০৪:৩৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

১৪ মাসে ১৬ খুন: নিয়ন্ত্রণহীন চট্টগ্রাম রাউজানের ‘গ্রুপিং রাজনীতি’

চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী উপজেলা রাউজান এক আতঙ্কিত জনপদে পরিণত হয়েছে। একের পর এক সংঘর্ষ, চাঁদাবাজি, সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডের কারণে স্থানীয় মানুষদের জীবন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে ১৪ মাসে রাউজানে ১৬টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে ১১টি হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঘটেছে। বাকি হত্যাগুলো পরিবার বিরোধ, চাঁদাবাজি ও দখল সংক্রান্ত।

প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে অধিকাংশ হত্যাকাণ্ড। তবে এখনও বেশিরভাগ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয়। কেউ পাড়া-মহল্লায়, কেউ ইউনিয়নে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এসব বাহিনী স্থানীয়দের কাছে ত্রাসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও সব গ্রুপের নেতারা কোনো রাজনৈতিক পদ-পদবি না রাখলেও, তারা রাজনৈতিক দলের নাম ব্যবহার করে অপকর্ম চালাচ্ছে।

সর্বশেষ ঘটনা ঘটে ৭ অক্টোবর। মোটরসাইকেল আরোহী অস্ত্রধারীরা দক্ষিণ মাদার্শা ইউনিয়নের মদুনাঘাট বাজারের পানি শোধনাগার ফটকের সামনে গুলি চালায়। এতে বিএনপির কর্মী মুহাম্মদ আবদুল হাকিম (৫২) নিহত হন। তার সঙ্গে থাকা আরেকজন গুলিবিদ্ধ হয়। নিহত হাকিম ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারী।

রাউজান উপজেলার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও অরাজকতা বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। উপজেলার ১৪ ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত এই এলাকায় বিএনপির রাজনীতি মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী, অপর ভাগের নেতৃত্বে আছেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি গোলাম আকবর খন্দকার। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই নেতার অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ প্রায় প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় ঘটেছে।

সন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্তরা বিএনপির নেতাদের শরণাপন্ন হয়ে এলাকায় অপকর্ম চালাচ্ছে। এসব বাহিনী বালুমহল, পাহাড় থেকে মাটি বিক্রি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ঠিকাদারি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, ইটভাটা ও সড়কে চাঁদাবাজি চালাচ্ছে। সম্প্রতি ২৫ সেপ্টেম্বর নোয়াপাড়া ইউনিয়নের পথেরহাট বাজারে বিএনপি নেতা মুহাম্মদ আজিজুল হকের ওপর হকিস্টিক দিয়ে হামলা চালিয়ে তার হাত-পা ভাঙা হয়।

রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পরিসংখ্যানও উদ্বেগজনক। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে ৬৫টি সংঘর্ষ এবং ১৬টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে ১১টি রাজনৈতিক। নিহতদের মধ্যে বিএনপি ও যুবদলের ছয় জন, আওয়ামী লীগের চার জন এবং একজন ব্যবসায়ী রয়েছেন। সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড নোয়াপাড়া ইউনিয়নে ঘটেছে। এখানে ফজল হক, জসিম, কামাল ও জানে আলম বাহিনীসহ একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয়।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রাতভর আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়। সন্ধ্যা নামলেই দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়, প্রকাশ্যে গুলি ও মারামারি চলে। ব্যবসায়ীরা চাঁদা দিতে বাধ্য হচ্ছেন। স্থানীয়দের কথায়, “নোয়াপাড়া পথেরহাট বাজার এখন এক ভয়াবহ পরিবেশের মধ্যে রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের শাখা থাকলেও বাজারে নিরাপত্তা নেই। সন্ত্রাসীদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চায় না।”

বিএনপি নেতারা দ্রুত সন্ত্রাসী গ্রুপের গ্রেফতার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছেন। চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি গোলাম আকবর খন্দকার বলেন, “রাউজানে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এগুলোর মূল কারণ মাটি ও ইটভাটা দখল, ঠিকাদারি ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় এবং বিভিন্ন অনিয়ম।”

নির্বাহী কর্মকর্তা ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, রাউজানে সন্ত্রাসীদের অবস্থান, অপরাধপ্রবণ এলাকা ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থানের গুগল ম্যাপ তৈরি করে সরকারকে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে, তবে হত্যাকাণ্ড, চাঁদাবাজি ও সহিংসতার পরিস্থিতি এখনও অস্থিতিশীল। রাউজানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না আসায় গত ১৪ মাসে তিনবার থানার ওসিকে বদলি করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হাটহাজারী সার্কেল) কাজী মো. তারেক আজিজ জানিয়েছেন, “বাকি হত্যাকাণ্ডের জড়িতদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলমান আছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন।”

রাউজান উপজেলায় ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক সংঘাত ও গ্রুপিং রাজনীতির কারণে স্থানীয় মানুষদের জীবনযাত্রা ভয়ঙ্কর অবস্থায় পৌঁছেছে। স্থানীয়দের দাবি, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করলে অঞ্চলটি শান্তির পথে ফিরবে।

