্ট করে না।
লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার তার অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, “ঘাসের চাদরে শুয়ে, হাতে উলুফুল নিয়ে থাকাটাও পৃথিবীর সুন্দরতম অনুভূতিগুলোর মধ্যে একটি। ঘাসফুলের সৌন্দর্য মৌমাছিকেও আকৃষ্ট করে। কষ্টের মন ভালো করতে চাইলে এই ফুলের মাঝে আসা উচিত।”
বাংলা বিভাগের আঁখি আক্তার বলেন, “প্রকৃতির অপরূপ চিত্র যেন কোনো শিল্পীর তুলিতে আঁকা। বর্ষার আগমনীর গানের সাথে তাল মিলিয়ে বেরোবির সাদা কাশফুল প্রকৃতিকে এক নতুন বার্তা দিচ্ছে। ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীরা সবাই এই সাদা ফুলের মায়ায় মুগ্ধ।”
উলুফুল দেখতে অনেকটা কাশফুলের মতো হলেও আকারে অনেক ছোট। এর ঘাস প্রায় ২ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। পাতাগুলো গোড়ার কাছে চওড়া এবং ক্রমশ সরু হয়ে একটি তীক্ষ্ণ বিন্দুতে শেষ হয়। পাতার কিনারা ধারালো সিলিকা স্ফটিকযুক্ত। প্রধান শিরাটি পাতার বাকি অংশের চেয়ে হালকা রঙের এবং একপাশে অবস্থিত। গাছের গোড়ার কাছে উপরের দিক লোমযুক্ত এবং নীচের দিক সাধারণত লোমহীন থাকে। উলু গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Imperata cylindrica, যা বহুবর্ষজীবী প্রজাতি।
সাধারণত স্যাঁতসেঁতে পতিত জমিতে এই ফুল স্বাচ্ছন্দ্যে বাড়ে এবং বছরের পর বছর টিকে থাকে। কাঠফাটা রোদের মাঝে উলুফুলের এই জেগে ওঠা আবহমান বাংলার এক চিরচেনা রূপ, যা সহজেই হৃদয়কে আলোড়িত করে তোলে। বেরোবির এই শুভ্রতা যেন প্রকৃতির এক নীরব বার্তা, যা গ্রীষ্মের রুক্ষতাকে ছাপিয়ে স্নিগ্ধতার পরশ বুলিয়ে দেয় সবার মনে।


























