- ৪টি ধারায় আপত্তি ঢাকার
- আরও কিছু ধারা নিয়ে একমত নয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থা
- দুটি ধারা একেবারেই বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত
‘ঢাকায় মানবাধিকারবিষয়ক কার্যালয় স্থাপনে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিলেও সমঝোতা স্মারকের খসড়া এখনো চূড়ান্ত হয়নি। খসড়াটি ইতোমধ্যে ঢাকা ও জাতিসংঘের মধ্যে চার দফা সংশোধনের জন্য বিনিময় হয়েছে। খসড়াটি দুই পক্ষের মধ্যে এখনো সংশোধনের পর্যায়ে রয়েছে’- তৌহিদ হোসেন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন (ইউএনসিএইচআর) প্রতিষ্ঠা করতে এবং এ লক্ষ্যে সমঝোতা স্মারকের খসড়া সইয়ের জন্য নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। কিন্তু এ নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। কিছু মহল মনে করে এর মাধ্যমে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হবে, আবার কিছু মহল এর বিরোধিতা করছে। তারা মনে করছে, এর ফলে দেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত আসতে পারে এবং কিছু ক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ হতে পারে। একটি অংশ মনে করে, ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠিত হলে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে পারে। এর ফলে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী অধিকার সুরক্ষায় সহায়তা পাওয়া যাবে। একটি অফিসের মাধ্যমে জাতিসংঘের পক্ষে আরও সহজে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্ত করা সম্ভব হবে। প্রয়োজনে পদক্ষেপও নিতে পারবে এই বিশ্ব সংস্থাটি। এতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে। দুই পক্ষের এমন অবস্থানে অফিস স্থাপন নিয়েই জটিলতা বাড়ছে।
এদিকে কিছু রাজনৈতিক দল এবং সংগঠন মনে করে, ঢাকায় এ ধরনের অফিস প্রতিষ্ঠা করা হলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ বাড়বে। তারা আরও মনে করে, এই অফিস প্রতিষ্ঠার ফলে দেশের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তারা আশঙ্কা করছেন, এ ধরনের অফিস প্রতিষ্ঠা করা হলে পশ্চিমা দেশগুলোর চাপ আরও বাড়বে এবং দেশের ওপর অর্থনৈতিক বা অন্য নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি আরও উন্নত হবে বলে আশা করা গেলেও দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব যেন ক্ষুণ্ন না হয়, সেদিকে নজর রাখছে সরকার। বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠার বিষয়টি একটি জটিল বিষয় এবং এর স্বপক্ষে এবং বিপক্ষে শক্তিশালী যুক্তি রয়েছে।
এদিকে ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশন স্থাপনের ব্যাপারে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে চারটি ধারা সম্পর্কে আপত্তিও জানিয়েছে ঢাকা। এ নিয়ে গত ৩ জুন এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সাবেক ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব রুহুল আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে সংশি¬ষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এতে অংশ নেন। বৈঠকে প্রস্তাবিত খসড়ায় থাকা চারটি ধারা নিয়ে আপত্তি জানান কর্মকর্তারা। দুটি ধারা একেবারেই বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ধারা দুটি হলো চরম অবহেলা বা ইচ্ছাকৃত অসদাচরণ ছাড়া জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়ে কর্মকর্তাদের দায়মুক্তি এবং কূটনীতিকদের স্বামী বা স্ত্রীর কাজের অনুমতির বিষয়টি। জাতিসংঘ চায়, স্থানীয় কর্মকর্তাদেরও দায়মুক্তি দেওয়া হোক। এমনকি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরও। এই উপধারাটি নিয়ে আপত্তি আছে বাংলাদেশের।
এ ছাড়া জাতিসংঘের প্রস্তাবিত আরও কিছু ধারা নিয়ে একমত নয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। এর মধ্যে আছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের কর্মীদের দেশে বাধাহীন আসা-যাওয়া, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা, ভিসা-এন্ট্রি অনুমোদন ও সামাজিক সুরক্ষার ধারাগুলোর সংশোধনী। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, রাষ্ট্র চাইলে স্পর্শকাতর বিষয়ে মানবাধিকার কমিশনের কর্মকাণ্ড সীমিত করতে পারে। এদিকে কোনো দেশে সাধারণত জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কার্যালয় চালু করতে হলে সংশি¬ষ্ট দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রয়োজন পড়ে। সেখানে দুই পক্ষকেই কাজের পরিধি, সুরক্ষা এবং দায়ের মতো বিষয়ে সম্মত হতে হয়। তবে জাতিসংঘ দাবি করছে, সমঝোতা স্মারকের অনুমোদনের আগে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। দেওয়া হয়নি কোনো অনুলিপি। আর অনুমোদিত খসড়ার পর্যালোচনা ছাড়া এতে স্বাক্ষর করবে না জাতিসংঘ।
সূত্র জানায়, ঢাকায় এ ধরনের কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হলে রাষ্ট্রীযন্ত্র ব্যবহার করে বা রাষ্ট্রের মদদে সংঘবদ্ধ মানবাধিকার লঙ্ঘন করতে ভয় পাবে সংশি¬ষ্টরা। এই কমিশনের মাধ্যমে জনগণ উপকৃত হলেও রাজনীতিকরা মানবাধিকার কমিশনের তোপের মুখে পড়বেন। এ জন্যই রাজনৈতিক নেতারা এর বিরোধতা করছেন। এদিকে বিশ্বে ১৮টি দেশে জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনারের কার্যালয় রয়েছে। এ ছাড়া ১৩টি আঞ্চলিক কার্যালয় ও বাংলাদেশসহ ৪৩টি দেশে এর কার্যালয় স্থাপনের অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছে জাতিসংঘ। বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় নেই। তবে এসব দেশে মানবাধিকার অ্যাডভাইজার নিয়োগ দেওয়া আছে, যিনি কমিশনের পক্ষে একই কাজ করে থাকেন।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ঢাকায় মানবাধিকার বিষয়ক কার্যালয় স্থাপনে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিলেও সমঝোতা স্মারকের খসড়া এখনো চূড়ান্ত হয়নি। খসড়াটি ইতোমধ্যে ঢাকা ও জাতিসংঘের মধ্যে চার দফা সংশোধনের জন্য বিনিময় হয়েছে। খসড়াটি দুই পক্ষের মধ্যে এখনো সংশোধনের পর্যায়ে রয়েছে।


























