০৮:৩৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ৯ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আদিবাসীদের মানবাধিকার রক্ষায় গণমাধ্যমের আরও সক্রিয় ভূমিকার আহ্বান

বাংলাদেশে আদিবাসী বিষয়গুলো রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক কারণে সংবাদে যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না। শত শত বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সংগ্রামে তাদের অবদান থাকা সত্ত্বেও স্বীকৃতি ও অধিকার আজও নিশ্চিত হয়নি। আজ রবিবার বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তনে আইপিনিউজ বিডি আয়োজিত ‘বাংলাদেশের আদিবাসীদের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি ও গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এ মন্তব্য করেন।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইপিনিউজ যুগ্ম সম্পাদক অমর শান্তি চাকমা। তিনি বলেন, আদিবাসীরা জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে তাদের অবদান যথাযথভাবে স্বীকৃতি পায়নি। সংস্কার কমিশন ও জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনে আদিবাসীদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব রাখা হয়নি। পাঠ্যপুস্তক থেকে “আদিবাসী” শব্দ মুছে দেওয়ার প্রতিবাদে আয়োজিত কর্মসূচীতে হামলার ঘটনা ও বিচারহীনতা প্রমাণ করে যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাদের স্বীকৃতি ও অধিকার এখনও উপেক্ষিত।

তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন এখনও অসম্পূর্ণ। ভূমি দখল, ধরপাকড় ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বেড়েই চলেছে। সমতলে সাঁওতাল, খাসিয়া, গারোসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠী নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থার তথ্যমতে, গত কয়েক মাসে প্রায় ৫০০ আদিবাসী বিভিন্নভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন। তবুও সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশনের দাবি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।

আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, আদিবাসীরা ভাষা, শিল্প, সংগীত, উৎসব ও জীবনাচরণের ভিন্নতা দিয়ে দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে বহুমাত্রিক করেছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এখনো তাদের স্বতন্ত্র পরিচয় ও সংস্কৃতিকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, “বিগত প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের আগে আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হতো, কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর তা অস্বীকার করা হয়। মিডিয়ায় পূর্বে এই বিষয়ে যথেষ্ট আলোচনা থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে তা কমে গেছে।”

দৈনিক সমকালের সহকারী সম্পাদক সাইফুর রহমান তপন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা প্রায়ই বাধার সম্মুখীন হন। সরকারি-বেসরকারি নীতিমালা প্রণয়ন ও সংবাদ প্রচারের ধরণ অনেক সময় রাজনৈতিক দলের প্রভাব ও আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। তিনি বলেন, ২০১০ সালের পর থেকে আদিবাসীদের অধিকার, ভূমি দখল বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো গণমাধ্যমে যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয় না। তবে তিনি আশা প্রকাশ করেন, “যত বেশি গণতান্ত্রিক আন্দোলন শক্তিশালী হবে, তত বেশি গণমাধ্যমও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে এবং আদিবাসীদের অধিকার ও সমস্যাগুলো প্রচারে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।”

বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সহ-সাধারণ সম্পাদক হেলেনা তালাং বলেন, অতীতে যেমন ২০০১ সালে মধুপুরে ইকোপার্ক নির্মাণের নামে গারো জনগোষ্ঠীর ভূমি দখলের প্রতিবাদে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল, তেমন সাম্প্রতিক সময়ে আদিবাসীদের ভূমি, বন ও জীবনধারা সংক্রান্ত বিষয়গুলো যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না। তিনি উদাহরণ টানেন, সিলেটের টিলা পাহাড়ে বন বিভাগের সামাজিক বনায়নের নামে ভূমি দখল বা জাফলংয়ে দুই হাজার গাছ কেটে ফেলার ঘটনায় শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাধার সম্মুখীন হয়।

তিনি বলেন, “গণমাধ্যমে আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো নিয়মিত স্থান পায়, কিন্তু ভূমি দখল, বন উজাড় বা বেঁচে থাকার সংগ্রামের খবর তেমনভাবে গুরুত্ব পায় না। গণমাধ্যম ও রাষ্ট্র যদি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে, তবে আদিবাসীদের সংস্কৃতি সংরক্ষণ এবং অধিকার রক্ষায় তা অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।”

অনুষ্ঠানে সভাপতি আন্তনী রেমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতলের আদিবাসীরা শতাব্দী ধরে দেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ ও গণঅভ্যুত্থানে অবদান রাখলেও স্বীকৃতি ও ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। ভূমি দখল, জোরপূর্বক উচ্ছেদ, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সংস্কৃতির অবহেলা আজও চলমান। তাই রাষ্ট্র ও গণমাধ্যমকে সক্রিয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।

সভায় আরও বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সহ-সম্পাদক টনি চিরান, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী ও যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন, আইপিনিউজ বিডির নির্বাহী সম্পাদক সতেজ চাকমা।

