মো. আ. মালেক আখন্দ
তিন লাখের বেশি শূন্য পদ থাকলেও সরকারি চাকরির জন্য লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার হাহাকার করছে। সরকারি চাকরির পদ শূন্য থাকলেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পদের চেয়ে কর্মকর্তা বেশি। দেশে সরকারি চাকরির পদের সংখ্যা ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৯২৭ জন। বর্তমানে ১২ লাখ ১৭ হাজার ৬২ জন চাকরিজীবী কর্মরত রয়েছেন। তাহলে শূন্যপদ ৩ লাখের বেশি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বর্তমানে প্রশাসনে সচিবের পদ ৬৯টি। অথচ এই পদে রয়েছেন ৮৩ জন। অতিরিক্ত সচিবের ১৪০টি পদের বিপরীতে ৩৮৭, যুগ্ম সচিবের ৩৩২টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৯৩৯ জন। ৪৩০টি সুপার নিউমারি পদসহ উপসচিবের ১৪২৮টি পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন ১৪৭৭ জন। পদের চেয়ে কর্মকর্তা অধিক হওয়ায় সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় হচ্ছে। সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বেশির ভাগই দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণে ব্যস্ত। প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ঠিক রাখতে একই পদে অতিরিক্ত কর্মকর্তার পদায়ন আসলে কতটুকু যৌক্তিক? কর্মকর্তারা সরকারি বেতন-ভাতার পাশাপাশি প্রশিক্ষণভাতা পাচ্ছেন, যার পরিমাণ অনেক সময় মূল বেতনেরও বেশি। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও পেনশনে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মোট বাজেটের ২৫ শতাংশের বেশি। তার পরও অতিরিক্ত পদোন্নতির ফলে বাড়ছে সরকারি রাজস্ব ব্যয়।
প্রশাসনের ৮০ শতাংশ কর্মকর্তা পদোন্নতি পেলেও তাদের আগের অধস্তন পদের কাজই করতে হচ্ছে। অনেক কর্মকর্তার সচিবালয়ে বসারও জায়গা নেই। এক রুমে ভাগাভাগি করে বসতে হয় অনেক কর্মকর্তাকে। উপসচিব থেকে সচিব, এই শীর্ষ চার পদের বিপরীতে বাড়তি কর্মকর্তা দুই থেকে তিন গুণ। এতে প্রশাসনিক জটিলতা বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য বেতন-ভাতায় সরকারকে গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণে অনুবিভাগে দায়িত্ব পালন করছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আব্দুস সবুর। সচিব হিসেবে পদোন্নতির পর তাকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ দেওয়া হয় ৫ সেপ্টেম্বর। কিন্তু সপ্তাহ না ঘুরতেই আবার আগের পদেই সংযুক্ত করা হয় তাকে। পদের চেয়ে বেশি পদোন্নতির ফলেই এই পরিস্থিতি। অন্যদিকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্য, ট্যাক্স, রেলওয়ে, আনসার, কাস্টমস, প্রকৌশলী, কৃষিবিদসহ প্রায় ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তাদের উপসচিবের তদূর্ধ্ব যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিবের পদোন্নতির সময় কোটার ফাঁদে ফেলে বঞ্চিত করা হয়।
প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে অন্যান্য ক্যাডার যুক্ত করার কারণে মাঠ প্রশাসনে দায়িত্ব পালনে অনেক কর্মকর্তাকে হোঁচট খেতে হচ্ছে। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দ্বন্দ্ব প্রায়ই ঘটে যাচ্ছে, ফলে অনেক উপজেলায় সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা ফেরত যায়। বছরের পর বছর উন্নয়নকাজ বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলেও অভিযোগ বিদ্যমান। প্রশাসনের একচেটিয়া স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে পদোন্নতি, পদায়নের ক্ষেত্রে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য আরো বাড়ছে। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশও অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষিত হচ্ছে। যোগ্যতা, জ্যেষ্ঠতার মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। অনিয়ন্ত্রিত পদোন্নতির প্রক্রিয়ায় কনিষ্ঠরাই অনেক ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠদের নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ হয়ে বসে আছেন। ক্যারিয়ার পরিকল্পনা না থাকায় এমন বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। প্রশাসনের কাঠামোসহ পদোন্নতি, পদায়নের ক্ষেত্রে আমূল সংস্কারের তাগিদ রয়েছে বিশেষজ্ঞ মহলের। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকেই প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে তৎকালীন অন্যান্য ক্যাডারের বৈষম্য চলে আসছে। এই বৈষম্য নিরাসনে একাধিক কমিটি ও কমিশনের সুপারিশ হিমাগারে পড়ে আছে। পদোন্নতির সময় কথিত কোটার দোহাই দিয়ে চলে বঞ্চনার খেলা। এতে প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে নিয়োগপ্রাপ্তরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। যদিও মহামান্য বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট কোটা পদ্ধতি অনুসরণের বিপক্ষে রায় দিয়েছেন। সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের ২০০৩ সালের রায়ে বলা হয়েছে, যখন কোনো কর্মকর্তা উপসচিব হবেন, তখন তার পূর্ববর্তী ক্যাডার বিলুপ্ত হবে। তখন তিনি অন্যান্য উপসচিবের সঙ্গে একীভূত হবেন। উপসচিব থেকে তদূর্ধ্ব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে চকরিতে প্রবেশকালীন ক্যাডার বিবেচিত হবে না। কিন্তু এই রায় না মেনে কথিত কোটা পদ্ধতি বহাল রাখা হলেও তা মানা হচ্ছে না। এর মধ্যে পদ না থাকলেও ফের শুরু হয়েছে দুই স্তরের পদোন্নতির প্রক্রিয়া।
মন্ত্রিপরিষদসচিব, মুখ্য সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিবের পদটি সব সময়ই প্রশাসন ক্যাডার দ্বারা পূরণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর বাইরে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ডিডিএলজি, জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার ইত্যাদি পদও প্রশাসন ক্যাডারভুক্ত পদ। অন্যান্য ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা শুধু মন্ত্রণালয় বা মন্ত্রণালয়ের অধীনে কম গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর, অধিদপ্তর, সংস্থায় সমমানের পদে নিয়োগ লাভ করতে পারেন। পরিসংখ্যানে বলা হয়, গত ১০ বছরে ২৫৫ জন কর্মকর্তা সিনিয়র সচিব বা সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। এর মধ্যে ২৩২ জনই প্রশাসন ক্যাডারের। শতাংশ হারে এটি ৯ শতাংশ। গ্রেড-১ ভুক্ত কর্মকর্তা বিগত ৫ বছরে হয়েছেন ৭৬ জন। এর মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে মাত্র একজন। গত ১২ মে অতিরিক্ত সচিব পদে সর্বশেষ পদোন্নতি দেওয়া হয় ১১৫ জনকে। এর মধ্যে ১০৩ জনই প্রশাসন ক্যাডারের। অন্যান্য ক্যাডারের ১২ জন। অর্থাৎ ১০.৪৩ শতাংশ। গত ৪ সেপ্টেম্বর যুগ্ম সচিব পদে সর্বশেষ পদোন্নতি দেওয়া হয়, যেখানে ২২১ জনের মধ্যে ১৯৭ জনই প্রশাসন ক্যাডারের বাকি ২৫ জন অন্যান্য ক্যাডারের, যার হার ১১.৩০ শতাংশ।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়ার মতে, বেশির ভাগ ক্যাডারের পদোন্নতি এতই সীমিত যে অনেক ক্যাডার মধ্য পর্যায়েই যেতে পারেন না। যদি আমরা দু-একটা ক্যাডারে পদ না থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি দিই, তাহলে অন্যান্য ক্যাডারে পদোন্নতি দিতে অসুবিধা কোথায়।
যা হোক, একই পদে একাধিক কর্মকর্তা পদায়নের ফলে যে প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে এবং বিপুল পরিমাণ সরকারি রাজস্বের অপচয় হচ্ছে, সেদিকে সরকারের শীর্ষ মহলের নজরদারি খুবই জরুরি।

























