০১:১৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ঋণখেলাপির গভীর খাদে দেশের ব্যাংক খাত

  • চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে ঋণের পরিমাণ ১৮ লক্ষাধিক
  • একই সময়ে গত বছরে ছিল ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা
  • খেলাপি ঋণ এখন ৬ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা

‘শুধু খেলাপি নয়, রাইট-অফ, পুনঃতফসিল, স্থগিত এবং আদালত-আটকে থাকা ঋণ মিলিয়ে ‘ডিস্ট্রেসড অ্যাসেট’ শিগগিরই ১০ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে’
– বাংলাদেশ ব্যাংক
‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবই সবচেয়ে বড় সমস্যা। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা ছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া অসম্ভব’
– ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী, সাবেক মহাপরিচালক, বিআইবিএম

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত যেন ঋণখেলাপির এক গভীর খাদে পড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে সর্বোচ্চ। মাত্র একবছরে এই অঙ্ক বেড়েছে প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। একই সময়ে গত বছরে এর পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে, শুধু খেলাপি নয়, রাইট-অফ, পুনঃতফসিল, স্থগিত এবং আদালত-আটকে থাকা ঋণ মিলিয়ে ‘ডিস্ট্রেসড অ্যাসেট’ শিগগিরই ১০ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এদিকে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরীর মতে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবই সবচেয়ে বড় সমস্যা। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা ছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া অসম্ভব।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ, বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম সর্বোচ্চ হার। অপরদিকে, গত বছরের একই সময়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ ছিল। অর্থাৎ একবছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ প্রায় দেড়গুণের বেশি বেড়ে গেছে, যা ব্যাংকিং খাতের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত সর্বশেষ হিসাব বলছে, জুন মাসের তুলনায় প্রায় সব সূচকেই খেলাপি ঋণ ও সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে।
খেলাপির হার দ্বিগুণের বেশি : গত বছরের সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১৬.৯৩ শতাংশ। একবছরের ব্যবধানে এ হার লাফিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫.৭৩ শতাংশে, যা কার্যত দ্বিগুণেরও বেশি। তার আগের দুই ত্রৈমাসিকেও পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি দেখা যায়, মার্চ ২০২৫: খেলাপির হার ২৪.১৩ শতাংশ, জুন ২০২৫: খেলাপির হার ৩৪.৪০ শতাংশ, সেপ্টেম্বর ২০২৫: খেলাপির হার ৩৫.৭৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণ দীর্ঘদিন ধরে গোপন ছিল। কঠোর নজরদারি, নতুন নির্দেশনা এবং বিশেষ অডিটের ফলে বর্তমানে আসল অবস্থাটি প্রকাশ পাচ্ছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের শেষে ব্যাংকগুলোর মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা। জুনে এই পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ৬৮ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে শ্রেণিকৃত বা খেলাপি ঋণ উঠেছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকার ওপরে। জুন মাসের পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৮ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা, অর্থাৎ মাত্র তিন মাসে খেলাপি বেড়েছে ৩৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।
প্রভিশন ঘাটতি আরও বেড়েছে : খেলাপি ঋণ মোকাবিলায় ব্যাংকগুলোকে যেসব প্রভিশন (সংরক্ষণ) রাখতে হয়, তাতে বড় ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে প্রয়োজনীয় প্রভিশন: ৪ লাখ ৭৪ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা, রক্ষিত প্রভিশন: ১ লাখ ৩০ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা। এতে প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৪ হাজার ২৩১ কোটি টাকা, যা জুনের তুলনায় আরও ২৪ হাজার ৫১১ কোটি টাকা বেশি।
স্থগিত সুদও বেড়েছে : খেলাপি ঋণের কারণে যেসব সুদ আদায় করা যায় না, সেগুলো স্থগিত সুদ হিসেবে ধরা হয়। সেপ্টেম্বর মাসের শেষে স্থগিত সুদ দাঁড়িয়েছে ৯৮ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা, যা তিন মাসে বেড়েছে ৫ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা।
