দারুল উলুম দেওবন্দের খেদমত ও অবদান বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হয়ে আছে। উলামায়ে দেওবন্দের কীর্তি সর্বময়। এ পৃথিবীর এমন কোন জায়গা নেই যেখানে দেওবন্দী আলেমদের পদচিহ্ন পড়েনি। সূর্যোদয়ের দেশ থেকে নিয়ে সূর্যাস্তের কিনারা পর্যন্তÑ সর্বত্র দেওবন্দী ওলামা-মাশায়েখের পদচারণায় মুখরিত হয়েছে। দেওবন্দী মাদরাসা, খানকা, চেতনা ও আদর্শ উজ্জীবিত করেছে পৃথিবীর নান জনগোষ্ঠীর মানুষদেরকে। এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, অষ্ট্রেলিয়াসহ প্রতি মহাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন দেওবন্দী আলেম। ইউরোপ- আমেরিকার মতো আধুনিক রাষ্ট্রগুলোতে এখন দ্বীনি পরিবেশ বিরাজ করছে তাদের হাত ধরে। দেওবন্দী আলেমদের মেহনত-মুজাহাদার বদৌলতে সেসব জায়গাগুলোয় এখন ধর্মচর্চা অবারিত হয়েছে। কোথাও কোথাও মনে হয় আমি বুঝি ইউরোপে নেই, বরং ভারতবর্ষের কোনো দ্বীনি এলাকায় হেঁটে বেড়াচ্ছি। মোটকথা, ওলামায়ে দেওবন্দের কল্যাণে আজ পৃথিবীজুড়ে বইছে ইসলামের এক শীতল শান্ত সমীরণ। আল্লামা তাকি উসমানী (দাবা.) বর্তমান বিশ্বের অন্যতম একজন ইসলামি স্কলার ও পরিব্রাজক।
তার ‘সফর দর সফর’ গ্রন্থে লিখেছেন, তিনি পৃথিবীর সূর্যোদয়ের দেশ থেকে নিয়ে একেবারে সূর্যাস্তের দেশেও সফর করেছেন। অনেক দুর্গম এলাকাতেও পা পড়েছে তার। তিনি দেখেছেন সব জায়গাতে ওলামায়ে দেওবন্দের সুকর্ম বিস্তৃত। এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে দেওবন্দী আলেমদের পদচারণা ঘটেনি। শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানী ( রহ.) এর জানেশীন ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী ( রহ.) ইউরোপের দেশসমূহে এক বিশাল দ্বীনি মিশনের জাগরণ তোলেছিলেন। তার মেহনতের ফলে ইউরোপের বুকে বহু দ্বীনি স্কুল-মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি মানুষকে উৎসাহিত করতেন সন্তানকে দ্বীনি মাদরাসা কিংবা ইসলামি স্কুলে পড়ানোর জন্য। ইউরোপে প্রাইভেট স্কুল-মাদরাসাতে সন্তানদের পড়াতে গেলে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ হয়। যদিও সরকারিভাবে ফ্রিতে ছেলেমেয়েদের পড়ানোর ব্যবস্থাও রয়েছে। কিন্তু ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী এর বক্তব্য ছিল, টাকা খরচ করে ছেলে-মেয়েদের প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে পড়াবে, প্রয়োজনে একবেলা খাবে আর অন্য বেলার আহারের পয়সা জমা করে রাখবে। যাতে ছেলে-মেয়েদের দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে পড়ানো যায়।
এভাবে ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী দ্বীনি মিশন নিয়ে ইউরোপের পথে পথে ছুটে বেড়িয়েছেন। এই মেহনতের বদৌলতেই পুরো ইউরোপে এখন দ্বীনি ইলম ও আমলের সুবাতাস বইছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ দুনিয়ার রং-তামাশা থেকে ফিরে মহান রবের দিকে প্রত্যাবর্তন করেছে। অন্যান্য মহাদেশ জুড়েও এমনই অবস্থা। সেখানেও দ্বীন- ইসলামের মশাল প্রজ্বলন করে যাচ্ছেন দেওবন্দী ওলামা-মাশায়েখ। শায়খ তাকি উসমানী আরও বলেন, আমি পৃথিবীর একদম পূর্বপ্রান্তে গিয়েছি, যেখানে চারিদিকে সমুদ্রের অথৈ জলরাশি আর মাঝে একটা নিঝুম দ্বীপ। সেই দ্বীপের মাঝেও গড়ে ওঠেছে একটি দেওবন্দী মাদরাসা। যেখানে নিয়মিত বুখারী শরীফসহ সিহাহ সিত্তাহ কিতাবসমূহের পাঠ দেওয়া হচ্ছে। এক সময়ে বুখারা-সমরকন্দ ইলম চর্চার প্রাণকেন্দ্র ছিল। যেখানকার ইলমের সৌরভ পুরো বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছিল। বিশেষ করে ইমাম বুখারী, ইমাম তিরমিজিসহ হাজারো মুহাদ্দীস ও ফকীহ আলেমদের যেখানে প্রকাশ ঘটেছিল।
সেই ঐতিহাসিক স্থানগুলোতে গড়ে উঠেছে মাদারিস ও জামিয়া। যেখানে সিহা সিত্তাহসহ নানান ফান্নী কিতাবের পাঠদানের ব্যবস্থা রয়েছে। বড় মজার ব্যাপার হল, সে প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন দেওবন্দী আলেমদের লেখা কিতাবও পড়ানো হচ্ছে। যে বুখারা-সমরকন্দের ইলমের সৌরভে মোহিত বিশ্বময়; সেই ঐতিহাসিক জায়গাতে স্থান করে নিয়েছে ওলামায়ে দেওবন্দের লিখনী। সম্প্রতি বুখারা-সমরকন্দে সফর করছেন ওলামায়ে দেওবন্দের একটি তরুণ দল। যারা ঢাকা শহরের বিভিন্ন মাদরাসায় দরস দিয়ে থাকেন। তারা ইমাম বুখারী (রহ.)-এর মাকবারার পাশে সুবিশাল জামেয়া পরিদর্শন করেছেন। সেই জামেয়াতে তারা দেখতে পেলেন, দেওবন্দী আলেমদের লিখিত কিতাব পড়ানো হচ্ছে। বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফয়জুল বারী’ মাওলানা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রচিত। যেটা এখন বিশ্ব্যব্যাপী প্রসিদ্ধ। সুবিখ্যাত এ কিতাবটি এখন বুখারার জামিআ ইসমাঈল বুখারীর পাঠ্যসূচিতে শোভা পাচ্ছে। গর্বে বুকটা ভরে যায় আমাদের। ওলামায়ে দেওবন্দের এ কীর্তি পুরো বিশ্ব মুসলিমের জন্য সুখকর। আল্লাহ উলামায়ে দেওবন্দের সকল খেদমতকে কবুল করুন। আমিন।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট


























