- কাঁচাপাটের চড়া মূল্যে উদ্বিগ্ন পাটকল মালিকরা
- বর্তমানে মণপ্রতি পাটের দাম বেড়ে ৪৫০০ টাকা
- কাঁচাপাট সংকটে মিল বন্ধ ও লাখো শ্রমিক বেকারের শঙ্কা
- ১২ প্রতিষ্ঠানকে ২৯৮৪ টন পাট রপ্তানির অনুমতি সরকারের
দেশ থেকে কাঁচাপাট রপ্তানি সীমিত করেছে সরকার। এরপরেও সংকট দেখা দিয়েছে কাঁচাপাটের। মৌসুমের শুরুতেই সারা দেশে কাঁচাপাটের চড়া দাম উঠেছে এ বছর। বর্তমানে মণপ্রতি কাঁচাপাটের দাম বেড়ে সাড়ে ৪ হাজার টাকায় উন্নীত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কাঁচাপাট সংকটে দেশের পাটকলগুলো বন্ধ ও লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে উদ্বিগ্ন পাটকল মালিকরা। বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) চেয়ারম্যান তাপস প্রামাণিকের মতে, দাম বাড়ার ইস্যুতে অনেকে কাঁচাপাট মজুত করছেন, ফলে প্রকৃত মিলমালিকরা উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত পাট পাচ্ছেন না। এতে গোটা পাটশিল্প গভীর সংকটে পড়েছে। এদিকে বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) চেয়ারম্যান আবুল হোসেন বলছেন, পাটখাত টিকিয়ে রাখতে অবকাঠামো উন্নয়ন ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। কৃষকরা যাতে ন্যায্যমূল্য পান ও উৎপাদন ব্যয় মিটিয়ে মিলগুলো টিকে থাকতে পারে। তা না হলে রপ্তানি বাজারে টিকে থাকা কঠিন হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ব্যবসায়ীদের বৈঠকের সিদ্ধান্তানুযায়ী সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়েই দেশ থেকে কাঁচাপাট রপ্তানি সীমিত করা হয়েছে।
জানা যায়, কাঁচাপাট রপ্তানি করতে গেলে এখন সরকারের অনুমতি নিতে হয়। এ অবস্থায়ও দেশের ১২ প্রতিষ্ঠানকে ২ হাজার ৯৮৪ টন পাট রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। সম্প্রতি এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দেশ থেকে কাঁটাপাট রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিয়ে গত মাসে এক পরিপত্র জারি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বিদ্যমান রপ্তানি নীতি ২০২৪-২৭ -এ শর্ত সাপেক্ষে পণ্য রপ্তানির একটি তালিকা রয়েছে। এ তালিকায় এতদিন কাঁচাপাট ছিল না। রপ্তানি নীতি সংশোধন করে পরিপত্রে শর্ত যুক্ত পণ্য তালিকার ১৯ নম্বর ক্রমিকে কাঁচাপাট অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে কমছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এই খাত থেকে আয় হয়েছিল ১১৬ কোটি মার্কিন ডলার। পরের বছর তা কমে দাঁড়ায় ১১৩ কোটি ডলারে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয় ৯১১ দশমিক ৫১ মিলিয়ন ডলার, ২০২৩-২৪ সালে ৮৫৫ দশমিক ২৩ মিলিয়ন ডলার এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আরও কমে দাঁড়িয়েছে ৮২০ দশমিক ১৬ মিলিয়ন ডলারে।
পাট অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত কৃষকরা প্রতি মণ পাট ৩ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি করেছিলেন। কিন্তু এখন প্রতি মণ পাটের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৩০০ থেকে ৪ হাজার ৫০০ টাকা। এই হঠাৎ দাম বৃদ্ধি ও বাজারে ঘাটতি পাটকল মালিকদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে। অনেকেই বলছেন, বছরের পর বছরেও এমন কঠিন পরিস্থিতি দেখা যায়নি, মৌসুমের মধ্যেই কাঁচামাল যেন হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো ব্যবসায়ী এবার অস্বাভাবিক পাট মজুতের অভিযোগও করছেন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই ধারা অব্যাহত থাকলে পাটের দাম ২০২১ সালের রেকর্ড ৬ হাজার ২০০ টাকাও ছাড়িয়ে যেতে পারে। তখনই দেশ প্রায় ৩০ শতাংশ বাজার হারিয়েছিল। সে সময়ে পলিপ্রোপিলিন সুতা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কারণ ক্রেতারা ব্যয়বহুল পাটজাত পণ্যের পরিবর্তে সস্তা বিকল্পে ঝুঁকেছিল। যার প্রভাবে দেশে পরবর্তীতে পাটের চাহিদা কমেছিল।
