- ঢাকা-কক্সবাজারসহ দেশের ৬ রুটে কার্যকর শুরু
- জনগুরুত্বপূর্ণ ৬ রুটের ১১টি সেতুতে যুক্ত হলো ‘পয়েন্ট চার্জ’
- ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে স্নিগ্ধা আসনে এখন গুণতে হচ্ছে জনপ্রতি ৯৪৩ টাকা
- ঢাকা-কক্সবাজার রুটে জনপ্রতি ১৪৪৯ টাকা, এসি বার্থে ২৬৫৬ টাকা
‘রেল স্বল্প আয়ের মানুষের সবচেয়ে সাশ্রয়ী পরিবহন। বারবার কৌশলে ভাড়া বাড়ানো সাধারণ মানুষের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। সরকার চাইলে রেলের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি কমিয়ে রাজস্ব বাড়াতে পারে’
– এস এম নাজের হোসাইন, সহ-সভাপতি, ক্যাব
‘সব রুটে নয়, নির্দিষ্ট কিছু রুটে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এটি সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নেওয়া হয়েছে এবং পুরোনো সেতুগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় মেটাতেই এই ব্যবস্থা’
– মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, প্রধান বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক, পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে
‘অল্প মূল্য, নিরাপদ গন্তব্য’। স্বল্প আয়ের মানুষেরা এই মূলমন্ত্রকে ধারণ করে দ্রুত ও নিরাপদ ভ্রমণের জন্য বেছে নিয়েছে একমাত্র বাহন ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে’। কিন্তু সড়ক-মহাসড়কের চাপ এড়াতে সাধারণ যাত্রীরা সময় বাঁচাতে চাহিদার শীর্ষে তুলে এনেছে রেলরুটকে। যাত্রীদের চাহিদা বিবেচনায় সারাদেশেই রেলসংযোগ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সময়ের ব্যবধানে সপরিবারে স্বাচ্ছন্দে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার মিশন শুরু করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। যাত্রী সাধারণের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় রেলের কদরও বাড়ে কয়েকগুণ। আর এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে দেশের যাত্রী সাধারণকে অনেকটা অন্ধকারে রেখেই পূর্ব নোটিশ না দিয়েই কৌশলে ঢাকা-কক্সবাজারসহ দেশের ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ রুটে ট্রেনের ভাড়া বাড়িয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। জনগুরুত্বপূর্ণ ৬টি রুটের ১১টি সেতুতে পয়েন্ট চার্জের নামে যুক্ত করা হয়েছে বাড়তি টাকা। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ট্রেনের স্নিগ্ধা আসনে পূর্ব নির্ধারিত ৮৫৫ টাকার বিপরীতে যাত্রী সাধারণকে জনপ্রতি বর্তমানে গুণতে হচ্ছে ৯৪৩ টাকা। এছাড়া ঢাকা-কক্সবাজারে স্নিগ্ধা আসনে ১ হাজার ৩২২ টাকার বিপরীতে এখন জনপ্রতি গুণতে হচ্ছে ১ হাজার ৪৪৯ টাকা। একই রুটের এসি বার্থে ২ হাজার ৪৩০ টাকার বিপরীতে জনপ্রতি ২২৬ টাকা বাড়িয়ে ২ হাজার ৬৫৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা শনিবার (২০ ডিসেম্বর) থেকে নতুন এ ভাড়া কার্যকর শুরু করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। সাধারণ যাত্রীরা বলছেন, আগাম নোটিশ না দিয়ে বা মুক্ত আলোচনা না করে হঠাৎ দেশের জনগুরুত্বপূর্ণ ৬টি রুটে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো রেলভ্রমণে যাত্রীদের নিরুৎসাহিত করবে। বিষয়টি পূণঃবিবেচনার দাবি জানিয়েছেন রেলের যাত্রীরা। ক্যাব’র সহ-সভাপতি নাজের হোসাইনের মতে, রেল স্বল্প আয়ের মানুষের সবচেয়ে সাশ্রয়ী পরিবহন। বারবার কৌশলে ভাড়া বাড়ানো সাধারণ মানুষের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। সরকার চাইলে রেলের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি কমিয়ে রাজস্ব বাড়াতে পারে। তবে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলছেন, সব রুটে নয়, নির্দিষ্ট কিছু রুটে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এটি সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নেওয়া হয়েছে এবং পুরোনো সেতুগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় মেটাতেই এই ব্যবস্থা।