নিট খেলাপি ঋণও ঊর্ধ্বমুখী : প্রভিশন ও স্থগিত সুদ বাদ দিয়ে নিট বা প্রকৃত খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ১৫ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা। এটি জুনের তুলনায় বেড়েছে ২৭ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা। নেট খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ২৬.৪০ শতাংশ, যা তিন মাস আগেও ছিল ২৫.০৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকিং খাতের কর্মকর্তারা বলছেন, ১৬ বছর ধরে চলা দুর্বল তদারকি, রাজনৈতিক প্রভাব, অসৎ ব্যবসায়ীদের অপকৌশল এবং ঋণ পুনঃতফসিলে অনিয়ম পুরো খাতটিকে অকার্যকর করে তুলেছে। এছাড়া গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বেশ কয়েকটি বড় গ্রুপ হঠাৎ করে ঋণ পরিশোধে অস্বীকৃতি জানানো বা সময়ক্ষেপণের কৌশল নেয়, যা এনপিএলের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে।
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়, শুধু খেলাপি নয়, রাইট-অফ, পুনঃতফসিল, স্থগিত এবং আদালত-আটকে থাকা ঋণ মিলিয়ে ‘ডিস্ট্রেসড অ্যাসেট’ শিগগিরই ১০ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই পরিস্থিতি দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে শুধু ঝুঁকির মুখে ফেলেই দিচ্ছে না, বরং সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে, কীভাবে এই অকার্যকর সম্পদ নিয়ন্ত্রণে আনা হবে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে পরিস্থিতি ভয়াবহ : গত বছরের জুন মাসের শেষে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে খেলাপি: ১,৫২,৭৫৫ কোটি টাকা। মোট বিতরণকৃত ঋণের ৪৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এত বড় পরিমাণ খেলাপি শুধু প্রতিষ্ঠানের আর্থিক শক্তিকেই দুর্বল করছে না, বরং জনগণের আমানত সুরক্ষার প্রশ্নও সামনে নিয়ে আসছে।
বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ৪ লাখ ২৫ হাজার কোটি : বেসরকারি ব্যাংকগুলোর চিত্রও খুব ভালো নয়। খেলাপি ঋণ: ৪,২৫,৬৬০ কোটি টাকা। এনপিএল হার: ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ। এর বড় অংশই কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, বিশেষত এস আলম গ্রুপ ও বেক্সিমকো-সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোতে কেন্দ্রীভূত। এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন কয়েকটি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকে খেলাপির হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং পূর্ববর্তী রাজনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ছায়া থাকা অবস্থায় অনিয়মের মাত্রা বেশি ছিল।
ইসলামী ব্যাংকের এমডি ও সিইও মো. ওমর ফারুক খান বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক আইনজীবী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিদেশি সম্পদ পুনরুদ্ধারে চুক্তি করছি। মূল লক্ষ্য হচ্ছে প্রকৃত ক্ষতি কমানো এবং নগদ আদায় বাড়ানো। তিনি আশা করছেন, আগামী এক বছরের মধ্যে তাদের ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার ৫০ শতাংশ থেকে কমে ৩৫ শতাংশে নামানো সম্ভব হতে পারে। তবে তিনি এটাও মানছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ব্যবসায়িক কার্যক্রম ধীর হওয়ায় ঋণ পুনরুদ্ধার কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিপরীত চিত্র বিদেশি ব্যাংকগুলোর : খেলাপির হার মাত্র ৬ দশমিক ১ শতাংশ। মোট খেলাপি পরিমাণ: ২,৯৫২ কোটি টাকা। এই বৈপরীত্যই প্রমাণ করে যে, ব্যাংক পরিচালনায় সুশাসন থাকলে ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, এখন দেশে প্রায় ৩৫ শতাংশ ঋণ নন-পারফর্মিং। এটি দীর্ঘমেয়াদে মারাত্মক আঘাত হানবে। ব্যাংকগুলোর আয় কমবে ও প্রভিশন বাড়বে। ফলে মূলধনের ভিত্তি কমে যাবে। এতে করে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দ্বিধায় পড়বেন এবং আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো লেনদেন খরচ বাড়িয়ে দেবে।” তিনি আরও বলেন, “দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবই সবচেয়ে বড় সমস্যা। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা ছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া অসম্ভব।
১৯৯৯ সালে ব্যাংকখাতে খেলাপির হার ছিল রেকর্ড ৪১ দশমিক ১ শতাংশ। এরপর ধারাবাহিক সংস্কারের ফলে ২০১১ সালে কমে আসে ৬ দশমিক ১ শতাংশে। কিন্তু গত ১৩ বছরে আবার সেই পুরনো সংকটই ফিরে এসেছে, অধিকতর বিস্তৃত ও গভীর রূপ নিয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে ব্যাংকিং খাতে আস্থাহীনতা আমানতকারী থেকে শুরু করে বিনিয়োগকারীদের মাঝেও ব্যাপক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করবে। এমনকি ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও বড় ঝুঁকিতে পড়বে।

 

