প্রকৃতিতে শীতের আগমন, হিম হিম এই শীতে প্রকৃতি সেজে উঠে নতুন সাজে, হাজির হয় পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে, এই পরির্বতনের ছোঁয়া লাগে আমাদের দৈনিন্দন জীবনেও, যার প্রভাব দেখা যায় আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও কর্মজীবনে।
শীত কালে আবহাওয়ার পরির্বতনে আমাদের রুটিন মাফিক জীবনে দিনের শুরু হয় ভিন্ন ভাবে, ঠান্ডা হিম ভাব, কুয়াশাআচ্ছান্ন আবহাওয়া, গ্রীষ্মককালের তুলনায় ছোট দিন, খাদ্যাভ্যাসে পরির্বতন কখনো ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনে আবার কখনোবা এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে ব্যাক্তিজীবনে, যা অনেকক্ষেত্রে ব্যাক্তিকে মানসিক ভাবে বিষন্ন, উদ্বিগ্ন ও বির্পযস্ত করে তোলে।
কেউ কেউ এই পরির্বতনের সাথে খুব সহজেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয় আবার কারও জন্য এই অভিযোজন খুব কষ্টসাধ্য।
এই নেতিবাচক মানসিক অবস্থায় ব্যাক্তির মধ্যে ক্রমান্বয়ে কিছু লক্ষন দেখা যেতে থাকে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অত্যাধিক মন খারাপ থাকা, দুঃচিন্তা, খিটখিটে মেজাজ, হঠাৎ রেগে যাওয়া, হতাশাবোধ, অপরাধবোধ, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, ঘুমের ব্যাঘাত বা অতিনিদ্রা, ক্লান্তিবোধ, দৈনিন্দন কাজের প্রতি অনীহা, সামাজিক সর্ম্পক এড়িয়ে চলা, যৌন অনীহা ইত্যাদি।

এই বিরূপ মানসিক অবস্থার পেছনের কারন স্বরূপ বলা যায় যে ঋতু পরির্বতনের ফলে শীতকালে অপরিমিত সূর্যের আলো মানব শরীরে সেরোটোনিনের লেভেল কমিয়ে দেয় ও নিউরোট্রান্সমিটারের উপর প্রভাব বিস্তার করে যার ফলে ব্যক্তির মধ্যে বিষণ্ণতাসহ উপোরোক্ত লক্ষন দেখা যায়, এছাড়াও পাইওনিয়াল গ্ল্যান্ড থেকে নিঃসৃত মেলাটোনিন হরমোন যা অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে বেশি উৎপন্ন হয় এবং ঘুম ও মেজাজের উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
ঋতু পরির্বতনের ফলে উদ্ভুদ্ধ এসকল নেতিবাচক মানসিক অবস্থা থেকে পরিত্রান পেতে হলে যা করা যায়-
* যথা সম্ভব সুর্যের আলো গ্রহন করা, ঘরে পর্যাপ্ত সুর্যের আলোর প্রবেশ নিশ্চিত করা, বাইরে কোমল সুর্যের আলোয় বেড়ানো, ঘরের দেয়ালে হাল্কা ও উজ্জ্বল আলোর ব্যাবহার কাজে আসতে পারে।
* নিয়মিত শরীরচর্চা করা, ঋতু পরির্বতনের সাথে নেতিবাচক মানসিক অবস্থা নিয়ন্ত্রনে শরীরচর্চা শক্তিশালী ভুমিকা পালন করে, নিয়মিত শরীরচর্চা সেরোটোনিন ও এন্ড্রাফিন্সের নিঃসরণ বাড়ায় যা মানসিক প্রফুল্লতা আনে,এছাড়াও নিয়মিত শরীরচর্চা ঘুম ও ক্লান্তিবোধ উন্নয়নে অত্যাধিক কার্যকর।
* শীতকালে আমাদের খাদ্যাভ্যাসে পরির্বতন আসে, এসময় পর্যাপ্ত পরিমান টাটকা ফলমুল, সবজি, পরিমিত আহার দৈহিক শক্তি বাড়ায় ও আকস্মিক মেজাজের পরির্বতন কমায়। এছাড়াও ওমেগা-৩ সম্বলিত খাবার যেমন সামুদ্রিক মাছ, বাদাম, আখরোট, সয়াবিন, তিল, তিসি, বিষন্নতা কাটাতে এ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধের চেয়ে অধিক কার্যকরী।
* দৈনিন্দন জীবনে অত্যাধিক মাত্রার “চাপ” বিষণ্ণতা ও উদ্বিগ্নতা বাড়ায়, তাই মানসিক চাপ বাড়ায় এমন কারন গুলো যেমন অতিরিক্ত কাজের দায়িত্ব, অসহযোগী পারিবারিক সর্ম্পক, অপ্রতুল সামাজিক যোগাযোগ, ভারসাম্যহীন জীবন ব্যাবস্থা ইত্যাদি খুজে বের করা। দৈনিন্দন জীবনে চাপ মোকাবেলায় আবেগউন্মুখ না হয়ে “সমাধানমুখি” পদ্ধতি অবলম্বন করা প্রয়োজন।
* দৃঢ়-সহযোগী পারিবারিক বন্ধন ও বন্ধুত্বপূর্ণ সামাজিক সর্ম্পক যেকোন বিরূপ মানসিক বির্পযয় মোকাবেলায় সর্বাপেক্ষা বেশি ভুমিকা পালন করে, তাই এ সময়, পরিবার পরিজন ও বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো, ইতিবাচক অনুভুতি ভাগ করে নেয়া, পারস্পরিক বোঝাপড়া, বেড়াতে যাওয়া মানসিক অবস্থার উন্নয়ন ও আত্মবিশ্বাস অর্জনে অগ্রণী ভুমিকা রাখে। এছাড়াও কাজের প্রতি অনীহা কমাতে তাদের সাহায্য নেয়া প্রেরনাউদ্দীপক।
* সর্বোপরি শীতকালীন মানসিক পরির্বতনের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর জন্য ইতিবাচক চিন্তাভাবনা, আনন্দদায়ক কার্যাবলীর সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখা, সামাজিক যোগাযোগ অক্ষুন্ন রাখা জরুরি।
*এছাড়াও এসময় বিভিন্ন ধরনের প্রশান্তিদায়ক পদ্ধতি যেমন ইমাজিনারি রিলেক্সেশন (Imaginary relaxation), ব্রিদিং রিলাক্সেশন (Breathing relaxation), প্রগ্রেসিভ মাসল রিলাক্সেশন (Progressive muscle relaxation), মেডিটেশন ফলপ্রসু হয়।
লেখক : ফারহানা নাজনীন (মিতু), এসিস্ট্যান্ট ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


























