- তালিকা থেকে বাদ পড়ছেন অনেকে
- মনোনয়ন নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
- মনোনয়নবঞ্চিত নেতারা ক্ষোভ-দুঃখে ফুঁসছেন
- বিভিন্ন জেলায় মনোনয়ন বঞ্চিতদের সমর্থকদের বিক্ষোভ
- বিক্ষোভের ঘটনায় আটজনকে বহিষ্কার
দল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। দলের অবস্থা দুর্বল হয়ে যেতে পারে, এতে কোনো সন্দেহ নাই- ড. সাব্বির আহমেদ, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাবি
দলের মধ্যে ইউনিটিটা বজায় রাখতে হবে। যাকেই দিবে তার পক্ষে সবাইকে কাজ করতে হবে- আবদুস সালাম, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা
বিএনপির মনোনয়ন ঘোষণার পর বঞ্চিতদের বিক্ষোভের ঘটনায় এ পর্যন্ত আটজনকে বহিষ্কার করেছে দল। যদিও বিএনপি ও শরিক দলের নেতারা বলছেন, দল কিংবা জোটের হয়ে সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করবেন তারা। কেউ দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে বহিষ্কারসহ কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারিও দিয়েছে বিএনপি। তবে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বহিষ্কার স্থায়ী সমাধান নয়। দলের সংহতি ধরে রাখতে বঞ্চিতদের পুরস্কৃত করার পরামর্শ তাদের।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ২৩৭টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। প্রার্থীর তালিকায় বিপুলসংখ্যক তরুণ মুখ রয়েছে। রয়েছে অভিঞ্জ নেতারাও। তবে প্রার্থী তালিকায় কিছু বিতর্কিত নামও রয়েছে। আর তা নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। এর ফলে অনেক প্রার্থী বাদ পড়ছেন। একাধিক আসনে বিতর্কিতদের মনোনয়ন নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তবে সাংগঠনিক শাস্তির ভয়ে মনোনয়নবঞ্চিত নেতারা প্রকাশ্যে কঠোর কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও ভেতরে-ভেতরে ক্ষোভ-দুঃখে ফুঁসছেন। মনোনয়ন নিয়ে ক্ষোভ থেকে মঙ্গলবার মেহেরপুর, সাতক্ষীরা, চাঁদপুর, ময়মনসিংহ, মাদারীপুর, নাটোর ও নওগাঁয় বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশ, সড়ক-রেলপথ অবরোধ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। বিক্ষোভের মুখে মাদারীপুর-১ (শিবচর) আসনে কামাল জামান মোল্লার মনোনয়ন স্থগিত করেছে বিএনপি। ঢাকা-১২ আসনে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক সাইফুল আলমকে (নীরব) বিএনপি প্রার্থী মনোনীত করেছে। যার বিরুদ্ধে ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে দখল ও অর্থ উপার্জনের অভিযোগ উঠলে বিএনপি কমিটি ভেঙে দেয়। আবার তাকেই আবার মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। ঢাকা-১৫ আসনে প্রার্থী করা হয়েছে মো. শফিকুল ইসলাম খানকে। তাকে নিয়েও স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে নানা প্রশ্ন আছে। সেখানে যুবদল নেতা মামুন হাসান মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। ঢাকার পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জের দুটি আসনের প্রার্থিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সিলেট-৩ আসনে লন্ডনপ্রবাসী ও যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি মোহাম্মদ আবদুল মালিককে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি ১৯ বছর দেশে আসেননি। বিএনপির প্রার্থী তালিকায় ৮৩ জনই তরুণ প্রার্থী। নতুনদের অনেকের পারিবারিক রাজনৈতিক পটভূমি রয়েছে-যেমন বাবা সংসদ সদস্য ছিলেন বা স্বামী জনপ্রতিনিধি ছিলেন। ২৩৭ জনের মধ্যে নারী প্রার্থী মাত্র ১০ জন, সংখ্যালঘু প্রার্থী মাত্র ৪ জন। দলীয় সূত্রমতে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শিগগির দেশে ফিরতে পারেন। তা ভোটের তফসিল ঘোষণার দু-চার দিন আগে-পরেও হতে পারে। সে কারণেই আগেভাগে মনোনয়ন ঘোষণা করা হয়েছে। যাতে ক্ষোভ-বিক্ষোভ তফসিল ঘোষণার আগে প্রশমিত হয়ে যায় এবং তারেক রহমানের দেশে ফেরার পর কোনো প্রতিক্রিয়া না থাকে। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শরিকদের ৫৮ আসনে ছাড় দিয়েছিল বিএনপি। এর মধ্যে ২২টি আসন দিয়েছিল জামায়াতে ইসলামীকে। এবারের নির্বাচনে বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে জামায়াত। মেহেরপুরে বিএনপি মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী আমজাদ হোসেনের কার্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে জেলা বিএনপির সভাপতি জাবেদ মাসুদের সমর্থকরা। দল ২৩৭ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণার পরেই মুখোমুখি মনোনয়ন প্রত্যাশী ২ নেতা। সারাদেশেই এমন ঘটনা ঘটেছে। যেমন, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ায় বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর সমর্থকরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। চাঁদপুরে ফরিদগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এম এ হান্নানের সমর্থকরা ও সাতক্ষীরায় বিএনপি নেতা শহীদুল আলমের সমর্থকরা বাসস্ট্যান্ড-সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণার পর তৃণমূল বিএনপির এ অস্থিরতা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাব্বির আহমেদ বলছেন, এমন প্রতিক্রিয়া সাধারণ ঘটনা হলেও স্থানীয় রাজনীতিতে এর প্রভাব পড়বে। এতে নেতাকর্মীদের দলত্যাগের ঘটনা ঘটলে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘এটা তাদের আবারও ফাস্ট্রেট করবে এবং করাটাও স্বাভাবিক। একে করে দল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। দলের অবস্থা দুর্বল হয়ে যেতে পারে, এতে কোনো সন্দেহ নাই।’ কিন্তু মনোনয়ন বঞ্চিত নেতাদের অনেকেই আবার বলছেন দলের স্বার্থে মনোনীত প্রার্থীর জন্য সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করবেন তারা। বিএনপি চেয়ারপারসন উপদেষ্টা আবদুস সালাম যখন এ কথা বলছেন সে সময়ে তার আসনে জোট মনোনীত এনডিএমের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলছেন, মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে কেউ কাজ করলে দলই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম বলেন, ‘দলের মধ্যে ইউনিটিটা বজায় রাখতে হবে। যাকেই দিবে তার পক্ষে সবাইকে কাজ করতে হবে। কারণ এখন আমাদের গণতন্ত্রের উত্তরণটা মূল কথা।’ মনোনয়ন ঘিরে এমন বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু দেখছেন গণতান্ত্রিক দলের সাধারণ ঘটনা হিসেবে। বলছেন, সীতাকুণ্ড ও মেহেরপুরের ঘটনায় আট জনকে বহিষ্কার প্রমাণ করে দলের বিরুদ্ধে গেলে যেতে হবে কঠোর শাস্তির মধ্যে দিয়ে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘প্রার্থী ১০ জন, পাবে ১ জন। এখন ৯ জন যদি দলের শৃঙ্খলা না মেনে যদি কিছু করে তাহলে দল ব্যবস্থা নেবে। সুতরাং ডিসিপ্লেনের মধ্যে না থাকলে তাকে কঠিন সাজা দেয়া হবে।’ তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক সাব্বির আহমেদ বলছেন বহিষ্কার কোন স্থায়ী সমাধান বয়ে আনবে না। এতে দলের সংহতি নষ্ট হবে। দল ক্ষমতায় আসলে মনোনয়ন বঞ্চিতদের পুরস্কৃত করা হবে এমন প্রতিশ্রুতির দিয়ে নেতাকর্মীদের বোঝাপড়ায় নিয়ে আসার পরামর্শ দেন তিনি। অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, একেবারে সরাসরি শাস্তিতে না গিয়ে, যে প্রেক্ষাপটটা। এর দীর্ঘদিনের ত্যাগী কর্মী। প্রেক্ষাপটটা আপনাকে মাথায় রাখতে হবে। আরেকটা হচ্ছে অন্যভাবে তাদের রিওয়ার্ড দেয়ার প্রমিস করতে পারে।’ বিএনপি মনোনয়ন বঞ্চিতদের বিক্ষোভ কিংবা এ নিয়ে সৃষ্ট দলীয় কোন্দল কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে নির্বাচনি প্রচারণা জোরালে হলে তা আরো স্পষ্ট হবে।

