জনপ্রিয় সংবাদ

ঋণখেলাপির গভীর খাদে দেশের ব্যাংক খাত

আপডেট সময় : ০৭:৩১:২৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৫
  • চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে ঋণের পরিমাণ ১৮ লক্ষাধিক
  • একই সময়ে গত বছরে ছিল ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা
  • খেলাপি ঋণ এখন ৬ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা

‘শুধু খেলাপি নয়, রাইট-অফ, পুনঃতফসিল, স্থগিত এবং আদালত-আটকে থাকা ঋণ মিলিয়ে ‘ডিস্ট্রেসড অ্যাসেট’ শিগগিরই ১০ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে’
– বাংলাদেশ ব্যাংক
‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবই সবচেয়ে বড় সমস্যা। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা ছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া অসম্ভব’
– ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী, সাবেক মহাপরিচালক, বিআইবিএম

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত যেন ঋণখেলাপির এক গভীর খাদে পড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে সর্বোচ্চ। মাত্র একবছরে এই অঙ্ক বেড়েছে প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। একই সময়ে গত বছরে এর পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে, শুধু খেলাপি নয়, রাইট-অফ, পুনঃতফসিল, স্থগিত এবং আদালত-আটকে থাকা ঋণ মিলিয়ে ‘ডিস্ট্রেসড অ্যাসেট’ শিগগিরই ১০ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এদিকে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরীর মতে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবই সবচেয়ে বড় সমস্যা। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা ছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া অসম্ভব।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ, বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম সর্বোচ্চ হার। অপরদিকে, গত বছরের একই সময়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ ছিল। অর্থাৎ একবছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ প্রায় দেড়গুণের বেশি বেড়ে গেছে, যা ব্যাংকিং খাতের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত সর্বশেষ হিসাব বলছে, জুন মাসের তুলনায় প্রায় সব সূচকেই খেলাপি ঋণ ও সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে।
খেলাপির হার দ্বিগুণের বেশি : গত বছরের সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১৬.৯৩ শতাংশ। একবছরের ব্যবধানে এ হার লাফিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫.৭৩ শতাংশে, যা কার্যত দ্বিগুণেরও বেশি। তার আগের দুই ত্রৈমাসিকেও পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি দেখা যায়, মার্চ ২০২৫: খেলাপির হার ২৪.১৩ শতাংশ, জুন ২০২৫: খেলাপির হার ৩৪.৪০ শতাংশ, সেপ্টেম্বর ২০২৫: খেলাপির হার ৩৫.৭৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণ দীর্ঘদিন ধরে গোপন ছিল। কঠোর নজরদারি, নতুন নির্দেশনা এবং বিশেষ অডিটের ফলে বর্তমানে আসল অবস্থাটি প্রকাশ পাচ্ছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের শেষে ব্যাংকগুলোর মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা। জুনে এই পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ৬৮ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে শ্রেণিকৃত বা খেলাপি ঋণ উঠেছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকার ওপরে। জুন মাসের পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৮ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা, অর্থাৎ মাত্র তিন মাসে খেলাপি বেড়েছে ৩৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।
প্রভিশন ঘাটতি আরও বেড়েছে : খেলাপি ঋণ মোকাবিলায় ব্যাংকগুলোকে যেসব প্রভিশন (সংরক্ষণ) রাখতে হয়, তাতে বড় ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে প্রয়োজনীয় প্রভিশন: ৪ লাখ ৭৪ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা, রক্ষিত প্রভিশন: ১ লাখ ৩০ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা। এতে প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৪ হাজার ২৩১ কোটি টাকা, যা জুনের তুলনায় আরও ২৪ হাজার ৫১১ কোটি টাকা বেশি।
স্থগিত সুদও বেড়েছে : খেলাপি ঋণের কারণে যেসব সুদ আদায় করা যায় না, সেগুলো স্থগিত সুদ হিসেবে ধরা হয়। সেপ্টেম্বর মাসের শেষে স্থগিত সুদ দাঁড়িয়েছে ৯৮ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা, যা তিন মাসে বেড়েছে ৫ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা।