এমআর/সবা

জনপ্রিয় সংবাদ

২৫ ডিসেম্বর শাহজালালে পর্যাপ্ত সময় নিয়ে যাত্রীদের পৌঁছানোর অনুরোধ

আদিবাসীদের মানবাধিকার রক্ষায় গণমাধ্যমের আরও সক্রিয় ভূমিকার আহ্বান

আপডেট সময় : ০৬:৪৯:০১ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৭ অগাস্ট ২০২৫

বাংলাদেশে আদিবাসী বিষয়গুলো রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক কারণে সংবাদে যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না। শত শত বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সংগ্রামে তাদের অবদান থাকা সত্ত্বেও স্বীকৃতি ও অধিকার আজও নিশ্চিত হয়নি। আজ রবিবার বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তনে আইপিনিউজ বিডি আয়োজিত ‘বাংলাদেশের আদিবাসীদের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি ও গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এ মন্তব্য করেন।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইপিনিউজ যুগ্ম সম্পাদক অমর শান্তি চাকমা। তিনি বলেন, আদিবাসীরা জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে তাদের অবদান যথাযথভাবে স্বীকৃতি পায়নি। সংস্কার কমিশন ও জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনে আদিবাসীদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব রাখা হয়নি। পাঠ্যপুস্তক থেকে “আদিবাসী” শব্দ মুছে দেওয়ার প্রতিবাদে আয়োজিত কর্মসূচীতে হামলার ঘটনা ও বিচারহীনতা প্রমাণ করে যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাদের স্বীকৃতি ও অধিকার এখনও উপেক্ষিত।

তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন এখনও অসম্পূর্ণ। ভূমি দখল, ধরপাকড় ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বেড়েই চলেছে। সমতলে সাঁওতাল, খাসিয়া, গারোসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠী নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থার তথ্যমতে, গত কয়েক মাসে প্রায় ৫০০ আদিবাসী বিভিন্নভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন। তবুও সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশনের দাবি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।

আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, আদিবাসীরা ভাষা, শিল্প, সংগীত, উৎসব ও জীবনাচরণের ভিন্নতা দিয়ে দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে বহুমাত্রিক করেছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এখনো তাদের স্বতন্ত্র পরিচয় ও সংস্কৃতিকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, “বিগত প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের আগে আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হতো, কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর তা অস্বীকার করা হয়। মিডিয়ায় পূর্বে এই বিষয়ে যথেষ্ট আলোচনা থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে তা কমে গেছে।”

দৈনিক সমকালের সহকারী সম্পাদক সাইফুর রহমান তপন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা প্রায়ই বাধার সম্মুখীন হন। সরকারি-বেসরকারি নীতিমালা প্রণয়ন ও সংবাদ প্রচারের ধরণ অনেক সময় রাজনৈতিক দলের প্রভাব ও আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। তিনি বলেন, ২০১০ সালের পর থেকে আদিবাসীদের অধিকার, ভূমি দখল বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো গণমাধ্যমে যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয় না। তবে তিনি আশা প্রকাশ করেন, “যত বেশি গণতান্ত্রিক আন্দোলন শক্তিশালী হবে, তত বেশি গণমাধ্যমও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে এবং আদিবাসীদের অধিকার ও সমস্যাগুলো প্রচারে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।”

বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সহ-সাধারণ সম্পাদক হেলেনা তালাং বলেন, অতীতে যেমন ২০০১ সালে মধুপুরে ইকোপার্ক নির্মাণের নামে গারো জনগোষ্ঠীর ভূমি দখলের প্রতিবাদে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল, তেমন সাম্প্রতিক সময়ে আদিবাসীদের ভূমি, বন ও জীবনধারা সংক্রান্ত বিষয়গুলো যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না। তিনি উদাহরণ টানেন, সিলেটের টিলা পাহাড়ে বন বিভাগের সামাজিক বনায়নের নামে ভূমি দখল বা জাফলংয়ে দুই হাজার গাছ কেটে ফেলার ঘটনায় শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাধার সম্মুখীন হয়।

তিনি বলেন, “গণমাধ্যমে আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো নিয়মিত স্থান পায়, কিন্তু ভূমি দখল, বন উজাড় বা বেঁচে থাকার সংগ্রামের খবর তেমনভাবে গুরুত্ব পায় না। গণমাধ্যম ও রাষ্ট্র যদি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে, তবে আদিবাসীদের সংস্কৃতি সংরক্ষণ এবং অধিকার রক্ষায় তা অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।”

অনুষ্ঠানে সভাপতি আন্তনী রেমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতলের আদিবাসীরা শতাব্দী ধরে দেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ ও গণঅভ্যুত্থানে অবদান রাখলেও স্বীকৃতি ও ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। ভূমি দখল, জোরপূর্বক উচ্ছেদ, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সংস্কৃতির অবহেলা আজও চলমান। তাই রাষ্ট্র ও গণমাধ্যমকে সক্রিয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।

সভায় আরও বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সহ-সম্পাদক টনি চিরান, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী ও যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন, আইপিনিউজ বিডির নির্বাহী সম্পাদক সতেজ চাকমা।

এমআর/সবা