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গত ১৩ বছরে সরাসরি বা কৌশলে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে অন্তত পাঁচবার। তবে এবার সরাসরি টিকিটের দাম না বাড়িয়ে যাত্রী সাধারণকে অন্ধকারে রেখে পূর্ব নোটিশ না দিয়েই ‘পন্টেজ চার্জ’ বা মাশুল আরোপের মাধ্যমে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এতে আসন ও রুটভেদে সর্বনিম্ন ৫ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২২৬ টাকা পর্যন্ত ভাড়া বেড়েছে। এতে রেলে চলাচলকারী সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে।

ঢাকা-কক্সবাজার রেল রুটের যাত্রী আব্দুল্লাহ দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, সরকারিভাবে পূর্ব নোটিশ না দিয়ে যাত্রী সাধারণকে অন্ধকারে রেখে রেলের ভাড়া হঠাৎ করে বাড়িয়ে দেওয়া অযৌক্তিক। তিনি বলেন, দেশের উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের মানুষ সড়ক-মহাসড়কের দুরপাল্লার বাসের দীর্ঘ সারি আর তীব্র জটের কথা মাথায় রেখেই রেলভ্রমণ করতেন। তবে বিগত সরকার রেলপথকে সম্প্রসারিত করতে সারাদেশেই রেলসংযোগ প্রকল্প গ্রহণ করে। এতে সাধারণ যাত্রীদের মধ্যেও রেলভ্রমণে আগ্রহ বাড়তে থাকে। সরকারের এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে স্বল্প আয়ের মানুষ দ্রুত ও নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানোর বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েই সাশ্রয়ী মূল্যের রেল পরিবহন খাতকে বেছে নেয় ও ভ্রমণ শুরু করে। তিনি বলেন, সময়ের ব্যবধানে রেলে যাত্রীর চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সরকারও এর সম্প্রসারণের পাশাপাশি নানামুখী উদ্যোগ নেয়। সিলেটের বাসিন্দা মো. মনির হোসেন দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, যাত্রী সাধারণের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় রেলের কদরও বাড়ে কয়েকগুণ। আর এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে দেশের যাত্রী সাধারণকে অনেকটা অন্ধকারে রেখেই পূর্ব নোটিশ না দিয়েই কৌশলে ঢাকা-কক্সবাজার, ঢাকা-সিলেটসহ দেশের ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ রুটে ট্রেনের ভাড়া বাড়িয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। জনগুরুত্বপূর্ণ ৬টি রুটের ১১টি সেতুতে পয়েন্ট চার্জের নামে যুক্ত করা হয়েছে বাড়তি টাকা। বাংলাদেশ রেলওয়ে সুবিধা ও লাভজনক প্রতিষ্ঠান হলেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা আর অভ্যন্তরীণ অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে লোকসান গুণছে। এর দায় কর্তৃপক্ষকেই বহন করতে হবে। যাত্রীদের উপর বাড়তি ভাড়া চাপিয়ে দেয়ার পেছনে তৃতীয় কোনো সিন্ডিকেটের হাত থাকতে পারে।
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার বাসিন্দা ঢাবি’র ছাত্রী তাহমিনা আক্তার নিশি দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, দেশের যাত্রী সাধারণের কাছে আগাম নোটিশ না দিয়ে বা মুক্ত আলোচনা না করে হঠাৎ দেশের জনগুরুত্বপূর্ণ ৬টি রুটে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো রেলভ্রমণে যাত্রীদের নিরুৎসাহিত করবে। এসব যাত্রী ভাড়া বিবেচনায় বাধ্য হয়ে দুরপাল্লার বাসসহ অন্যান্য পরিবহন ব্যবহারে উৎসাহী হয়ে উঠবে। সুতরাং কার্যকর করা নতুন করে ভাড়া বাড়ানোর বিষয়টি পূণঃবিবেচনার দাবি জানিয়েছেন তাহমিনা আক্তার নিশিসহ রেলের অন্যান্য যাত্রীরা।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, রেলপথে কোনো সেতু বা সমজাতীয় স্থাপনা থাকলে তার রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় মেটাতে যে অতিরিক্ত মাশুল নেওয়া হয় সেটিই হচ্ছে ‘পন্টেজ চার্জ’। নিয়ম অনুযায়ী ১০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি সেতুকে আড়াই কিলোমিটার পথ হিসেবে গণনা করা হয়। ফলে এক কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুর দূরত্ব ধরা হয় ২৫ কিলোমিটার। এতে কাগজে-কলমে রুটের দৈর্ঘ্য বেড়ে যায় এবং সেই অনুপাতে ভাড়াও বাড়ে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য মতে, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-কক্সবাজার, ঢাকা-সিলেট, চট্টগ্রাম-সিলেট, চট্টগ্রাম-জামালপুর ও ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ- এই ছয় রুটের ১১টি সেতুতে ‘পন্টেজ চার্জ’ আরোপ করা হয়েছে।
রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ২৫ মে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলামের উপস্থিতিতে রেলওয়ের আয় বাড়ানো ও ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে টিকিটের ভাড়া না বাড়িয়ে কীভাবে রাজস্ব বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে ১৩টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ১০০ মিটার বা তার বেশি দৈর্ঘ্যের সেতুগুলোতে ‘পন্টেজ চার্জ’ আরোপ করা। সেই সিদ্ধান্তানুযায়ী ‘পয়েন্ট চার্জ’ যুক্ত করে সহনীয় পর্যায়ের ভাড়া বাড়ানো হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১২ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ‘সুবর্ণ এক্সপ্রেস’ ট্রেনের স্নিগ্ধা আসনের ভাড়া ছিল ৫৮৫ টাকা। ২০১৬ সালে তা বেড়ে হয় ৭২৫ টাকা। ২০২৪ সালে রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহারের পর ভাড়া দাঁড়ায় ৮৫৫ টাকা। এবার নতুন ‘পন্টেজ চার্জ’ যুক্ত হওয়ার পর এখন যাত্রীদের গুণতে হচ্ছে ৯৪৩ টাকা। ঢাকা-কক্সবাজার রুটে চলাচলরত কক্সবাজার ও পর্যটক এক্সপ্রেস ট্রেনের স্নিগ্ধা আসনের ভাড়া এক হাজার ৩২২ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে এক হাজার ৪৪৯ টাকা। এসি বার্থের ভাড়া ২ হাজার ৪৩০ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৫৬ টাকায়। এ রুটে সর্বোচ্চ ২২৬ টাকা পর্যন্ত ভাড়া বেড়েছে।
এর আগে ২০১২ সালে একলাফে ৫০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানো হয়। ২০১৬ সালে কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া বাড়ে ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। ২০২২ সালে নন-এসি প্রথম শ্রেণির টিকিটে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়। ২০২৪ সালে অতিরিক্ত বগির টিকিটে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বাড়তি ভাড়া নেওয়া হয়। একই বছরের মে মাসে দীর্ঘপথে যাত্রীদের রেয়াতি সুবিধাও প্রত্যাহার করা হয়।
হঠাৎ করেই ট্রেনের ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলোর মধ্যে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, বাংলাদেশ রেলওয়ে স্বল্প আয়ের মানুষের সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও নিরাপদ পরিবহন। তবে বারবার কৌশলে ভাড়া বাড়ানো সাধারণ মানুষের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। সরকার চাইলে রেলের অভ্যন্তরীণ অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করেই নিজস্ব উদ্যোগে রাজস্ব বাড়াতে পারে। এভাবে কৌশলে ‘পয়েন্ট চার্জ’ এর নামে ভাড়া বাড়ানো যৌক্তিক বলে মনে হচ্ছে না। রেলে যাত্রী সাধারণের অবাধ চলাচল নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ করতে এবং যাত্রীদের চাহিদা ধরে রাখতে বিষয়টি নিয়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের এখনও ভেবে দেখার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
তবে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, দেশের সব রুটে নয়, নির্দিষ্ট কিছু রুটে কৌশলগত কারণে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এটি সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নেওয়া হয়েছে এবং পুরোনো সেতুগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় মেটাতেই এই ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। যা শনিবার (২০ ডিসেম্বর) থেকেই নতুন এ ব্যবস্থা কার্যকর হয়েছে।
এমআর/সবা
