নিট খেলাপি ঋণও ঊর্ধ্বমুখী : প্রভিশন ও স্থগিত সুদ বাদ দিয়ে নিট বা প্রকৃত খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ১৫ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা। এটি জুনের তুলনায় বেড়েছে ২৭ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা। নেট খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ২৬.৪০ শতাংশ, যা তিন মাস আগেও ছিল ২৫.০৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকিং খাতের কর্মকর্তারা বলছেন, ১৬ বছর ধরে চলা দুর্বল তদারকি, রাজনৈতিক প্রভাব, অসৎ ব্যবসায়ীদের অপকৌশল এবং ঋণ পুনঃতফসিলে অনিয়ম পুরো খাতটিকে অকার্যকর করে তুলেছে। এছাড়া গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বেশ কয়েকটি বড় গ্রুপ হঠাৎ করে ঋণ পরিশোধে অস্বীকৃতি জানানো বা সময়ক্ষেপণের কৌশল নেয়, যা এনপিএলের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে।
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়, শুধু খেলাপি নয়, রাইট-অফ, পুনঃতফসিল, স্থগিত এবং আদালত-আটকে থাকা ঋণ মিলিয়ে ‘ডিস্ট্রেসড অ্যাসেট’ শিগগিরই ১০ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই পরিস্থিতি দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে শুধু ঝুঁকির মুখে ফেলেই দিচ্ছে না, বরং সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে, কীভাবে এই অকার্যকর সম্পদ নিয়ন্ত্রণে আনা হবে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে পরিস্থিতি ভয়াবহ : গত বছরের জুন মাসের শেষে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে খেলাপি: ১,৫২,৭৫৫ কোটি টাকা। মোট বিতরণকৃত ঋণের ৪৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এত বড় পরিমাণ খেলাপি শুধু প্রতিষ্ঠানের আর্থিক শক্তিকেই দুর্বল করছে না, বরং জনগণের আমানত সুরক্ষার প্রশ্নও সামনে নিয়ে আসছে।
বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ৪ লাখ ২৫ হাজার কোটি : বেসরকারি ব্যাংকগুলোর চিত্রও খুব ভালো নয়। খেলাপি ঋণ: ৪,২৫,৬৬০ কোটি টাকা। এনপিএল হার: ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ। এর বড় অংশই কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, বিশেষত এস আলম গ্রুপ ও বেক্সিমকো-সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোতে কেন্দ্রীভূত। এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন কয়েকটি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকে খেলাপির হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং পূর্ববর্তী রাজনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ছায়া থাকা অবস্থায় অনিয়মের মাত্রা বেশি ছিল।
ইসলামী ব্যাংকের এমডি ও সিইও মো. ওমর ফারুক খান বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক আইনজীবী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিদেশি সম্পদ পুনরুদ্ধারে চুক্তি করছি। মূল লক্ষ্য হচ্ছে প্রকৃত ক্ষতি কমানো এবং নগদ আদায় বাড়ানো। তিনি আশা করছেন, আগামী এক বছরের মধ্যে তাদের ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার ৫০ শতাংশ থেকে কমে ৩৫ শতাংশে নামানো সম্ভব হতে পারে। তবে তিনি এটাও মানছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ব্যবসায়িক কার্যক্রম ধীর হওয়ায় ঋণ পুনরুদ্ধার কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিপরীত চিত্র বিদেশি ব্যাংকগুলোর : খেলাপির হার মাত্র ৬ দশমিক ১ শতাংশ। মোট খেলাপি পরিমাণ: ২,৯৫২ কোটি টাকা। এই বৈপরীত্যই প্রমাণ করে যে, ব্যাংক পরিচালনায় সুশাসন থাকলে ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, এখন দেশে প্রায় ৩৫ শতাংশ ঋণ নন-পারফর্মিং। এটি দীর্ঘমেয়াদে মারাত্মক আঘাত হানবে। ব্যাংকগুলোর আয় কমবে ও প্রভিশন বাড়বে। ফলে মূলধনের ভিত্তি কমে যাবে। এতে করে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দ্বিধায় পড়বেন এবং আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো লেনদেন খরচ বাড়িয়ে দেবে।” তিনি আরও বলেন, “দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবই সবচেয়ে বড় সমস্যা। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা ছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া অসম্ভব।
১৯৯৯ সালে ব্যাংকখাতে খেলাপির হার ছিল রেকর্ড ৪১ দশমিক ১ শতাংশ। এরপর ধারাবাহিক সংস্কারের ফলে ২০১১ সালে কমে আসে ৬ দশমিক ১ শতাংশে। কিন্তু গত ১৩ বছরে আবার সেই পুরনো সংকটই ফিরে এসেছে, অধিকতর বিস্তৃত ও গভীর রূপ নিয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে ব্যাংকিং খাতে আস্থাহীনতা আমানতকারী থেকে শুরু করে বিনিয়োগকারীদের মাঝেও ব্যাপক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করবে। এমনকি ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও বড় ঝুঁকিতে পড়বে।