টেকনোলজি পুরো পৃথিবীর যেমন আশীর্বাদ তেমনি অভিশাপও বটে। বিজ্ঞানের অভাবনীয়
আবিষ্কার পৃথিবীটাকে করে দিয়েছে হাতের মুঠোই। বাংলাদেশে প্রযুক্তি ব্যবহারের বহু যুগ
পূর্বে কবি নজরুল বলেছিলেন ‘‘থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখবো এবার জগৎটাকে, কেমন
করে ঘুরছে মানুষ, যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে। দেশ হতে দেশ দেশান্তরে ছুটছে তারা কেমন করে,
কিসের নেশায় কেমন করে মরছে যে বীর লাকে লাকে’’। আজ ইন্টারনেট ব্যবহার করে মানুষ
চাইলেই হোয়াটঅ্যাপ, বাইবার, ইমু, স্কাইপি, ইন্সট্রাগ্রাম, ফেসবুক মেসেঞ্জার সহ নানা
সাইট ব্যবহার করে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যোগাযোগ করতে পারেন প্রতি
সেকেন্ডে। প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে করে তুলেছে বহুগুন সহজ। অফিস,
আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্যের ছোটকাট কাজের পাশাপাশি মহাকাশযানের মত বড় প্রজেক্টের
বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের প্রযুক্তি ছাড়া আজ পুরো বিশ্ব অচঁল। তেমনিভাবে বিজ্ঞানের এসবের
সবচেয়ে জনপ্রিয় আবিষ্কার এআই ইতিবাচক যেমন ঠিক আছে তেমনি নেতিবাচক দিকও
কম নয়। যুগান্তকারী এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষ যেমন সহজেই করছে চিকিৎসা বিজ্ঞানের
মত কঠিন পরিকল্পনা, আধুনিক প্রযুক্তির রোবটের ব্যবহার মানব জীবনকে করে দিয়েছে ঝুঁকি
মুক্ত। তেমনিভাবে বর্তমান সময়ে এআই নির্মিত নিখুঁত রিয়েলস্টিক ছবি ও ভিডিও
এডিটিং করে মানুষের বিশ্বাসের জায়গায় কৃত্রিম শংকট তৈরি করেছে চলেছেন। ভবিষ্যতে
মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে। ফেসবুক
ইন্সটাগ্রাম খুললেই দেখা মিলে এআই নির্মিত প্রেমিক প্রেমিকার রিয়েলস্টিক ছবি।
প্রতিনিয়ত প্রচারিত হচ্ছে নানা মানুষের মুখ ব্যবহার করে ভুয়া বক্তব্য, ফাঁস হচ্ছে
ভিআইপিদের কল রেকর্ড, ব্যঙ্গাত্মক ভিডিও ও ছবি। সাধারণ মানুষ আসল এবং নকলের
দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে বিভ্রান্ত হচ্ছে সহজেই। বাংলাদেশের বহু জায়গায় এআই নির্মিত ভুয়া ছবি
কন্টেন্ট ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পারিবারিক ও সমাজিক উশৃঙ্খলতা তৈরি করে
দিয়েছে। ফলে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে গুজব। এতে করে বাড়ছে নিরাপত্তাহীনতা, বাড়ছে সন্দেহের
চোখ।
এখনো পর্যন্ত এআই কন্টেন্ট ও ছবিতে নাগরিক সচেতনতা না থাকার ফলে সৃজনশীল এ
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, প্রযুক্তির ব্যবহার করে সত্য মিথ্যার সীমারেখা করে দিচ্ছে। বহু অসাধু লোক
ফেক আইডির মাধ্যমে সামাজিক প্রতিপক্ষ ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হেয় প্রতিপন্ন করার
জন্য এআই এর নিখুঁত কন্টেন্ট বানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার ছড়িয়ে দিয়ে সামাজিক ও
রাষ্ট্রীয় সমস্যা তৈরি করছে। মানুষের কাছে এমনভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে বিনোদন,
নানা প্রচারণা, বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনে মডেল বাদ দিয়ে এআই নির্মিত চটকদার বিজ্ঞাপন
বানিয়ে নিচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে ভবিষ্যতে সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ প্রযুক্তি ভয়াবহভাবে
প্রভাব ফেলতে পারে। এই প্রযুক্তির সহজলভ্য ব্যবহারের ফলে আসন্ন নির্বাচনে ভুয়া কনটেন্ট
বানিয়ে জনমতের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে নানাভাবে প্রভাবিত করতেও পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইয়ামিন শাহরিয়ার বলেন প্রযুক্তি নিজে কখনো ক্ষতিকর নয়;
বরং মানুষের অপব্যবহারই তাকে ভয়ঙ্কর করে তোলে। ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী কোম্পানিগুলো
তাদের টুলের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে মজবুত অ্যালগরিদম তৈরি করতে হবে। বর্তমানে সময়ে
এসে এআই প্রযুক্তির এ ব্যবহার থামিয়ে ফেলা সম্ভব নয়, তবে সরকারের উচিত দায়িত্বশীল
ব্যবহার নিশ্চিত করা। দায়িত্বশীল ব্যবহার নিশ্চিত না হলে ভবিষ্যতে ব্যক্তি কেন্দ্রিক, সমাজ
কেন্দ্রিক, রাজনীতি কেন্দ্রিক নানামুখী সংকট মোকাবেলা করতে হবে জাতিকে।
সাংবাদিক আনম হাসান মনে করেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) আজকের পৃথিবীতে
মানবজীবনকে বদলে দেওয়ার এক বিরাট শক্তি। তবে এর ভুল ব্যবহার সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য মারাত্মক
বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এআই ব্যবহার করে ভুয়া খবর ছড়ানো, ছবি ও কণ্ঠস্বর নকল করে
প্রতারণা করা কিংবা সামাজিক বিভাজন তৈরির মতো কর্মকাণ্ড দিন দিন বেড়েই চলছে। ফলে
ব্যক্তি ও সমাজ উভয়েই আস্থা সংকটে পড়ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা।
প্রয়োজনে আইনি কাঠামো, নৈতিকতা এবং সামাজিক সচেতনতার সমন্বয়। অন্যথায় এই
অসাধারণ প্রযুক্তি মানবকল্যাণের বদলে মানবতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।


