এমআর/সবা

জনপ্রিয় সংবাদ

১৪ মাসে ১৬ খুন: নিয়ন্ত্রণহীন চট্টগ্রাম রাউজানের ‘গ্রুপিং রাজনীতি’

আপডেট সময় : ০৬:১৬:২৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫

চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী উপজেলা রাউজান এক আতঙ্কিত জনপদে পরিণত হয়েছে। একের পর এক সংঘর্ষ, চাঁদাবাজি, সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডের কারণে স্থানীয় মানুষদের জীবন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে ১৪ মাসে রাউজানে ১৬টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে ১১টি হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঘটেছে। বাকি হত্যাগুলো পরিবার বিরোধ, চাঁদাবাজি ও দখল সংক্রান্ত।

প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে অধিকাংশ হত্যাকাণ্ড। তবে এখনও বেশিরভাগ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয়। কেউ পাড়া-মহল্লায়, কেউ ইউনিয়নে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এসব বাহিনী স্থানীয়দের কাছে ত্রাসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও সব গ্রুপের নেতারা কোনো রাজনৈতিক পদ-পদবি না রাখলেও, তারা রাজনৈতিক দলের নাম ব্যবহার করে অপকর্ম চালাচ্ছে।

সর্বশেষ ঘটনা ঘটে ৭ অক্টোবর। মোটরসাইকেল আরোহী অস্ত্রধারীরা দক্ষিণ মাদার্শা ইউনিয়নের মদুনাঘাট বাজারের পানি শোধনাগার ফটকের সামনে গুলি চালায়। এতে বিএনপির কর্মী মুহাম্মদ আবদুল হাকিম (৫২) নিহত হন। তার সঙ্গে থাকা আরেকজন গুলিবিদ্ধ হয়। নিহত হাকিম ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারী।

রাউজান উপজেলার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও অরাজকতা বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। উপজেলার ১৪ ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত এই এলাকায় বিএনপির রাজনীতি মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী, অপর ভাগের নেতৃত্বে আছেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি গোলাম আকবর খন্দকার। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই নেতার অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ প্রায় প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় ঘটেছে।

সন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্তরা বিএনপির নেতাদের শরণাপন্ন হয়ে এলাকায় অপকর্ম চালাচ্ছে। এসব বাহিনী বালুমহল, পাহাড় থেকে মাটি বিক্রি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ঠিকাদারি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, ইটভাটা ও সড়কে চাঁদাবাজি চালাচ্ছে। সম্প্রতি ২৫ সেপ্টেম্বর নোয়াপাড়া ইউনিয়নের পথেরহাট বাজারে বিএনপি নেতা মুহাম্মদ আজিজুল হকের ওপর হকিস্টিক দিয়ে হামলা চালিয়ে তার হাত-পা ভাঙা হয়।

রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পরিসংখ্যানও উদ্বেগজনক। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে ৬৫টি সংঘর্ষ এবং ১৬টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে ১১টি রাজনৈতিক। নিহতদের মধ্যে বিএনপি ও যুবদলের ছয় জন, আওয়ামী লীগের চার জন এবং একজন ব্যবসায়ী রয়েছেন। সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড নোয়াপাড়া ইউনিয়নে ঘটেছে। এখানে ফজল হক, জসিম, কামাল ও জানে আলম বাহিনীসহ একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয়।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রাতভর আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়। সন্ধ্যা নামলেই দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়, প্রকাশ্যে গুলি ও মারামারি চলে। ব্যবসায়ীরা চাঁদা দিতে বাধ্য হচ্ছেন। স্থানীয়দের কথায়, “নোয়াপাড়া পথেরহাট বাজার এখন এক ভয়াবহ পরিবেশের মধ্যে রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের শাখা থাকলেও বাজারে নিরাপত্তা নেই। সন্ত্রাসীদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চায় না।”

বিএনপি নেতারা দ্রুত সন্ত্রাসী গ্রুপের গ্রেফতার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছেন। চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি গোলাম আকবর খন্দকার বলেন, “রাউজানে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এগুলোর মূল কারণ মাটি ও ইটভাটা দখল, ঠিকাদারি ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় এবং বিভিন্ন অনিয়ম।”

নির্বাহী কর্মকর্তা ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, রাউজানে সন্ত্রাসীদের অবস্থান, অপরাধপ্রবণ এলাকা ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থানের গুগল ম্যাপ তৈরি করে সরকারকে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে, তবে হত্যাকাণ্ড, চাঁদাবাজি ও সহিংসতার পরিস্থিতি এখনও অস্থিতিশীল। রাউজানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না আসায় গত ১৪ মাসে তিনবার থানার ওসিকে বদলি করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হাটহাজারী সার্কেল) কাজী মো. তারেক আজিজ জানিয়েছেন, “বাকি হত্যাকাণ্ডের জড়িতদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলমান আছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন।”

রাউজান উপজেলায় ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক সংঘাত ও গ্রুপিং রাজনীতির কারণে স্থানীয় মানুষদের জীবনযাত্রা ভয়ঙ্কর অবস্থায় পৌঁছেছে। স্থানীয়দের দাবি, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করলে অঞ্চলটি শান্তির পথে ফিরবে।

এমআর/সবা