- নিবন্ধনবিহীন এক হাজার ওষুধ ঝুলে আছে দুই বছর ধরে
- নভেম্বরেই শেষ হচ্ছে ট্রিপস ছাড়, বাড়ছে রয়্যালটির ঝুঁকি
- এপিআই পার্কে ১৫ বছরে কাজ শুরু করেছে মাত্র ৪ কোম্পানি
‘সরকার যদি এখন গ্র্যাজুয়েশন ঠেকাতে না পারে, তবে অন্তত ট্রানজিশন পিরিয়ড বাড়ানো উচিত’- এম মোসাদ্দেক হোসেন, ইউনিমেড ইউনিহেলথের চেয়ারম্যান
‘এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা আনবে এই প্রচারণা অনেকটা রাজনৈতিক। বাস্তবতা হলো, দেশের বড় বড় রপ্তানি খাত যেমন তৈরি পোশাক ও ওষুধ এখন যে সুবিধাগুলো পাচ্ছে, সেগুলোর অনেকটাই হারাতে বসেছে’- সৈয়দ কায়সার কবির, রেনেটার সিইও
বাংলাদেশের ওষুধ খাতে নতুন এক সঙ্কট ঘনিয়ে এসেছে। এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রাক্কালে প্রায় এক হাজার ওষুধের নিবন্ধন আবেদন দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে ঝুলে আছে। আগামী নভেম্বরেই বাংলাদেশকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডঞঙ) বাণিজ্যবিষয়ক মেধাস্বত্ব আইন (ট্রিপস) পুরোপুরি মেনে চলতে হবে। তখন এই ওষুধগুলো যদি অনুমোদিত না হয়, তাহলে তাদের ওপর এই আইনের প্রভাব পড়বে এবং কোম্পানিগুলোকে উচ্চ হারে রয়্যালটি দিতে হবে কিংবা পেটেন্ট নিতে হবে, যা ব্যয়বহুল ও কঠিন।
এদিকে, বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতি (বিএপিআই) ও বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের শীর্ষ নেতারা বলছেন, ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে এলডিসি থেকে উত্তীর্ণ হবে। কিন্তু একটি আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর থাকার কারণে আগামী ২০২৫ সালের নভেম্বরে থেকেই ওষুধ কোমাপানিগুলোর মেধাস্বত্ব আইন ট্রিপস পুরোপুরি মানতে হবে। এর মানে, নতুন কোনো ওষুধ বাজারজাত করতে হলে এখন থেকেই আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী রয়্যালটি দিতে হবে, অথবা বিপুল বিনিয়োগ করে পেটেন্ট নিতে হবে। তারা বলছেন, এলডিসি উত্তরণ শুধু ওষুধশিল্প নয়, গোটা অর্থনীতির জন্য বড় চাপ তৈরি করবে। বর্তমানে যে এক হাজারের মতো ওষুধ নিবন্ধনের অপেক্ষায় রয়েছে, সেগুলোর আবেদন দুই বছর ধরে ঝুলে আছে। তারা বলছেন, অন্তত এই সময়ের মধ্যে যেসব আবেদন জমা আছে, সেগুলোকে দ্রুত নিবন্ধন দেওয়া হোকÍযাতে পরবর্তীতে সেগুলোর ওপর ট্রিপস আইন প্রয়োগ না হয়।
এদিকে, দেশে ওষুধ খাতে স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য ২০০৭ সালে সরকার অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই) শিল্প স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়। ২০০৮ সালে বিসিকের মাধ্যমে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় ২০০ একর জমিতে গড়ে তোলা হয় ‘এপিআই শিল্পপার্ক’। ২৭টি ওষুধ কোম্পানিকে মোট ৪২টি প¬ট বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে পেরিয়ে গেছে দেড় দশক, তবু মাত্র চারটি কোম্পানি সেখানে কার্যক্রম শুরু করতে পেরেছে। অন্যদিকে, সরকার সম্প্রতি একটি উচ্চপর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠন করেছে যাতে জরুরি ওষুধের তালিকা প্রণয়ন ও তা জনগণের জন্য সহজলভ্য করার পরিকল্পনা করা যায়। ব্যবসায়ীদের মতে, এটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হলেও নিবন্ধন, অবকাঠামো, গ্যাস সংযোগ ও মেধাস্বত্ব আইন বাস্তবায়নের প্রস্তুতি ছাড়া তা বাস্তবায়ন করা কঠিন।
সংশি¬ষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ ওষুধ খাত এখন গুরুত্বপূর্ণ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে আছে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের মর্যাদা, অন্যদিকে তার পরিণতিতে হারাতে বসা আন্তর্জাতিক ছাড় ও নীতিগত সুবিধা। দুই বছর ধরে ঝুলে থাকা ওষুধ নিবন্ধন, ধীরগতির এপিআই পার্ক এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার চাপে দেশের ঔষধশিল্প যেন এক সঙ্কটের মুখে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময় খুব বেশি নেই। সরকার যদি দ্রুত ওষুধ নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ না করে, এপিআই পার্কে কাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত না করে, আর আন্তর্জাতিক আলোচনায় ট্রানজিশন সুবিধা না আদায় করেÍতাহলে ওষুধ শিল্পের এই অর্জন ধরে রাখা দুরূহ হয়ে যাবে।
ইউনিমেড ইউনিহেলথের চেয়ারম্যান এম মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, বাংলাদেশ যদি এলডিসি না থাকে, তাহলে আর স্বল্পসুদে ঋণ পাওয়া যাবে না। বিদেশি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধাও থাকবে না। পেটেন্ট ও মেধাস্বত্ব বিষয়ে ছাড় মিলবে না। আমাদের দাবি, অন্তত এই উত্তরণ তিন-চার বছর পিছিয়ে দেওয়া হোক। কম্বোডিয়া ও সেনেগালের মতো দেশগুলো গ্র্যাজুয়েশন পেয়েও নানা লুপহোল কাজে লাগিয়ে ট্রানজিশন পিরিয়ড দীর্ঘ করেছে। বাংলাদেশ এখনো সে কৌশলে আগ্রহী নয়, অথচ আমাদের উচিত ছিল তা করা। সরকার যদি এখন গ্র্যাজুয়েশন ঠেকাতে না পারে, তবে অন্তত ট্রানজিশন পিরিয়ড বাড়ানো উচিত।
রেনেটার সিইও সৈয়দ কায়সার কবির বলেন, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা আনবেÍএই প্রচারণা অনেকটা রাজনৈতিক। বাস্তবতা হলো, দেশের বড় বড় রপ্তানি খাত যেমন তৈরি পোশাক ও ওষুধ এখন যে সুবিধাগুলো পাচ্ছে, সেগুলোর অনেকটাই হারাতে বসেছে। বাংলাদেশ এই উত্তরণের জন্য প্রস্তুত নয়। ওষুধশিল্প বাংলাদেশের একটি গর্বিত খাত। এখান থেকে আমরা স্থানীয় চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করছি। রপ্তানিও বাড়ছে। এই শিল্পকে যদি প্রয়োজনীয় সহায়তা না দেওয়া হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হবে।

























