- ব্যাংকিং বিপর্যয়ে এলসি বন্ধ, উৎপাদন ব্যাহত
- শিল্প মালিকদের হুঁশিয়ারি: রুগ্ন শিল্পে পরিণত হচ্ছে পোশাক খাত
- বেতন দিতে হিমশিম, লাখো শ্রমিকের চাকরি ঝুঁকিতে
‘এই মুহূর্তে কয়েকটি দুর্বল ব্যাংকের কারণে শত শত কারখানা আর্থিক চাপের মধ্যে রয়েছে। আমরা প্রাপ্য টাকা পাচ্ছি না। এতে কাঁচামাল আমদানি, উৎপাদন এবং শ্রমিকদের বেতন দেওয়া প্রতিনিয়তই দুষ্কর হয়ে উঠছে’- মাহমুদ হাসান খান, সভাপতি, বিজিএমইএ
‘এই পরিস্থিতি পুরো অর্থনীতির জন্যই অশনিসংকেত। তৈরি পোশাক খাতের সংকট মানেই বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহে ব্যাঘাত, কর্মসংস্থান হ্রাস এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে আস্থাহীনতা’- জাহিদ হোসেন, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত তৈরি পোশাক খাত বর্তমানে চরম আর্থিক চাপের মুখে। দেশের কয়েকটি দুর্বল ও তারল্যসংকটে থাকা ব্যাংকের কারণে এই খাতের রফতানিকারকরা সময়মতো প্রাপ্য অর্থ পাচ্ছেন না, নতুন এলসি খোলা যাচ্ছে না, ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন চক্র। এই সংকট যদি দ্রুত সমাধান না হয়, তাহলে লাখো শ্রমিক কর্ম হারাতে পারেন এবং দেশের প্রধান রফতানি খাত রুগ্ন শিল্পে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সংশি¬ষ্টরা বলছেন, এই মুহূর্তে কয়েকটি দুর্বল ব্যাংকের কারণে শত শত কারখানা আর্থিক চাপের মধ্যে রয়েছে। আমরা প্রাপ্য টাকা পাচ্ছি না। এতে কাঁচামাল আমদানি, উৎপাদন এবং শ্রমিকদের বেতন দেওয়া প্রতিনিয়তই দুষ্কর হয়ে উঠছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতি পুরো অর্থনীতির জন্যই অশনিসংকেত। তৈরি পোশাক খাতের সংকট মানেই বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহে ব্যাঘাত, কর্মসংস্থান হ্রাস এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে আস্থাহীনতা।
জানা গেছে, বাংলাদেশের সামষ্টিক রফতানির প্রায় ৮০ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই খাত থেকে এসেছে প্রায় ৩৯.৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ সেই খাতই আজ আর্থিক অনিশ্চয়তার ঘূর্ণাবর্তে। রফতানি আয় দেশে ফেরত এলেও কয়েকটি সংকটাপন্ন ব্যাংক তা সময়মতো পরিশোধ করতে পারছে না। এর প্রভাব পড়ছে এলসি খোলা, কাঁচামাল আমদানি ও উৎপাদনের ধারাবাহিকতায়। বিশেষজ্ঞ ও শিল্পমালিকদের মতে, সংকটের মূল কারণ হলো দেশের কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকে দীর্ঘদিনের অনিয়ম, লুটপাট ও দুর্নীতি। অনেক ব্যাংকে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়াও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এসব ব্যাংকে রফতানি আয়ের অর্থ এলেও তা রফতানিকারকদের সময়মতো দেওয়া হচ্ছে না, ফলে এলসি খোলা ও নিয়মিত ব্যয় নির্বাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, এই মুহূর্তে কয়েকটি দুর্বল ব্যাংকের কারণে শত শত কারখানা আর্থিক চাপের মধ্যে রয়েছে। আমরা প্রাপ্য টাকা পাচ্ছি না। এতে কাঁচামাল আমদানি, উৎপাদন এবং শ্রমিকদের বেতন দেওয়া প্রতিনিয়তই দুষ্কর হয়ে উঠছে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে আন্তর্জাতিক বায়াররা অন্য দেশে সরে যেতে পারে, যা দেশের বৈদেশিক আয়ের জন্য বড় বিপর্যয় হয়ে দাঁড়াবে।
এদিকে, ব্যাংকিং জটিলতার ফলে বেতন-ভাতা পরিশোধে বিলম্ব ঘটছে, যা শ্রমিকদের মধ্যে উদ্বেগ ও অস্থিরতা বাড়াচ্ছে। এখনই কিছু কিছু কারখানায় কর্মী ছাঁটাই শুরু হয়েছে। পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক না হলে লাখো শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়তে পারেন। এটি শুধু শ্রম বাজার নয়, দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতাকেও হুমকির মুখে ফেলবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি জানান, দেশের অন্তত ১২-১৩টি ব্যাংক লুটপাটের শিকার হয়েছে। তাদের পুনরুদ্ধার ও আমানতকারীদের অর্থ ফেরাতে আইনগত সংস্কারসহ একীভূতকরণের মতো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে পাঁচটি শরিয়াহভিত্তিক বেসরকারি ব্যাংককে একীভূত করে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রায়ত্ত ইসলামি ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। গভর্নরের মতে, রফতানি খাতকে সচল রাখতে এবং অর্থনীতি রক্ষা করতে হলে তারল্য সংকট মেটানোর জন্য জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হবে। সময়মতো রফতানি আয় রফতানিকারকদের কাছে পৌঁছানো গেলে তারা উৎপাদন ও রপ্তানি অব্যাহত রাখতে পারবেন।
এদিকে, সংশি¬ষ্টরা বলছেন, এই সংকটের প্রভাব শুধু দেশের ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকবে না। আন্তর্জাতিক বায়াররা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে তা দেশের ভাবমূর্তি, রেটিং ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অংশীদারিত্বকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বিজিএমইএ’র আশঙ্কা, পরিস্থিতি এমনই অবনতির দিকে যাচ্ছে যে, কিছু কারখানা উৎপাদন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে। ভবিষ্যতে বিদেশি ক্রেতারা আদেশ স্থগিত করতে পারেন, কিংবা চীন, ভিয়েতনাম, কায়রো কিংবা ভারতমুখী হতে পারেন। এতে পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল অর্থনীতি চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। শিল্প বিশে¬ষকরা বলছেন, শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। সরকারের একটি সমন্বিত নীতিগত হস্তক্ষেপ দরকার। বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ, কর ছাড়, ও নীতিগত সহায়তার মাধ্যমে এই খাতকে পুনরুজ্জীবিত করা জরুরি। না হলে দেশের রফতানি খাত মারাÍক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ী নেতারা মনে করেন, সংকট নিরসনে তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন রয়েছে।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, এই পরিস্থিতি শুধু একটি খাত নয়, পুরো অর্থনীতির জন্যই অশনিসংকেত। তৈরি পোশাক খাতের সংকট মানেই বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহে ব্যাঘাত, কর্মসংস্থান হ্রাস এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে আস্থাহীনতা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যাংক সংস্কারে কিছু উদ্যোগ দেখা গেলেও, তা এখনও কাক্সিক্ষত মাত্রায় পৌঁছায়নি। এই পরিস্থিতি যদি বছরের পর বছর চলে, তাহলে রফতানি খাতকে বাঁচানো কঠিন হবে।