পাটকল মালিকরা বলছেন, সরকার কাঁচাপাট রপ্তানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ করলেও স্থানীয় বাজারে পাট কার্যত উধাও হয়ে গেছে। এ মৌসুমে দেশের পাটকলগুলো উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল জোগাড়ে হিমশিম খাচ্ছে।
বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএসএ) ও বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ) গত সপ্তাহে জরুরি বৈঠক করে কাঁচাপাটের সংকট, বাজার অস্থিরতা ও সরবরাহ ঘাটতি মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণের চেষ্টা করে। ওই সময় বিজেএসএ চেয়ারম্যান তপস প্রামাণিক বলেন, বাজারে এখন অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। অনেকে কাঁচাপাট মজুত করছেন, ফলে প্রকৃত মিলমালিকরা উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত পাট পাচ্ছেন না। এতে গোটা পাটশিল্প গভীর সংকটে পড়েছে। তিনি বলেন, যদি মিলগুলো কাঁচামাল না পায়, লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হবে, উৎপাদন বন্ধ হবে এবং দেশ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় উৎস হারাবে।
বিজেএমএ চেয়ারম্যান আবুল হোসেন বলেন, পাটখাত টিকিয়ে রাখতে অবকাঠামো উন্নয়ন ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। প্রতিবেশী দেশগুলোর মতো আধুনিক ডেটা সেন্টার ও পৃথক ‘জুট কমিশন’ গঠন করা দরকার। এছাড়া অন্য ফসলের মতো কাঁচাপাটেরও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করা দরকার, যাতে কৃষক ন্যায্যমূল্য পান ও উৎপাদন ব্যয় মিটিয়ে মিলগুলো টিকে থাকতে পারে। তা না হলে রপ্তানি বাজারে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। তারা এখন পাট রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন। অভ্যন্তরীণ বাজার স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত কাঁচাপাট রপ্তানিতে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারির দাবি জানিয়েছে বিজেএসএ ও বিজেএমএ উভয় সংগঠনই।
তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ব্যবসায়ীদের বৈঠকের সিদ্ধান্তানুযায়ী সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়েই দেশ থেকে কাঁচাপাট রপ্তানি সীমিত করা হয়েছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশন থেকে প্রাপ্ত আবেদন সাপেক্ষে ১২ প্রতিষ্ঠানকে রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ইন্টারন্যাশনাল জুট ট্রেডার্স ২০৮ টন, পপুলার জুট এক্সচেঞ্জ ৮২২ টন, সারতাজ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ৩৬৬ টন, রশ্মি কবির ১০৪ টন, জননী এন্টারপ্রাইজ ৫২ টন, শরীফ ট্রেড ভিলেজ ২৬ টন, দি ওয়ার্ল্ড জুট গার্ডেন ২৫ টন, আইডিয়াল ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ১৯২ টন, আরএস ট্রেডার্স ১৩০ টন, বুলবুল ট্রেডার্স ২৫ টন, জুটব ইম্পেক্স ১৩০ টন এবং এনএস জুট বেলিং ১০৪ টন পাট রপ্তানির অনুমতি পেয়েছে।
শিরোনাম
ধ্বংসের মুখে পাটশিল্প!
-
নিজস্ব প্রতিবেদক - আপডেট সময় : ০৭:৩৯:২০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৫
- ।
- 125
জনপ্রিয় সংবাদ
























